চুরির অপবাদে এক আদিবাসী মাকে দীর্ঘ চার ঘণ্টা গাছে বেঁধে নির্যাতন করা হয়। এসময় পাশেই দুধের শিশু কোলে ভিক্টিমের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে আর মায়ের বুকের দুধের জন্য কান্না করছিল দুধের শিশুটি। এমনি এক হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটেছে টাঙ্গাইলে। গত শনিবার (৯ জানুয়ারি) টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার সাগরদিঘি ইউনিয়নের মালিরচালা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় পরদিন রোববার (১০ জানুয়ারি) পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
মামলার আসামিরা হলেন- মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া (৮০) মোস্তফা ভূঁইয়া (৪৫), সজিব ভূঁইয়া (৪০), খুকি (৩৭) ও সুমি আক্তার (৩২)।
মামলার বিবরণে জানা যায়, সন্ধা রানী উপজেলার সাগরদিঘি ইউনিয়নের মালিরচালা গ্রামের নারায়ন বর্মনের স্ত্রী। তিনি দুই ছেলে ও এক মেয়ের জননী। আসামিদের সন্তানদের সঙ্গে তার ছোট ছেলে পলাশ (৮) খেলা করত এবং ঘুড়ি ওড়াত। ঘটনার ১৫ দিন আগে মামলার ১ নম্বর আসামি মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়ার বাড়ি থেকে ঘুড়ি বানানোর জন্য পত্রিকা নিয়ে আসে তার ছেলে পলাশ। এদিন পলাশ তার সন্তানদের সঙ্গেও ঘুড়ি ওড়ায়।
হঠাৎ মনিরুলের বাড়ি থেকে স্বর্ণ ও টাকা-পয়সাসহ মূল্যবান কাগজপত্র চুরি হয়ে যায়। পরে গত ৩ জানুয়ারি পলাশকে তারা ধরে নিয়ে মারধর করেন এবং মালামাল চুরি করে তার মায়ের কাছে জমা দিয়েছে- এ ধরণের কথা শিখিয়ে দেন। তা না-হলে তার মাকে মেরে ফেলার হুমকি দেন অভিযুক্তরা। ভয়ে পলাশ স্বীকারোক্তি দেয়।
পরে গত শনিবার মামলার ৪ এবং ৫ নম্বর আসামি সন্ধা রানীর বাড়িতে গিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। তাকে বাড়ি থেকে ধরে এনে করিম ভূঁইয়ার আকাশমনি গাছের বাগানে রশি দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখে। এসময় মামলায় উল্লেখিত পাঁচ আসামি ওই নারীকে এলোপাতাড়ি মারধর করেন। পরে স্থানীয়রা ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন।
প্রত্যক্ষদর্শী মহানন্দ চন্দ্র বর্মণ বলেন, ঘটনার দিন সন্ধ্যা থেকে প্রায় চার ঘণ্টা সন্ধ্যা রানীকে বেঁধে রেখে নির্যাতন করা হয়। এ সময় তার ছয় মাসের শিশু মায়ের বুকের দুধের জন্য কান্না করলেও তাতে লাভ হয়নি।
মামলার আসামি মোস্তফা ভূঁইয়া বলেন, আমার ছোট বোনের গহনা চুরি করে সন্ধ্যা রানীর ছেলে পলাশ। চুরি করা গহনা তার মায়ের কাছে জমা দেয়। বারবার চাইলেও তারা দেয়নি। তাই ছোট বোন সুমি তাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল।
সত্যতা নিশ্চিত করে সাগরদিঘি ইউপি চেয়ারম্যান হেকমত সিকদার বলেন, চোর সন্দেহে মাকে গাছে বেঁধে রাখার খবর পেয়ে লোক পাঠিয়ে ও পুলিশের সহযোগিতায় ওই নারীকে উদ্ধার করেন। তিনি বলেন, স্বর্ণালঙ্কার হারানোর বিষয়টি ইউপি মেম্বার বা চেয়ারম্যানকে অবগত না করে, বিচার নিজের হাতে নিয়ে তারা ঠিক করেনি।
ঘাটাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-তদন্ত) মো. ছাইফুল ইসলাম বলেন, ১০ জানুয়ারি রাতে নির্যাতিতা সন্ধ্যা রানী নিজে বাদী হয়ে পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করেন। আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, এটি অবশ্যই মানবাধিকার লঙ্ঘন। সাধারণত গরিব, অসহায়, আদিবাসীদের ওপর সমাজের ধনী মানুষগুলো জুলুম-অত্যাচার করে নোংরা আনন্দ পায়। নারী ও শিশুর প্রতি তারা সহিংসতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, আইন হাতে তুলে নিয়েছে। তাদের দ্রুত গ্রেফতার করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
এদিকে গাছে বেঁধে আদিবাসী এক মাকে নির্যাতনের ঘটনা ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে গেছে। সেখানে এক মাকে গাছে বেঁধে এবং দুধের জন্য কান্নারত দুধের বাচ্চার ছবিটি পোস্ট করে অনেকেই নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। একইসাথে অমানবিক এই কাজের জন্য দোষীদের বিরুদ্ধে উষ্মা প্রকাশ সহ দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানান। অনেকেই বলেন, আমরা এতোটাই মধ্যযুগীয় সমাজে বসবাস করছি যে যেখানে দুধের জন্য এক শিশু কাঁদছে আর তার মাকে বেঁধে রাখা হয়েছে গাছের সাথে। এমন ঘটনায় আহত হয়ে একজন বলেন, আদিবাসীদের আমরা এখনো অমানুষই মনে করি। তাদেরকে মানুষের কাতারে ভাববার মতো জ্ঞানের বিকাশ এখনো আমাদের হয়নি। যেভাবে পশুকে বেঁধে পিটাতে অনেকের চেতনায় কোনো আহতবোধ করে না, আদিবাসীদের নির্যাতনেও এক শ্রেণির লোক কোনো অনুতপ্তবোধ করে না বরং আনন্দ নিয়েই যেন কাজটি করে থাকে। আদিবাসীদের বাঁকা দৃষ্টিতে দেখার এবং বিভিন্ন উপায়ে দমননীতি, নির্যাতন করার মানসিকতা থেকে আমরা এখনো বেরিয়ে আসতে পারিনি বলে জানান কেউ কেউ। ঘটনায় সংশ্লিষ্ট দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন সকলে।
এসডাব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০৩
আপনার মতামত জানানঃ