মোহাম্মদ রুবেল
অনেক দিন পর জোনাকি বেগম গতকাল তসরিফ আনলেন। শুরুতেই বললেন তোমার কি যত্রতত্র মূত্র বিসর্জনের অভ্যাস আছে নাকি? এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেলো। মিনমিন করে বললাম, আমার এমন অভ্যাস নাই। জোনাকি বেগম ক্ষেপে বললেন তোর আছে, তোর চৌদ্দ গোষ্ঠীর আছে। কারণ, বাঙালি জাতির এমন অভ্যাস ঐতিহাসিক ভাবে প্রমাণিত। আমি বললাম হয়তো আছে; তবে বুঝিয়ে বললে বুঝতে পারতাম।
তিনি বললেন, তুমিতো সানমার্কো গির্জা দেখেছো। একটু পড়াশোনা করলে জানতে পারবে মহামারি প্লেগ রোগের কবল হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য দেবতার সন্তুষ্টির জন্য তৎকালীন ইউরোপের চিপাচাপায় সানমার্কোসহ হাজার হাজার গির্জা স্থাপিত হয়েছিল। অথচ, মহামারি প্লেগের সময় ইয়োরোপের মানুষের হাঁড়িতে ভাত ছিলনা, পরনের কাপড় ছিলনা। ধর্মগুরুরা চিন্তা করলো এই মহামারীকে পুঁজি করে টাকা পয়সা হাতানোর এটাই উত্তম পন্থা। ধর্মজীবিদের সমর্থনে রাজনৈতিক নেতারাও এগিয়ে এলো, কারণ অন্ধ বিশ্বাসী গবাদিগুলোই আবার রাজনৈতিক নেতাদের প্রশ্নবিহীন আনুগত্য কবুল করে নেয়। শুরু হয়ে গেলো যত্রতত্র মূত্র বিসর্জনের মতো যত্রতত্র গির্জা নির্মানের মহাযজ্ঞ। কথাগুলো তোমাকে বললাম হিন্দুদের পবিত্রস্থান চন্দ্রনাথ পাহাড়ে কিছু গবাদির মসজিদ স্থাপনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে। আর ঐসব গবাদিগুলোর সমর্থনে আরেক দল গবাদি আছে যারা ফেইজবুকীয় মুহাদ্দিস হয়ে জনমত ঘটনে প্রানান্ত চেষ্টা করছে। আমি বললাম মন্দিরের পাশে মসজিদ হলে সমস্যা কোথায়? একটা ধর্মনিরপেক্ষ দেশে মসজিদ-মন্দিরের সহাবস্থান সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারে। জোনাকি বেগম বললেন, তুমিও যে কখন এই গবাদিগুলোর মতো মাথামোটা হয়ে বেঁচে আছো তা আমার আগে জানা ছিলনা।
শোন মিয়া, পুকুরের একপাশে ঢিল মারলে আরেক পাশে এর ঢেউ আঘাত হানে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে মন্দিরের সমান্তরালে মসজিদ হলে ভারত-নেপাল-মিয়ানমার-ভুটান-শ্রীলঙ্কায় মসজিদের সমান্তরালে মন্দির গড়ে উঠবে। মূর্খ উগ্রধর্মান্ধরা উত্তেজিত হবে, দাঙ্গা করবে, সাধারণ গরীব মানুষ প্রাণ হারাবে, নারীরা বিপরীত ধর্মীয় পুরুষ কর্তৃক সম্ভ্রম হারাবে। তুমি নিশ্চয়ই বিহার ও নোয়াখালীর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাস পড়েছো। একটা কথা মনে রাখবে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলে মার খায় সাধারণ মানুষ, হিরো হয় ধর্মজীবি মোল্লা-পুরোহিতেরা, আর ফায়দা হাসিল হয় রাজনৈতিক নেতাদের। তাই মক্কা-মদিনায় যেমন মন্দির-গির্জার প্রয়োজন নেই তেমনি গয়া-কাশি অথবা ভ্যাটিকানেও অন্য ধর্মের উপাসনালয় হবে উস্কানিমূলক। আমি বললাম আপনার বক্তব্য আমি বুঝতে পেরেছি এবং এটি খন্ডনের হেকমত আমার নাই। এতে বাঙ্গালী জাতির কি দোষ? আপনি আমার চৌদ্দ গোষ্ঠীসহ বাঙালি জাতিকেই সবরিকলাযুক্ত দঁড়িতে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুঁলিয়ে দিলেন। জোনাকি বেগম বললেন, তোমার মনের ব্যাথা আমি বুঝি, তবে এজন্য আমি দুঃখিত নই। তোমার বোঝার স্বার্থে একটা রুপক গল্প বলি। মনযোগ দিয়ে শুনবে কিন্তু। আমি বললাম, আজ্ঞে।
