মোহাম্মদ রুবেল
দক্ষিন এশিয়ার প্রথম স্নাতক, আলোচিত ও সমালোচিত সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে প্রণাম জানিয়ে আজকের বয়ান শুরু করা যাক। আমরা বাঙালি মুসলমানরা তাকে এড়িয়ে চলতে পারলেও উপেক্ষা করতে পারিনা। বাংলার হিন্দু পুনর্জাগরণের পথিকৃৎ অসাধারণ মেধাবী এই সাহিত্যক ১৮৫৮ সালে ১৯ বছর ১০ মাস বয়সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতক পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেনীতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। উল্লেখ্য যে, ঐ বছর কেউ প্রথম শ্রেণী পায়নি। বঙ্কিমচন্দ্র ব্রিটিশ ভারতের আমলা হলেও সবাই তাকে কালজয়ী সাহিত্যিক হিসেবেই চেনে। তাই তার মতামত, অভিপ্রায় ও আক্ষেপ আমলে নিতেই হয়।আজকের সার লেখার ঐতিহাসিক বাস্তবতা খুঁজতে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের কিছু লাইন আমার কাছে প্রাসঙ্গিক মনে হলো। ১৮৮০ সালে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় তিনি ‘বাঙলার ইতিহাস সম্পর্কে কয়েকটি কথা নামক’ একটা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। অদ্যবদি তার এই নিবন্ধ সকল বোদ্ধা মহলে আবেদন রাখতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের জাতীয় জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী নিয়ে আমরা হইচই করি, তীব্র অনুভূতিতে তুলকালাম বাঁধাই, পরিশেষে কিঞ্চিত গালাগালি দিয়ে রণক্ষান্ত দেই। কিন্তু এর শেকড়ে হাত দেইনা। যদি প্রত্যেক কিছু মূলের দিকে ধাবিত হয় তাহলে মূল খোঁজা ছাড়া উপায় কি? এই মূল হলো ইতিহাস।
আমাদের প্রচলিত ইতিহাস পাঠ হলো আমাদের রাজা বাদশাহদের জন্ম মৃত্যুর ইতিহাস। অথচ, এই জন্ম মৃত্যুতে জাতির ফায়দা নগন্য বই বেশি কিছু নয়। তারচেয়ে বেশি ফলপ্রসূ হতো যদি রাজাদের হেরেম নিয়ে ইতিহাস চর্চা হতো এবং পাঠ্যপুস্তকে লিপিবদ্ধ হতো। এতে অন্তত সমাজের একশ্রেণীর নারীকূলের আর্তনাদ শোনা যেতো। হেরেম থেকে সোনাগাছির বিপুল সংখ্যক নর – নারীর মনস্তাত্ত্বিক দিক বোঝা যেত। বাঙালি পুরুষদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা করতে হলে সোনাগাচি আর দৌলতদিয়া নিয়ে গবেষণার বিকল্প নাই। এই প্রসঙ্গে বঙ্কিমের লাইনগুলো পড়া যাক যদিও তিনি ভিন্ন উদ্দেশ্য তার নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন।
‘আমাদিগের বিবেচনায় একখানি ইংরেজি গ্রন্থেও বাঙ্গালার প্রকৃত ইতিহাস নাই। সে সকলে যদি কিছু থাকে, তবে যে সকল মুসলমান বাঙ্গালার বাদশাহ, বাঙ্গালার সুবাদার ইত্যাদি নিরর্থক উপাধি ধারণ করিয়া, নিরুদ্বেগে শয্যায় শয়ন করিয়া থাকিত, তাহাদিগের জন্ম মৃত্যু গৃহবিবাদ এবং খিচুড়ীভোজন মাত্র। ইহা বাঙলার ইতিহাস নয়, ইহা বাঙলার ইতিহাসের এক অংশও নয়। বাঙ্গালার ইতিহাস চাই। নইলে বাঙালি কখন মানুষ হইবে না।’ ‘কে লিখিবে? তুমি লিখিবে,আমি লিখিব, সকলেই লিখিবে। যে বাঙালি তাহাকেই লিখিতে হইবে। আইস, আমরা সকলে মিলিয়া বাঙলার ইতিহাসের অনুসন্ধান করি। যাহার যত দূর সাধ্য, সে তত দূর করুক ; ক্ষুদ্র কীট যোজনব্যাপী দ্বীপ নির্ম্মান করে। একের কাজ নয়, সকলে মিলিয়া করিতে হইবে।’ বঙ্কিমচন্দ্রের অনুপ্রেরণায় আজ আমরা খুঁজবো আমাদের আবাল বৃদ্ধ বণিতার রুপালি পর্দার ললনাদের পূর্বসূরিদের ইতিহাস। যেহেতু প্রত্যেক কিছু মূলে ধাবিত হয় তাই বর্তমান বহু প্রশ্নের জবাব হয়তো পাওয়া যাবে এই প্রয়াসে।
