বহুল আলোচিত বহুস্তর বিপণন কোম্পানি (এমএলএম) ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের কর্ণধার মো. রফিকুল আমীন কারাগারে বসেই ব্যবসায়িক বৈঠক করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ ওঠার পর তদন্ত কমিটি করেছে কারা অধিদপ্তর। সেই সঙ্গে প্রিজন সেলে রফিকুল আমীনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা প্রধান কারারক্ষীসহ আটজনকে প্রত্যাহার (ক্লোজড) করা হয়েছে।
কারাবন্দি হয়েও রফিকুল আমিনের ব্যবসায়িক জুম বৈঠক
কখনো বহুমূত্র, কখনো পিঠের ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমিন। মাস দুয়েক হাসপাতালে থেকে আবারও কারাগারে ফিরে যান তিনি। সর্বশেষ এ বছরের এপ্রিলে ডায়াবেটিসের কথা বলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ভর্তি হন রফিকুল আমিন। এখনো তিনি সেখানেই আছেন।
তবে, রফিকুল আমিন শুধুমাত্র কাগজে-কলমে কিংবা চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনে ‘অসুস্থ’। হাসপাতালে থেকে দিব্যি ব্যবসা পরিচালনা করে যাচ্ছেন তিনি। মোবাইল-ইন্টারনেট ব্যবহার করে জুম অ্যাপে নিয়মিত মিটিংও করছেন।
জুম প্ল্যাটফরমের মাধ্যমে তার নেতৃত্বে বৈঠক হওয়ার একাধিক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এক ঘণ্টার বেশি সময়ের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, রফিকুল আমীনের নাম লেখা ইংরেজিতে ‘আর’। তিনি বৈঠকে অংশ নেওয়া অন্যদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন।
রফিকুল আমীনের সঙ্গে জুম বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সোলায়মান মিয়াজী, আবদুল হালিম, মোস্তাক আহমেদ, মুসলেহউদ্দিন বাদশা, কফিল উদ্দিন, সুলতান মাহমুদ, মোহাম্মদ হেলাল, মনজুরুল হক প্রমুখের নাম রয়েছে।
দেখা গেছে, রফিকুল আমীন তাদের উদ্দেশে বলছেন, দেশের সব থানায় এজেন্ট নিয়োগ করতে হবে এবং অবশ্যই সৎ থাকতে হবে এই এজেন্টদের। আশ্বাস দিয়ে তিনি জানান, বিদেশ থেকে অনেক টাকা আনা হবে। ১০০ টাকার শেয়ারে ১ হাজার ৮০০ টাকা লভ্যাংশ পাওয়া যাবে ইত্যাদি।
বিএসএমএমইউর উপাচার্য শারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রক্টর হাবিবুর রহমানকে বিষয়টি খতিয়ে দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে’।
প্রক্টর হাবিবুর রহমান জানান’ ‘রফিকুল আমীনের কাছে মোবাইল থাকার কথা নয়। এরপরও এর সত্যতা যাচাই করব। এ জন্য আমরা আগামী শনিবার একটি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করব। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।
এর আগে ২০১৯ সালের ১১ মার্চ থেকে ২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত প্রায় ১৬ মাস রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন রফিকুল আমিন। ওই সময় তিনি বহুমূত্র ও পিঠে ব্যথার কারণ দেখিয়েছিলেন। কারা কর্তৃপক্ষ ২৭ বার চিঠি দিলেও তাকে কারাগারে পাঠায়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরে অবশ্য তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
এছাড়া ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে পেটে ব্যথার কারণ দেখিয়ে চার মাস বারডেম হাসপাতালে ছিলেন রফিকুল আমিন। ওই সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার বড় কোনো সমস্যা ধরা পড়েনি। সর্বশেষ পিএলআইডি-জনিত (লোয়ার ব্যাক পেইন) সমস্যার কথা বলে হাসপাতালে থেরাপি নেন তিনি।
২০১২ সালের ৩১ জুলাই রাজধানীর কলাবাগান থানায় ডেসটিনির এমডি রফিকুল আমিন এবং প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসেনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওই বছরের ১১ অক্টোবর গ্রেপ্তার হন রফিকুল আমিন ও মোহাম্মদ হোসেন। ২০১৪ সালের ৪ মে দাখিল করা অভিযোগপত্রে আসামি করা হয় মোট ৫৩ জনকে। তাদের বিরুদ্ধে চার হাজার ১১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং ৯৬ কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচারের অভিযোগ আনা হয়। গ্রেপ্তারের পর থেকে কারাগারে আছেন রফিকুল আমিন।
