বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের পর ভারতকে নিয়ে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলগুলোর এক ধরনের পাল্টাপাল্টি অবস্থান দৃশ্যমান হয়েছে। বিএনপিবিহীন ৭ই জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে ভারত সরকারের নীতি ক্ষমতাসীনদের প্রশংসা কুড়িয়েছে আর বিরোধীদের কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছে। রাজনীতির মাঠে বিরোধী দলগুলোর সভা সমাবেশে ভারত বিরোধী একটা অবস্থান এখন প্রকাশ্যে আসছে।
জাতীয় নির্বাচনের পর বাংলাদেশে মাঠের রাজনীতিতে ভারত বিরোধিতার বিষয়টি যেমন দৃশ্যমান হচ্ছে তেমনি সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমেও ভারতীয় পণ্য বর্জনের ক্যাম্পেইন নিয়ে পাল্টাপাল্টি তর্ক বিতর্ক এবং সমালোচনা জোরালো হচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভারতীয় পণ্য বয়কটের বিষয়টি সামনে এনে রীতিমতো আন্দোলন গড়ে তুলতে চাইছেন কেউ কেউ। গণ অধিকার পরিষদের নেতা ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর ঢাকায় একাধিক রাজনৈতিক সভায় ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলেছেন।
ভারত বিরোধী এমন একটি রাজনৈতিক অবস্থান কেন নিয়েছেন এ প্রশ্নে নুর বিবিসিকে বলেন, ভারত যদি একপাক্ষিক সম্পর্ক মেইনটেইন করে তাহলেতো আমাদের অ্যান্টি ইন্ডিয়ান হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নাই। জনগণের প্রতি জনগণের একটা শ্রদ্ধা ভালোবাসা সম্মানের সম্পর্ক আমরা সবসময় তৈরি করতে চাই। কিন্তু শাসক পর্যায়ে, নীতি নির্ধারক পর্যায়ে আমরা এই বার্তাটা দিতে চাই যে ভারত যেভাবে বাংলাদেশকে বিশেষ করে গত পনেরো বছর দেখে আসছে এইটা ঠিক না।
“মোটামুটি ভারতের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যা নেয়া দরকার-বন্দর, ট্রানজিট সেটা কিন্তু ভারত নিয়েছে। কাজেই এখন অন্তত ভারত সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে একটা সুসম্পর্ক গড়ে তুলবে এবং জনগণের চাওয়াকে প্রাধান্য দেবে কিন্তু এই নির্বাচনে আমরা এর বিপরীত চিত্রটা দেখলাম। যে কারণে আমাদের কাছে এখন মনে হয়েছে যে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পাশাপাশি এই সরকারের যেহেতু খুটির জোরটা হচ্ছে ভারত কাজেই সেই ভারতের বিরুদ্ধে জনগণকে আরো সংগঠিত করে একটা মুভমেন্ট দরকার যেটা মালদ্বীপের ক্ষেত্রে হয়েছে”, যোগ করেন মি. নুর।
ঢাকায় ছোটখাট দল বা সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে ইদানীং ভারত বিরোধী ব্যানার, প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করতে দেখা যাচ্ছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা প্রধান দলগুলো অবশ্য সরাসরি ভারত বিরোধী অবস্থান বা কোনো আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করেনি। তবে নির্বাচন বর্জন করা দলগুলোর নেতাদের বক্তব্যে ভারতের সমালোচনা ইদানীং জোরালো হয়েছে।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নাকেও রাজনৈতিক সভায় দেয়া বক্তৃতার এক পর্যায়ে ভারত প্রসঙ্গে সমালোচনা করতে দেখা গেছে। তিনি বলছেন, ভারত বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক করছে না, একটি দলকে সমর্থন দিচ্ছে।
“জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক করলে তারা এই বিবৃতি দিতে পারে না যে বাংলাদেশে নির্বাচিত একটা সরকার হয়েছে। এটা কোনো নির্বাচিত সরকার নয়। পরিস্থিতি একটা নেতিবাচক দিকেই যাচ্ছে এখন। আমরা আশা করবো যেহেতু আমি প্রতিবেশী বদলাতে পারবো না ওরা যত তাড়াতাড়ি বাস্তবটা বুঝতে পারে তত ভালো। আমাদের খুব একটা বেশি ক্ষতি হবে তা কিন্তু আমি মনে করি না। ক্ষতি তাদের হতে পারে।”
আন্দোলন প্রসঙ্গে এই রাজনীতিবিদ গণমাধ্যমকে বলেন, “প্রধানত ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই এবং তাদের দোসর যারা, সঙ্গী যারা তাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা আমরা আপসহীনভাবে করবো।”
বিএনপির রাজনীতি
বাংলাদেশে বিএনপির রাজনীতিতে ভারত বিরোধিতার একটা ইতিহাস রয়েছে। যদিও মাঝে একটা বড় সময় ধরে দলটি ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করেছে এবং এই ইস্যুতে তাদের সতর্ক অবস্থান নিতে দেখা গেছে।
এবার আরেকটি একতরফা নির্বাচনের পর বিএনপি নেতাদের কথায় ভারত বিরোধিতার বিষয়টি দৃশ্যমান হচ্ছে। যদিও ভারত বিরোধী আনুষ্ঠানিক কোনো কর্মসূচী নিয়ে মাঠে নামেনি বা ভারতীয় পণ্য বয়কটের আন্দোলনকেও প্রকাশ্যে সমর্থন দেয়নি বিএনপি।
দলের কেন্দ্রীয় নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দাবি করেন, বিএনপি ভারত বিদ্বেষী নয়, একটি জাতীয়তাবাদী শক্তি এবং জাতীয় স্বার্থের কথাগুলোই তুলে ধরছে।
“বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে একটা দেশের বিরুদ্ধে হবে কেন। কিন্তু একটা দেশ যদি আমার ক্ষতি করে, সেই ক্ষতির কারণগুলো যদি আমি দেশের জনগণের সামনে উপস্থাপন করি তাহলে আপনি আমাকে ভারত বিরোধী বলবেন কেন? আমি কি আমার দেশের স্বার্থের কথা বলবো না? ভারত যে আওয়ামী লীগকে পৃষ্ঠপোষকতা করে এটাতো সবাই জানে। আমরা আশা করবো ভারত বাংলাদেশের সাথেই সম্পর্ক করবে কে সরকারে আসলো সেটা তাদের দায়িত্ব না”, বলেন মি. রায়।
তার মতে, “বন্ধুত্বটা হবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে। অর্থাৎ বাংলাদেশি জনগণ ও ভারতীয় জনগণের মধ্যে। বন্ধুত্বটা কোনো বিশেষ দল বা ব্যক্তির সঙ্গে হলে হবে না। সেটাকে কিন্তু কূটনৈতিক সম্পর্ক বলা যাবে না। আমিতো বলছি এ সরকার ভারত-চীন-রাশিয়ার। এ সরকার বাংলাদেশের জনগণের না।”
বিএনপির রাজনীতিতে ভারত বিরোধী অবস্থান প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেনের পর্যবেক্ষণ হলো, “বিএনপির ঐতিহ্য আছে ভারত বিরোধিতার। আমি যতটুকু বুঝি বা যেটা অনেকের কাছে শুনেছি যে তারা সেটা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল। আঠারো নির্বাচনের আগে তারা সম্ভবত ভারতকে কিছু আশ্বাসও দিয়েছিল যে তারা ভারত বিরোধী রাজনীতি করবে না এবং একটা লেভেল প্লেইং ফিল্ড হয়, যাতে তারা এখানে একটা অবস্থান নিয়ে ফেরত আসতে পারে। ক্ষমতা হোক বা না হোক অন্তত একটা ভালো অবস্থানে ফেরত আসতে পারে। যতটুকু জানা গেছে বিভিন্ন সূত্র থেকে, ভারত আশ্বস্ত হয়নি যে তারা ভারত বিরোধী যে শক্ত অবস্থান সেখান থেকে সরে গেছে।”
২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বিএনপিকে ভারত ইস্যুতে সরব হতে দেখা যায়। ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে দুই দেশের চুক্তি সম্পাদনের প্রতিবাদে মাঠে নেমেছিল বিএনপি। প্রকাশ্য ভারত বিরোধী অবস্থান স্পষ্ট না করলেও একটা ভারত বিরোধী রাজনীতি তাদের আছে বলেই মনে করেন তৌহিদ হোসেন।