শোন মিয়া, প্রতিটা মানুষ পৃথিবীতে জন্ম নেয় বাঘের বাচ্চার মতোই। কিন্তু সমাজে বিদ্যমান ভেড়াগুলোর সাথে থাকতে থাকতে সে-ও ভেড়া হয়ে যায়।
এক যুবক রাখালের একটা ভেড়ার পাল ছিল। রাখালের সমস্যা ছিল তার ভেড়ার পালে মাঝেমাঝে বন্য বাঘ হামলা করতো। বাঘের হামলা থেকে ভেড়ার পালকে রক্ষা করতে যুবক রাখাল একটা বল্লম বানালো। হঠাৎ একদিন বাঘ তার ভেড়াগুলোকে আক্রমণ করলে রাখাল ঐ বাঘটাকে বল্লম দিয়ে আঘাত করে। বাঘটি ছিল গর্ভবতী। আহত বাঘটা একটা বাচ্চা প্রসব করে মারা যায়। প্রাণীকূলের মধ্যে বাঘের বাচ্চা দেখতে খুবই সুন্দর। সুন্দর এই নবজাতক বাঘের বাচ্চা দেখে রাখালের খুবই মায়া হলো। রাখাল তার ভেড়ার পালের সাথে বাঘের বাচ্চাটিকে রেখে লালন পালন করতে লাগলো। দেখতে দেখতে বাঘটি বড়ো হয়ে গেলো আর রাখালের কালো চুল পেকে সাদা হয়ে গেলো। অর্থাৎ রাখাল বৃদ্ধ ও দূর্বল হয়ে গেলো।
একদিন একটা বন্য বাঘ রাখালের ভেড়ার পালে আক্রমণ করে বসলো। বৃদ্ধ দূর্বল রাখাল আগের মতো প্রতিরোধ করতে পারলোনা। তাই ভেড়াগুলো প্রাণপনে দৌড়ে পালাচ্ছিল। দেখার বিষয় হলো অন্যান্য ভেড়ার মতো রাখালের পালিত বাঘটাও দৌড়ে পালাচ্ছিল। আক্রমণকারী বাঘটি অবাক হয়ে নিজেকে প্রশ্ন করলো, ভেলাগুলো পালাচ্ছে প্রাণের ভয়ে, কিন্তু এই বাঘটা পালাচ্ছে কেন? তাই আক্রমণকারী বাঘটা রাখালের বাঘটাকে টার্গেট করে পিছু নিলো এবং তাকে ধরলো। আক্রমণকারী বাঘটি রাখালের পালিত্ বাঘটাকে বললো ভেড়াগুলো পালাচ্ছে প্রাণের ভয়ে মানলাম, কিন্তু তুই পালাচ্ছিস কেন? রাখালের বাঘটি বললো, আমি গত বিশ বছর যাবৎ এই ভেড়াগুলোর সাথে একসাথে ঘাস খাই। এর বেশি কিছু আর আমি জানি না।
জোনাকি বেগমের গল্পটি শুনে আমার দীর্ঘ হাসি পেলো। কিন্তু আদবের বরখেলাপ হবে বিধায় হাসি চেপে গেলাম। জোনাকি বেগম বললেন শোন মিয়া, প্রতিটা মানুষ পৃথিবীতে জন্ম নেয় বাঘের বাচ্চার মতোই। কিন্তু সমাজে বিদ্যমান ভেড়াগুলোর সাথে থাকতে থাকতে সে-ও ভেড়া হয়ে যায়। রাখালের বাঘের মতো সে-ও ঘাস খায়, এর চেয়ে সে বেশি কিছু বোঝেনা অথবা বুঝতেও চায়না। একইভাবে রাজনীতির লম্পটগুলো আর ধর্মজীবি জোঁকগুলো এদেরকে ভুলিয়ে দেয় বাঘের মতো মানুষেরও মেরুদণ্ড আছে। মাথায় আর পিঠে হাত বুলিয়ে আদায় করে নেয় বাঘের মতো দেখতে ভেড়ার পালের প্রশ্নবিহীন আনুগত্য। জোনাকি বেগম বললেন, বাঙালি জাতি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া কখনোই চিন্তা করতে পারেনি তারা মানুষ। বাকী সময়গুলোতে এরা কাঁঠাল পাতা খেয়েছিল, খাচ্ছে এবং খাবে।
মোহাম্মদ রুবেল, ভিয়েনা।
আপনার মতামত জানানঃ