‘ভার্জিনিয়া ক্যালকুলেটর’ খ্যাত টমাস ফুলার ১৭১০ সালে পশ্চিম আফ্রিকা (বর্তমান লাইবেরিয়া) এবং দাহোমি রাজ্য (আধুনিক বেনিন) এর ‘স্লেভ কোস্ট’ এর মধ্যে কোথাও জন্মগ্রহণ করেছিলেন। প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগে ফুলারকে ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল এবং ১৭২৪ সালে যখন তার বয়স ১৪ বছর তখন তাকে আমেরিকায় নিয়ে আসা হয়।
যদিও তিনি ইংরেজিতে পড়তে ও লিখতে জানতেন না, তবে ধারাবাহিকভাবে গণিতের জটিল জটিল সমস্যা সমাধান করে তার অসাধারণ শক্তি প্রদর্শন করতে থাকেন। উত্তর ভার্জিনিয়ার দুই চাষী, প্রিসলি এবং এলিজাবেথ কক্স, যারা উভয়ই “নিরক্ষর” ছিলেন, দ্রুত তার আশ্চর্যজনক ক্ষমতাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং তাদের ২৩২-একর খামার ব্যবস্থাপনার জন্য তার এই শক্তি ব্যবহার করতে থাকেন।
ফুলারের গণিত শিক্ষা
তার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের বেশিরভাগ সময় মাঠে দাস হিসাবে কেটেছে। সাধারণত এটা বিশ্বাস করা হতো যে ফুলার অবশ্যই পশ্চিম আফ্রিকাতে শিশু বয়সেই গণনা করা শিখেছিলেন।
এমনিতে ক্রীতদাসদের লেখাপড়ায় বারণ ছিল, তবে তিনি তার ক্ষমতা চারপাশের কাজেই ব্যবহার করতে থাকেন। যেমন গরুর লেজ, ফসল বা বীজ গণনার মাধ্যমে তিনি তার ক্ষমতাকে কাজে লাগাতে থাকেন।
মৌখিকভাবেই, তিনি জিনিসগুলো কত দূরত্বে ছিল তা গুণ করার একটি নতুন উপায়ও খুঁজে বের করেছিলেন। জটিল জ্যোতির্বিদ্যা-সম্পর্কিত গণনায় যা এখন কম্পিউটারের মাধ্যমে করা হয়।
‘বিস্ময়কর’ ফুলার
তার ব্যতিক্রমী গাণিতিক ক্ষমতার কারণে অনেক লোক তার মালিকদের কাছ থেকে ফুলারকে কিনতে চেয়েছিল। তবে তারা তাকে বিক্রি করতে রাজি হয়নি। ফুলার একজন দাসের চাইতে অধিক কিছু বলেই তাদের নিকট প্রতিয়মান হয়েছিল।
১৭৮০ সালে, ফুলারের বয়স যখন ৭০ বছর, তার অসাধারণ প্রতিভার কথা শুনে তখন কয়েকজন সহযোগীসহ একজন পেনসিলভানিয়া ব্যবসায়ী আলেকজান্দ্রিয়ায় তার সাথে দেখা করতে যান। কