মোহাম্মদ রুবেল
ভারত ভাগের রগরগে বর্ণনা আর তৎকালীন নেতাদের কূটকৌশল ও সুন্দরী নারীর প্রভাব সম্বন্ধে জানতে হলে ধর্ণা দিতে হয় মওলানা আবুল কালাম আজাদ সাহেবের লিখা India Wins Freedom বইয়ে। নেহেরু ও তার পরকীয়া এবং এই প্রণয়ের প্রভাব ভারত ভাগের আগুনে ঘি ঢেলেছিল — এমন কাহিনি আজাদ সাহেব তার বইতে লিখে চারদিকে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। মজার বিষয় হলো, মওলানা সাহেব তার বইটা তার বন্ধু নেহেরুকেই উৎসর্গ করেছিলেন যখন নেহেরু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সাধারণ মানুষের জীবনে যখন পরকীয়ার পদ্ম ফোটে তা বড়জোর বিছানা পর্যন্ত গড়ায়, পক্ষান্তরে অসাধারণের বেলায় তা ইতিহাস সৃষ্টি করে। নেহেরু ও লেডি এডউইনার পরকীয়া প্রেম তেমনি ইতিহাস সৃষ্টি করা প্রণয়। নেহেরুর পরিচয় নতুন করে দেওয়াটা বোকামি, তবে লেডি এডউইনার সাথে পরিচিত হওয়া উচিত।
লর্ড পরিবারে জন্মগ্রহণ করা এডউইনার পিতা ছিলেন ব্রিটিশ এমপি এবং তার মা ছিলেন ধনী ইহুদি পরিবারের মেয়ে। ছোট বেলায় এডউইনা মাতাপিতা দুজনকেই হারালে নানার কাছেই বড় হন। এডউইনার বয়স ২০ বছর পূর্ণ হলে তার ধনী শিল্পপতি নানাজান তৎকালীন নগদ ২০ লাখ পাউন্ড ও লন্ডনের অভিজাত অঞ্চলে প্রাসাদোপম বাসস্থানের উত্তরাধিকার দান করেন। অপরুপ সুন্দরী এডউইনার মায়াবী সংস্পর্শ পেতে তৎকালীন ইউরোপের অভিজাত সুদর্শন কুমার জগতে প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে যায়, ঠিক গ্রীক সুন্দরী হেলেনের মতো। একথা সত্য, নারীর টাকা থাকলে পুরুষ অভাবের তাড়নায় তার আঁচল ধরে, শুধু রুপ থাকলে ধনীরা বিয়ে করে দাসী বানায়, আর টাকা – রুপ -কচি দেহ– এ তিনের সমাহার হলে সে জগতের ঈশ্বর হয়। এডউইনা সবকিছুর সমাহারে তৎকালীন ইউরোপের ঈশ্বর ছিলেন। অবশেষে একুশ বছর বয়সে এডউইনা বিয়ে করেন মহারানী ভিক্টোরিয়ার নাতনীর ছেলে মাউন্টব্যাটেনকে যার পিতৃকুল ছিলো জার্মান রাজবংশীয়।
মাউন্টব্যাটেন ছিলেন রাজকীয় নৌবাহিনীর অফিসার যার বার্ষিক বেতন ছিল ২০ হাজার পাউন্ড এবং ১৯৪৬ সালে তিনি সিঙ্গাপুরে মিএবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন এবং পরের বছর ভারতবর্ষের বড়লাট হন। স্বামীর সাথে ভারতে আসার পর সুদর্শন নেহেরুর পাণ্ডিত্যের কাছে এডউইনার রুপের ঝলক আর আভিজাত্য প্রথম দেখাতেই তার শ্রী চরণে লুটিয়ে পড়ে। উল্লেখ্য যে,ব্যাটেন- এডউইনা দম্পতির বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই সম্পর্কের পারদ দারুণ ভাবে নিম্নগামী হয়। তবে তারা বিয়ে ভেঙ্গে দেননি, একছাদের নিচেই ঘুমিয়ে ছিলেন ভিন্নভিন্ন কামরায়,জনতার সামনে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে মুচকি হেসে সম্পর্কের ধনাত্মকতা প্রমান করেছেন বারবার। মাউন্টব্যাটেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি সমকামী