“২০১৮’র নির্বাচনের পরে বিএনপি ভারত বিরোধী না এমন ইমেজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে বলে মনে হয় না। কারণ ভারত বিরোধিতা তো আসলে একটা বড় অংশের মানুষের মধ্যে আছে। সেটাকে তারা তো কাজে লাগাতে চাইবে যেহেতু ভারত ঠিক সেভাবে তাদের (বিএনপি) আস্থায় নেয়নি। ভারত আওয়ামী লীগের পেছনেই পুরো সমর্থন দিয়েছে কাজেই বিএনপি স্পষ্ট যে তারা ভারতের গুডবুকে নেই বা ভারত তাদের সমর্থন করবে না। সেটা ধরে নিয়েইতো তাদের রাজনীতি করতে হবে।”
আওয়ামী লীগের অবস্থান
এদিকে ভারতের সঙ্গে বরাবরই সুসম্পর্কের ইতিহাস রয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের। নির্বাচন পরবর্তী সরকার গঠনের পর প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরের জন্য ভারতকেই বেছে নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
বিএনপি ভোট বর্জনের পরও আন্তর্জাতিক চাপ সামাল দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে সক্ষম হওয়ার নেপথ্যে ভারতের ভূমিকার কথা স্বীকার করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
দলটির নীতি নির্ধারকরা বলেছেন আগামী দিনে ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে এবং আরো বিকশিত হবে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য-অর্থনীতি পরস্পর নির্ভরশীল। ভারতের সাথে আমাদের যে সম্পর্ক সেই সম্পর্কের কারণে আমরা উভয় দেশ উপকৃত হই।”
আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থাকার জন্য ভারতকে সুবিধা দিচ্ছে এবং স্বার্থ আদায় করতে পারছে না এমন সমালোচনা সঠিক নয় বলে দাবি করেন ড. রাজ্জাক। তিনি বলছেন, স্থল সীমান্ত, ছিটমহল এবং সমুদ্রসীমার বিরোধ আওয়ামী লীগ সরকারই সমাধান করেছে। “আমরা এক লক্ষ আঠারো হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গা মিয়ানমার ও ভারত থেকে পেয়েছি। সেটাওতো আমরা সমধান করেছি। ছোট-খাট দুয়েকটি সমস্যা তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও আছে যার কারণে তিস্তা হয় নাই। কিন্তু আলোচনা অব্যাহত রয়েছে এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস অনতিবিলম্বে তার সমাধান হবে।”
আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদে ভারত বাংলাদেশের সম্পর্কের উন্নতি নিয়ে দুই দেশই গর্ব করে। তবে কূটনৈতিক এই সম্পর্ক দেশের চেয়ে একটি দলের সঙ্গে বেশি এমন সমালোচনা রয়েছে। তাছাড়া দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক থেকে কে কতটা লাভবান হয়েছে তা নিয়েও রয়েছে নানা বিশ্লেষণ।
ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ মিটলেও সীমান্তে হত্যা থেমে নেই, ফেনী নদীর পানি ভারতকে দিতে বাংলাদেশ চুক্তি করলেও তিস্তা চুক্তি হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মূল্যায়ন করে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, “ভারতের জন্য খুব কমফোর্টেবল এটা যে এখানে আওয়ামী লীগ সরকার থাকা। সেক্ষেত্রে দুটো দিক হতে পারে, একটা হলো যে আওয়ামী লীগ ভারতকে খুশি রাখার চেষ্টা করতে পারে অথবা ভারত ভাবতে পারে যে আমাদের পছন্দের সরকার আছে কাজেই এ সরকারকে আমরা শক্ত সাপোর্ট দেই যাতে সব সমস্যার সমাধান হয়।”
“দ্বিতীয়টা- আমি চাই যে এরকম হোক কিন্তু যদি গত দশ পনের বছরের ইতিহাস দেখি তাহলে এটা খুব আশাবাদী হতে পারি না”, যোগ করেন মি. হোসেন।
আপনার মতামত জানানঃ