ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশন কার্যালয়ে হামলা ও পতাকা অবমাননার ঘটনায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ দেখা যাচ্ছে। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন।
এছাড়াও সোমবার রাত থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনকে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে দেখা গেছে। মঙ্গলবার ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে করেছে বিএনপি, জাতীয় নাগরিক কমিটিসহ বিভিন্ন সংগঠন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “বাংলাদেশের পতাকা পোড়ানোর মতো ঘটনা খুব গভীরভাবে বাংলাদেশের জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি করবে”। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে আলাদা আলাদা ক্ষোভ জানিয়ে বিবৃতি দেয়া হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “একটি পক্ষ চায় বাংলাদেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক। কূটনীতিক শিষ্টাচারের লঙ্ঘনের এই ঘটনায় আমরা নিন্দা জানাই”।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে জরুরি তলব করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার পর মঙ্গলবার একটি সংগঠন ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করলেও পরে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। তবে সোমবার রাত থেকেই ঢাকার বারিধারায় ভারতীয় হাইকমিশন ও কূটনীতিক জোনে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায়।
বাংলাদেশ–ভারত উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব এম রিয়াজ হামিদুল্লাহর দপ্তরে তাকে তলব করা হয় মঙ্গলবার বিকেলে। বিকেল চারটার পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যান ভারতীয় হাইকমিশনার মি. ভার্মা। ভারতীয় হাইকমিশনার যখন অফিস ছেড়ে যাচ্ছিলেন তখন কার্যালয় ত্যাগ করছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মোঃ তৌহিদ হোসেন।
তবে ভিন্ন এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, “বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কে আন্তরিকতা বাড়াতে বাংলাদেশের যতটুকু করার আমরা তা করবো”। পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বের হয়ে ভারতীয় হাইকমিশনার মি. ভার্মা কথা বলেন গণমাধ্যমের সাথে।
এসময় তিনি বলেন, “বাংলাদেশের সাথে ইতিবাচক গঠনমূলক সম্পর্ক নির্মাণ করতে চায় ভারত। একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে দুই দেশের সম্পর্ক আটকে থাকার কারণ নাই, আমাদের সম্পর্ক বহুমাত্রিক”।
এর আগে সোমবার রাতেই এই ঘটনায় কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এ হামলা ও পতাকা অবমাননার ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ঢাকা। সোমবার রাতেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়। সাম্প্রতিক বাংলাদেশ ভারতের এই সম্পর্কের টানাপোড়েন এমনকি দূতাবাসে হামলার ঘটনায় দুই দেশের কূটনীতিক টানাপোড়েন নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
কূটনীতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সম্পর্ক ভালো করতে হলে উদ্যোগী হতে হবে ভারত সরকারকে। বিবিসি বাংলাকে কূটনীতিক বিশ্লেষক হুমায়ূন কবির বলেন, “কূটনীতিক স্থানে নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল ভারতের। তারা সেটি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এটা শুধু স্থাপনা বা হাইকমিশনের ওপর হামলা না। এটা একটা নেতিবাচক প্রবণতা। যেটি কারো জন্যই মঙ্গলজনক না”।
সোমবার রাত থেকেই বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও রাস্তায় নেমে অনেককে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদ জানাতে দেখা যায়।
এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদেরও। ওই ঘটনাকে ‘ন্যক্কারজনক’ আখ্যা দিয়ে সোমবার রাতেই নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে পোস্ট দেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল।
মি. নজরুল লিখেন, “আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনকে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব ভারতীয় সরকারের। তারা এটি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার নিন্দা জানাই।’
সোমবার রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক প্রতিক্রিয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, “যদি ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হাইকমিশনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীর সহায়তা চাইতে পারে”।
“সেক্ষেত্রে শান্তিরক্ষা মিশনে সৈন্য সহায়তা বাড়িয়ে সহযোগিতা করতে পারে বাংলাদেশ” যোগ করেন মি. মাহমুদ। এই ঘটনায় ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নৌপরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন।