ছিলেন ও তার কোমরে ব্যাথা ছিল। আর এডউইনার সমস্যা ছিলো যৌন উশৃংখলতা। এডউইনার কন্যা পামেলা ২০১২ সালে তার স্মৃতিকথায় অকপটে স্বীকার করেন তার মায়ের সাথে নেহেরুর গভীর প্রেমের কথা এমনকি পরিবারের সবাই এ বিষয়ে জানতো। নেহেরুর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ জিন্নাহকে তার প্রেমের কিছু চিঠি প্রদান করা হলে জিন্নাহ সাফ জানিয়ে দিয়েছিল তিনি কারো ব্যাক্তিগত বিষয় নিয়ে রাজনীতি করবেননা।
আমরা সকলেই জানি শুরুর দিকে ভারত ভাগের তীব্র বিরোধী ছিলেন নেহেরু – গান্ধী – প্যাটেল। বৃটিশরা চালের গুটি হিসেবে বেচে নেয় নেহেরু এবং এডউইনার প্রেমকে।এডউইনার মায়াবী প্রেমের স্পর্শে নেহেরু ভারত ভাগে রাজি হয়ে গেলেন। গান্ধীজী সকলের নেতা হলেও নেহেরুর কূটকৌশলের কাছে তিনি ছিলেন নিচক পুতুল মাত্র। অনায়াসে ভারতকে ভাগ করতে নেহেরু রাজি করিয়ে ফেললেন গান্ধীকে। বাকী রইলো সর্দার প্যাটেল। ভারত ভাগে প্যাটেলের সমর্থন আদায় এক বিষ্ময়কর মজার ঘটনা ছিল যা নেহেরু – এডউইনার প্রেমের মহিমাকেও ম্লান করে দেয়। আগামীতে কোন এক পর্বে সেটা আনার চেস্টা করবো। পাকিস্তান রাস্ট্র চিরকালই একটা পরকীয়া প্রেমের কাছে ঋণী থাকবে।
দেশ বিভাগের সময় নেহেরুর মতোই আরেক কিংবদন্তি কংগ্রেস নেতা ছিলেন ‘সরদার বল্লবভাই প্যাটেল’। প্যাটেল ছিলেন প্রছন্ড একরোখা জাতীয়তাবাদী ও মুসলিম লীগ বিদ্বেষী। তিনি ভারত ভাগের তীব্র বিরোধী ছিলেন এবং তাকে কোন ভাবেই বাগে আনতে পারলেন না নেহেরু – গান্ধী। প্যাটেলের সমর্থন ছাড়া ভারত ভাগ প্রায় অসম্ভব ছিলো কারণ ভারতীয় কংগ্রেসের মাঠের রাজনীতিতে তার প্রভাব ও জনপ্রিয়তা অন্য যে কারো তুলনায় কম ছিলো না। ব্যাক্তি জীবনে প্যাটেলের চরিত্রে কোন কালো দাগ ছিল না, যা দক্ষিন এশিয়ার রাজনীতিবিদদের সবচেয়ে বড় পুঁজি। প্যাটেল মুসলিমলীগকে সবসময় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন এবং অবজ্ঞার চোখেই দেখতেন। কিন্তু রাজনৈতিক কূটকৌশলের কাছে তার নির্মম পরাজয় হলে তিনিও রাতারাতি কিবলা পাল্টিয়ে ভারত ভাগের বড় সমর্থকে পরিনত হন।দেখা যাক তিনি কিভাবে নিজের তৈরি গিলোটিনে তার মুন্ডু হারালেন।
পাকিস্তান রাস্ট্রের সৃষ্টি কোন মৌলভি- মোল্লা করেনি, করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কোট- টাই পরা নেতারা, যারা ব্যাক্তি জীবনে ধার্মিক ছিল বলে প্রমান পাওয়া যায় না। ভারত ভাগের সময় দেওবন্দ প্রধান মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি বলেছিলেন – পাকিস্তান সৃষ্টি হলে পাকিস্তানে ইসলাম মরে যাবে আর ভারতে ইসলাম মার খাবে। মাওলানা মওদুদি সাহেব তো পাকিস্তানকে ব্যাঙ্গ করে নাপাক পাকিস্তান বলতো।
ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বড়লাট সবদলের অংশ গ্রহণে একটা অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের আহ্বান জানালে ভারতীয় সকল প্রধান রাজনৈতিক দল এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানায়। অন্তবর্তীকালীন সরকার ঘটনের সময় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এতে ভারতের সব বড়দলের অংশ গ্রহন থাকবে এবং গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রনালয়গুলো কংগ্রেস ও মুসলিমলীগের মধ্যে ভাগ হবে। কিন্তু বড়লাট কর্তৃক নেহেরুকে অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান ঘোষিত হলে জিন্নার মুসলিমলীগ এ সরকারে যোগ দিতে অপারগতা জানায়।কংগ্রেস এসময় মুসলিম লীগকে সরকারে যোগ দিতে বারবার আহ্বান জানায় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার অঙ্গীকার করে। মুসলিম লীগ সরকারে যোগ না দিলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় সরদার বল্লবভাই প্যাটেলকে। ইতোমধ্যে মুসলিমলীগ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সরকারে যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে এবং লিয়াকত আলী খানকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া আহ্বান জানায়। এরমধ্যে প্যাটেল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে গেছেন এবং তিনি এ পদ ছাড়তে অপারগতা জানান।তিনি কংগ্রেসকে বুঝাতে সমর্থ হন, মুসলিম লীগকে সাইজ করতে হলে এই পদে তার কোন বিকল্প নেই। সুতরাং মুসলিম লীগকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া উচিত। প্যাটেল বরাবরই মুসলিম লীগ নেতাদের অশিক্ষিত ও মন্ত্রনালয় চালানোর অনুপযুক্ত মনে করতেন। তার বিশ্বাস ছিল অর্থ মন্ত্রণালয় চালাতে যে দক্ষতা প্রয়োজন তা মুসলিমলীগের কারো নাই।সুতরাং, মুসলিমলীগের নেতারা ব্যার্থ হয়ে আলাদা রাষ্ট্রের দাবি হতে সরে আসবে।
কিন্তু স্থুল বুদ্ধির প্যাটেল জানতেন না তৎকালীন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ে দুইজন ঝানু মুসলমান আমলা ছিলেন। সুচতুর জিন্নাহ সাহেব অঙ্ককষে দেখলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হতে অর্থ মন্ত্রণালয় কম গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং বেশি। তিনি মুসলিম দুই আমলার ওপর ভরসা করে লিয়াকত আলীকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিতে রাজি করালেন। প্রকৃত খেলা শুরু হলো তখন। কংগ্রেস খুশিতে আটখানা হয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সামনে হাজির হয়ে টাকার জন্য ধর্ণা দিলে সেটা আটকে দেওয়া হয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সকল ধরনের নতুন প্রস্তাব নাকচ হলো,বাজেটে ব্যাবসায়ের ওপর উচ্চ হারে কর ধরা হলে একচেটিয়া ধনী হওয়া উচ্চ বিত্তের হিন্দুরা মহা ফাঁফরে পড়ে।নতুন সরকারের কাছে পুলিশ প্রশাসন বেতন সহ নানাবিধ সুযোগ – সুবিধা দাবি করে বসলে প্যাটেল মহা সমস্যায় পড়ে যায়। অর্থ মন্ত্রনালয়ের দুই আমলার সহায়তায় আর জিন্নাহর নানাবিধ কুটিল বুদ্ধির আর্শিরবাদে লিয়াকত আলী খান কংগ্রেসকে একচ্ছত্র ক্ষমতার স্বাধ গ্রহন করার স্বপ্ন তাসের ঘরের ন্যায় চুরমার করে দেয়। একপর্যায়ে প্যাটেল চরমভাবে ব্যার্থ ও অপদস্থ হয়ে ভারত ভাগে রাজি হন।তিনি বুঝতে পারলেন দুই জাতির লোকজন কেউ কাউকে ছাড় দিবে না।
পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য অনেকেই জিন্নাহকে একচেটিয়া কৃতিত্ব দেন অথবা একচেটিয়া দোষারোপ করেন — যার কোনটাই সঠিক নয়। কবি ইকবাল সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলিম অঞ্চল তত্ত্ব উদ্ভাবন করলে জিন্নাহ সেটাতে রাজনৈতিক রং দেন। মুসলিম লীগ জিন্নাহকে একচেটিয়া সমর্থন দেন। পক্ষান্তরে এক সুন্দরী নারীর ছলাকলার মোহে রাজি হন নেহেরু, গান্ধীকে রাজি করান পন্ডিত নেহেরু, প্যাটেল দাবি মানতে বাধ্য হন আমলাদের নিষ্ঠুর কূটকৌশলের কাছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পেছনে দুই আমলা, গোলাম মোহাম্মদ যিনি পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ও গভর্ণর জেনারেল হয়েছিলেন এবং চৌধুরী মোহাম্মদ আলী যিনি পাকিস্তানের প্রথম সেক্রেটারি জেনারেল ও পরে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন — তাদেরকেও আমলে নেওয়া উচিৎ।
পাকিস্তান রাস্ট্রের সৃষ্টি কোন মৌলভি- মোল্লা করেনি, করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কোট- টাই পরা নেতারা, যারা ব্যাক্তি জীবনে ধার্মিক ছিল বলে প্রমান পাওয়া যায় না। ভারত ভাগের সময় দেওবন্দ প্রধান মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি বলেছিলেন – পাকিস্তান সৃষ্টি হলে পাকিস্তানে ইসলাম মরে যাবে আর ভারতে ইসলাম মার খাবে। মাওলানা মওদুদি সাহেব তো পাকিস্তানকে ব্যাঙ্গ করে নাপাক পাকিস্তান বলতো। আর মওলানা আজাদ তো বলেই দিলো এমন ভূতুড়ে দেশ টিকবে না। মুসলমানদের আলাদা আবাসভূমির উদ্যোক্তাদের হিন্দুরা ঠাট্টা করে পাকিস্তানের সমর্থক বলতো, আর জিন্নাহ ঘোষণা দিয়ে মধুর হাসি দিয়ে বল্লেন আমি হিন্দুদের দাবি মেনে নিলাম। এছাড়াও আবদুল জব্বার খান ও আবদুল গফফার খানদের ব্যক্তি জীবনের ও নির্বাচনী কৃপণতা পাকিস্তান সৃষ্টিকে গতি দান করে। আসলে রাজনৈতিক নেতাদের বধান্যতার বিপরীতমুখী চরিত্র হলো এরা একেক জন একেকটা সাপ। সর্দার প্যাটেল জেদি সাপ হলেও বিষহীন ছিলেন। বাকীদের প্রছন্ড বিষ থাকায় মানুষ তাদেরকে পূজো দেয়, কত রকম মহাকাব্য লেখে,দেবতা বানায়। বিষধর সাপদের মানুষ এড়িয়ে চলে বলে সাপগুলো বেঁচে যায় এমনকি দেবতার আসনে বসে।
দোহাইঃ
♦ India Wins Freedom, Maulana Abul Kalam Azad.
♦ Daughter of the Empire, Pamela Hicks.
♦ Freedom at Midnight, Collins,larry and Lapierre.
♦ Pakistan and Islamic Identity, Akbar S.Ahmed.
মোহাম্মদ রুবেল, ভিয়েনা
আপনার মতামত জানানঃ