বিভিন্ন সময় জামিন চেয়ে আদালতে আবেদন করেন তারা; উচ্চ আদালতেও যান। কিন্তু আদালত তাদের জামিন দেননি। বর্তমানে একটি মামলায় তিন বছরের সাজাসহ বেশ কয়েকটি বিচারাধীন মামলায় কারাবন্দি আছেন রফিকুল আমিন।
আদালতের নির্দেশে ২০১৩ সাল থেকে ডেসটিনির নামে থাকা বিপুল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির দায়িত্ব পালন করছে পুলিশ। রাজধানীতে থাকা ডেসটিনির সম্পদ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এবং রাজধানীর বাইরের সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপার (এসপি)।
অর্থ হাতিয়ে নিতে মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সাংসদ, রাজনীতিবিদ, শীর্ষ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা এবং ডিসি-এসপিদের ব্যবহার করেছেন রফিকুল আমীন। তাদের সঙ্গে ছবি তুলে জেলা, উপজেলাসহ সব অফিসে বড় বড় করে টাঙিয়ে রাখতেন তিনি। নতুন গ্রাহক-পরিবেশকদের আস্থা অর্জনের জন্য এ ছিল তার কৌশল। অর্থাৎ সহজ-সরল মানুষদের বোঝানো যে এত বড় প্রভাবশালী মানুষ ডেসটিনির সঙ্গে আছেন।
প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ব্যবসায়ের অংশীদার করে, মাসোহারা দিয়ে এবং সেধে গিয়ে বড় বড় ক্রীড়ানুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের স্পনসর করাও ছিল ডেসটিনির আরেক কৌশল। মুম্বাই চিত্রনায়ক শাহরুখ খান ও নায়িকা রানী মুখার্জিকে দেশে এনে অনুষ্ঠানও করেছিল ডেসটিনি। ২০১৩ সালে পুলিশের এক প্রতিবেদনেই এসব কথা উঠে এসেছিল।
তদন্ত কমিটি গঠন
ডেসটিনির রফিকুল আমীনের বিরুদ্ধে কারাগারে জুম বৈঠকের অভিযোগের ঘটনায় তদন্ত কমিটি করেছে কারা কতৃপক্ষ।
কারা উপ-মহাপরিদর্শক (ঢাকা) তৌহিদুল ইসলামকে প্রধান করে গঠিত তিন সদস্যের কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান মামুন গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
কারা মহাপরিদর্শক (আইজি-প্রিজনস) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান বিষয়টি জানিয়ে বলেন, প্রতিবেদন পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, ‘এই কমিটি আগামী ৭ কর্মদিবসের মধ্যেই বিষয়টি তদন্তপূর্বক রিপোর্ট প্রদান করবে ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
৮ কারারক্ষী প্রত্যাহার
ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমিন কারাবন্দি থাকা অবস্থায় ভিডিও মিটিং অ্যাপ ব্যবহার করে নতুন করে এমএলএম ব্যবসা পরিচালনা করার প্রস্তুতির অভিযোগ পাওয়ার পর দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে প্রধান কারারক্ষীসহ আট সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক সুভাষ কুমার ঘোষ জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) দায়িত্বরত আট কারারক্ষীকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন প্রধান কারারক্ষী, সাতজন সাধারণ কারারক্ষী।
এদিকে কারা কর্তৃপক্ষ বলেছে, এখন থেকে প্রিজন সেলে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালনের জন্য একজন ডেপুটি জেলারকে দায়িত্ব দেয়া হবে।
অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক কর্নেল আবরার হোসেন বলেন, কমিটি গঠনের পাশাপাশি হাসপাতালে যে সব কারারক্ষীরা দায়িত্বে ছিলেন, তাদের সরিয়ে অন্য সদস্যদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর সেসব কারারক্ষীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩৪
আপনার মতামত জানানঃ