মঙ্গলবার চাঁদপুরে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা মি. হোসেন বলেন, “আমরা একটা বন্ধুত্ব ভাবাপন্ন মনোভাব নিয়ে থাকতে চাই। আমরা তাদের নেইবার, কিন্তু যদি বাংলাদেশকে এভাবে হেনস্তা করতে থাকে তাহলে মনে রাখবেন, ১৮ কোটি মানুষের এই দেশ। অন্য ছোটখাটো দেশ আপনাদের আশপাশে যা আছে এটি তা নয়”।
এসময় তিনি বলেন,”তারা (ভারত) যদি পায়ে পড়ে ঝগড়া করতে চায়, তাহলে বাংলাদেশের লোকজন কোনোদিন ওই দেশমুখী হবে না। ওই দেশের প্রতি আমাদের যে একটা বন্ধুত্বসুলভ বিষয় ছিল, সেটি খারাপ করছেন ওনারা”।
আগরতলায় বাংলাদেশি সহকারী হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদে মঙ্গলবার রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে বিএনপি।
নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে শুরু হয়ে নাইটেঙ্গেল মোড় ঘুরে ফের নয়াপল্টনের সামনে গিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শেষ হয় এ কর্মসূচি। পরে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার ঘটনার কড়া প্রতিবাদ জানায় দলটির নেতারা।
দুপুরে এক বিবৃতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “কূটনীতিক মিশনে হামলার ঘটনায় ঘৃণা বিদ্বেষে টানাপোড়েন বাড়বে দুই দেশের সম্পর্কে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ভারতে বিভিন্ন উগ্রবাদী সংগঠনের যে অপতৎপরতা সেটাকে উস্কে দেয়ার মতো কোন ঘটনা যেন ভারতের পক্ষ থেকে না হয় এবং সরকারিভাবে তারা যেন দমন করেন, আমরা তাদের কাছে এই প্রত্যাশা করি”।
“বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সম্পর্কটা হবে উভয় দেশের জনগণের মধ্যে, সরকার ও সরকারের মধ্যে, দেশ ও দেশের মধ্যে। এই সম্পর্কের মধ্যে যেন অন্য কিছু স্থান না পায়”, বলেন বিএনপি নেতা মি. আহমেদ।
সোমবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল হয়। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা মিছিল সমাবেশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায়।
এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। বিবৃতিতে দলটি বলেছে, এ ঘটনা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিনষ্ট করার এক গভীর ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের অংশ বলেই জামায়াত মনে করে।
দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বিবিসি বাংলাকে বলেন, ভারত তার প্রতিবেশী দেশের কূটনৈতিক মিশনের নিরাপত্তা দিতে যেখানে ব্যর্থ, তারা সেখানে সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতির ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দেশ বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলার কোনো অধিকার তাদের থাকতে পারে না”। এছাড়া ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাব, শাহবাগের জাতীয় জাদুঘর, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনে বিক্ষোভ করে বিভিন্ন সংগঠন।
বিকেলে ঢাকার শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরে সামনে বিক্ষোভে ভারতীয় হিন্দু সংঘর্ষ সমিতির এই হামলার তীব্র নিন্দা জানায় জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা।
সোমবার আগরতলার বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার ঘটনার পরই ঢাকার বারিধারা এলাকায় ভারতীয় দূতাবাসের সামনে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।
মঙ্গলবার দুপুরে বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি নামের একটি সংগঠন ভারতীয় দূতাবাস ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দেয়ার পর এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।।বাংলাদেশের বারিধারার ডিপ্লোম্যাটিক জোন এলাকায় গিয়ে বিবিসি বাংলার সংবাদদাতা দেখতে পেয়েছেন ভারতীয় দূতাবাসে প্রবেশের বিভিন্ন রাস্তায় অবস্থান নিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
সেখানে বাঁশতলা থেকে ভারতীয় দূতাবাসগামী তিনটি প্রবেশমূখে ব্যারিকেড দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগ। সেখানে পুলিশ, র্যাব, এপিবিএনের পাশাপাশি ভারতীয় দূতাবাসের নিরাপত্তায় মোতায়েন ছিল সেনাবাহিনীর সদস্যরাও।
গুলশান বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) তারেক মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, সিভিল সোসাইটি নামে একটি সংগঠনের কর্মসূচি ঘোষণার কারণে ডিএমপির উর্ধতন কর্তৃপক্ষসহ সবাই এই বিষয়টিতে খুব সচেতন আছে। আমাদেরকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে ভারতীয় দূতাবাস কেন্দ্রিক নিরাপত্তা সর্বোচ্চ এলার্ট পজিশনে জোরদার করা”।
তিনি বলেন, “তারই অংশ হিসেবে আমরা কয়েক স্তরে নিরাপত্তা রেখেছি যাতে কোন ধরনের কোন সংগঠন এখানে এসে বেআইনি কিছু করতে না পারে এবং কোন ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে”।
পুলিশ জানিয়েছে, বাংলাদেশের কূটনীতিক জোনে যে কোন ধরনের সহিংসতার ঘটনা এড়াতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবোর্চ্চ সতর্ক অবস্থানে থাকবে।
আপনার মতামত জানানঃ