থিয়েটার নিয়ে যাদের টুকটাক পড়াশোনা রয়েছে তারা অবশ্যই চারজন নারীকে মনে রেখেছেন। কারণ বাঙলা থিয়েটারের ইতিহাসে এই চারজন হলেন প্রথম মহিলা অভিনেত্রী। এদের নাম হলো জগত্তারিনী,গোলাপ সুন্দরী, এলোকেশী এবং শ্যামা। পেশায় এরা সবাই ছিলেন রুপজীবিনী বা পতিতা। এদেরকে অভিনয়ে আনার কারণ ছিল মার্জিত পরিবারের কেউ অভিনেত্রী হতে চাইতেন না। এই চারজন অভিনেত্রী অভিনয় না জানলেও ভালো নাচতে জানতেন। এদের মধ্যে গোলাপ সুন্দরী বেশ কয়েক বছর থিয়েটারে টিকে থাকেন। বাকীরা ফিরে যায় পূর্বের পেশায়। গোলাপ সুন্দরী বিয়ে করেন এক তরুণ অভিনেতাকে। তাদের এক ছেলের জন্ম হয়। ছেলেটি বিয়ে করে একজন পতিতা নারীকে। মনের দুঃখে গোলাপ সুন্দরীর স্বামী লন্ডনে পালিয়ে যান। গোলাপ সুন্দরী ফিরে যান তার আগের পেশায়।
গোলাপ সুন্দরী ভালো অভিনেত্রী হলেও অভিনয়ে সবচেয়ে খ্যাতিমান ছিলেন বিনোদিনী। বিনোদিনী ছিলেন একজন ধনী জমিদারের রক্ষিতা। ১৮৭৪ সালে তেরো বছর বয়সে দশ টাকা বেতনে তিনি থিয়েটারে প্রবেশ করেন। ভালো অভিনয় করে দর্শকদের বাহবা কুড়িয়েছিলেন। পতিতালয়ে জন্ম নেওয়া মাতা – পিতাহীন একটা মেয়ে নিজ যোগ্যতায় হয়ে উঠলেন কিংবদন্তি অভিনেত্রী। তবুও তিনি নিজেকে পরিচয় দিতেন বারনারী ও বারাঙ্গনা। একসময় থিয়েটার মালিক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী গুরমুখরায় বিনোদিনীকে একান্তে পেতে চাইলেন। কিন্তু বিনোদিনী ভালোবাসতো তার প্রেমিক জমিদার বাবুকে। গুরমুখরায় একদিন ঘোষণা দিলেন বিনোদিনী তার একান্তে না আসলে তিনি থিয়েটার বন্ধ করে দিবেন। অবশেষে থিয়েটারের জন্য ৫০ হাজার টাকা গ্রহন করে তার প্রেমিককে বাদ দিয়ে তিনি গুরমুখরায়ের বাংলোতে নিজেকে সঁপে দিলেন। থিয়েটারের জন্য। তারপর একে একে অভিনয়ে আসেন কিরণমালা,কুসুমকুমারী, নরীসুন্দরী,তারা সুন্দরী,কানন দেবী। এরা সবাই ছিলেন বারবনিতার সন্তান। অবশেষে ১৮৮১ সালে ঠাকুর বাড়ির কৃপায় বাংলা থিয়েটার বিকাশ লাভ করে। বাঙালির নাট্য জগতে আসে রুচিবোধ। যার সূচনা হয় রুপজীবিনীদের হাত ধরে।
এবার ঢাকার রুপালী জগতে আসা যাক। থিয়েটার কিংবা সিনেমার জন্য ঢাকার মাটি সুপ্রসন্ন ছিলনা। ঢাকায় প্রথম সিনেমা হল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৩-১৪ সালের দিকে যার নাম ছিল পিকচার হাউস। মাঝখানে এখানে সিনেমা প্রদর্শিত হতো। পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পর এর নাম হয় শাবিস্তান। কয়েক বছর পর ‘পিকচার প্যালেস’ নামীয় ঢাকায় আরেকটি সিনেমা হল প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এর নাম রুপমহল। দেশবিভাগের আগেই পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলা শহরে ৮০ টির বেশি সিনেমা হল স্থাপিত হয়। মুসলমানদের জন্য সৃষ্ট পাকিস্তান দেশে নায়িকা তো দূরের কথা নায়ক পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ছিল। কারণ ধর্মে সিনেমার কার্যক্রম হারাম বা বারণ। কলকাতায় অল্প সংখ্যাক যে কয়েকজন মুসলমান অভিনেতা ছিলেন তারাও নাম গোপন করে ভিন্ন নাম ধারণ করেছিলেন। যেমন, আতাউর রহমান পরিচিত ছিলেন পিনাকি নামে, ওবায়দুল হক ছিলেন হিমাদ্রি নামে,ফতেহ লোহানী ছিলেন কিরন কুমার আর আনোয়ারা বেগম ছিলেন বনানী চৌধুরী নামে। আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলা চলচ্চিত্র জগতের বিকাশ হয় ঢাকার নবাব পরিবারের হাত ধরে। সুকুমারী ছবিতে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন নবাব পরিবারের সন্তান খাজা নাসরুল্লাহ। অভিনেত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সৈয়দ আবদুস সোবহান নামে এক যুবক।
বাংলা চলচ্চিত্রের মহেন্দ্রক্ষণ ছিল ১৯২৯ সালে। নবাব পরিবার অর্থায়নে নির্মিত হয় ‘দ্য লাস্ট কিস’ নামক একটা ছবি। এই ছবির অভিনেত্রীদের জোগাড় করা হয় পতিতালয় থেকে। নায়িকার ভূমিকায় ছিলেন ললিতা নামক এক পতিতা। কালের পরিক্রমায় বাংলা সিনেমা ও নাটক আজকের অবস্থায় এসেছে। শুরুতে থিয়েটারে রুচিশীলেরা যেতেন। চরিত্রের অনিবার্যতায় নারী চরিত্র আবশ্যক হয়ে পড়ে। কিন্তু বিপত্তি ছিল অনেক। মঞ্চে নারীদের অভিনয় দেখার জন্য দর্শকরা প্রস্তুত ছিলনা। ভালো পরিবার তাদের মেয়েদের অভিনয়ে কঠোর ছিল। তাই আয়োজকরা বাধ্য হয়ে নিষিদ্ধ পল্লীর মেয়েদের অভিনয়ে নিয়ে আসতো। তৎকালীন সমাজ বাস্তবতা কেমন ছিল একটা উদাহরণে স্পষ্ট হবে। সমাজসংষ্কারক ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং শিবনাথ শাস্ত্রী মনে প্রানে নারীদের উন্নতি চাইতেন। তারা অভিনয় দেখতে পছন্দ করতেন। কিন্তু থিয়েটারে পতিতা-দের অভিনেত্রী হিসেবে আগমন হেতু তারা আর কোনদিন অভিনয় দেখতে থিয়েটারে যাননি।
আজকের বাংলা নাটক – সিনেমা বহু বিবর্তনের ফসল। ঠাকুর বাড়ির বধান্যতায় এবং ঢাকার নবাব পরিবারের কৃপায় আমরা পরিশীলিত বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে নাটক – সিনেমা পেয়েছি। নব্বইয়ের দশকে সিনেমায় আমারা পেয়েছিলাম একঝাঁক মেধাবী অভিনেতা – অভিনেত্রী। এদের অনেকই সমাজে প্রভূত সম্মান ও বুদ্ধিজীবির স্থান পেয়েছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা পণ্য বই বেশি কিছুনা। রূপজীবিরা তো মানুষ হিসেবেই স্বীকৃত নয়। সিনেমার সুবাদে রূপজীবিরা তাদের মেধার পরিচয় দিয়ে অন্ধকার গলি হতে আলোতে আসার চেস্টা করেছিল। সংখ্যায় কম হলেও বাংলা চলচ্চিত্রের অভিনয়ের পূর্ণতা তারাই দিয়েছিল। পরিতাপের বিষয় হলো, পূর্বে পতিতারা অভিনয়ে এসে ভদ্রসমাজে ঠাঁই করে নেওয়ার চেস্টা করতো মেধা ও যোগ্য দিয়ে, বর্তমানে অধিকাংশ মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা অভিনয়ে এসে নিজেদের নিয়ে যায় অন্ধকার জগতে।
আপনার মতামত জানানঃ