আওয়ামী লীগের শরিক দলগুলো শুধু নয়, বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরাও নির্বাচনে জেতার নিশ্চয়তা চান৷ এমনকি যারা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করছেন, তারাও চাচ্ছেন জেতার নিশ্চয়তা৷
আর তাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতদিন ধরে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বলছেন, সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে৷ বিশ্লেষকেরা বলছেন, সবাইকে যদি জেতার নিশ্চয়তা দিতে হয় তাহলে নির্বাচন রূপ নেবে আনুষ্ঠানিতায়৷
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, “আমাদের সঙ্গে তো আওয়ামী লীগের সমঝোতা হয়েছে৷ আমরা নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করব৷”
কিন্তু সেখানে যদি আওয়ামী লীগের কোনো নেতা স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন, সেটা স্ববিরোধিতা হয়ে যাবে বলে মনে করেন জাসদ নেতা৷
তিনি বলেন, ‘‘সেই কারণে আমরা বলছি, আমাদের যে আসনগুলো দেয়া হবে, সেখানে আওয়ামী লীগের পদধারী কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে পারবেন না৷ এই কথাগুলো আমরা ১৪ দলের সমন্বয়ককে বলেছি৷ দু’এক দিনের মধ্যে একটা সমাধান হয়ে যাবে৷”
বিএনপিবিহীন এই নির্বাচনে শুরু থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বলছেন প্রধানমন্ত্রী৷ এখন প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো আসন সমঝোতার দিকে যাওয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোটের সম্ভাবনা মিলিয়ে যাচ্ছে৷ জয় নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগের মিত্র ও শরিক দলগুলো নৌকার সঙ্গে লড়াই নয়, ফাঁকা মাঠ চায়৷
সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও (জাপা) সরকারি দলের মুখোমুখি হতে রাজি নয়৷ আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও সরানোর শর্ত দিচ্ছে তারা৷ আবার নৌকার প্রার্থীরাও আগাম জয় নিশ্চিত করতে নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোটে চান না৷
সবাই যদি জেতার নিশ্চয়তা চায় তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কীভাবে হবে? জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আওয়ামী লীগ কীভাবে জেতার নিশ্চয়তা দেবে? আমরা তো কাউকে জেতার নিশ্চয়তা দিতে পারি না৷ জেতার নিশ্চয়তা দিতে পারে জনগণ৷”
নির্বাচন বিষয়ক আলোচনায় কাউকে জেতানোর নিশ্চয়তা দেয়া হয়নি বলেও জানান আওয়ামী লীগের এই নেতা৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা ১৪ দলের শরিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছি, এমনকি জাতীয় পার্টির সঙ্গেও বৈঠক করেছি৷ সেখানে কাউকেই জেতানোর নিশ্চয়তা দেয়া হয়নি৷ প্রধানমন্ত্রী যেটা বলেছেন, আমরা বৈঠকে সেই কথাই বলছি, ভোট করে জিতে আসতে হবে৷”
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপিবিহীন নির্বাচনে ১৫৪ এমপি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন৷ আওয়ামী লীগের ঘোষণা, ছিল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে৷ গত ৫ সেপ্টেম্বর বিবৃতিতে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, আগামী নির্বাচন হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ৷
গত ২৬ নভেম্বর আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মতবিনিময় সভায়ও একই আভাস দেওয়া হয়৷ এ কারণে নৌকা না পেয়ে বহু আসনে আওয়ামী লীগ নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন৷
কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া দলগুলো সাবেক বিএনপির এমপিসহ বহু আসনে প্রার্থী দিয়েছে৷ সরকার সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছোট দলগুলোও সর্বনিম্ন ৯ থেকে সর্বোচ্চ ২২১ আসনে প্রার্থী দিয়েছে৷ এই দলগুলোও ভোটে লড়ে জেতার পরিবর্তে, আসনের জন্য আওয়ামী লীগের দিকে তাকিয়ে আছে ছাড় পাওয়ার আশায়৷ কিংস পার্টিও আসনের জন্য আওয়ামী লীগের মুখাপেক্ষী৷
১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমাদের সঙ্গে এখনও আলোচনা চলছে৷ পুরো সিদ্ধান্ত হয়নি৷ আমরা বলেছি, আমাদের যে আসনগুলো দেওয়া হবে সেগুলোতে আওয়ামী লীগের কোন স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকতে পারবেন না৷”
তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে কীভাবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগের পদধারী স্বতন্ত্র প্রার্থী না থাকলেও তো আরও অনেক প্রার্থী আছেন৷ অনেকগুলো দল অংশ নিচ্ছে৷ তাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে৷ এখন প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য তো আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী লাগবে এমনটি নয়৷ সব আসনেও তো আর আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী নেই৷”
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিকেরা প্রকাশ্যেই আসন সমঝোতার দাবি তুললেও গোপন রেখেছে জাতীয় পার্টি৷ গত তিনবারের মতো আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আসন ছাড় চায় দলটি৷ আবারও প্রধান বিরোধী দল হতে আগ্রহী জাপা চায়, তাদের পছন্দের আসনে নৌকার প্রার্থী থাকতে পারবেন না৷ এমনকি, আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও থাকতে পারবেন না, যাতে বিনা বাধায় জিততে পারে লাঙ্গল৷
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জাপার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ৮৮ আসনের মধ্যে ৪২টিতে নৌকার প্রার্থী ছিল না৷ এর চারটি আসনে পরাজিত হয় ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও জেপির প্রার্থীদের কাছে৷ বাকি পাঁচটিতে হারে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে৷ গত নির্বাচনে জাপার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ১৭২ আসনের ১৪৫ আসনে নৌকার বিরুদ্ধে জামানত হারায় লাঙ্গল৷
এ অভিজ্ঞতার কারণে বছর দুয়েক ধরে সরকারের কড়া সমালোচনা করা জাপা ভোট মৌসুমে এসে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা চাইছে৷ গত বুধবার আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে গোপনীয়তা রক্ষা করে বৈঠক করেন দলটির নেতারা৷ সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগকে ৬০-এর বেশি আসনের তালিকা দিয়েছে জাপা৷ দলটির আরেকটি সূত্রের দাবি, ৭৫টি আসনের তালিকা দেয়া হয়েছে৷ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অবশ্য কোনো সিদ্ধান্ত দেয়া হয়নি৷ অনেকেই বলছেন, জেতার নিশ্চয়তা না পেলে শেষ মুহূর্তে জাপা নির্বাচন থেকে সরে যেতেও পারে৷ ফলে জাপার বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গে দেখছে আওয়ামী লীগ৷
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, “নির্বাচন মানে হচ্ছে ভোটাররা অনেক প্রার্থীর মধ্যে একজনকে বেছে নেবেন৷ কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দলগুলো যদি সমঝোতা করে ভোট করে, তাকে নির্বাচন নয়, তামাশা বলা যায়৷এখন যা পরিস্থিতি, তা নির্বাচন নয়, ভাগবাটোয়ারা চলছে৷ ভাগবাটোয়ারার নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে কিনা জানি না৷ তবে একটা জিনিস কিন্তু ভালো, আওয়ামী লীগ কোন রাখঢাক করছে না৷ যা হচ্ছে প্রকাশ্যেই হচ্ছে৷”
আপনার মতামত জানানঃ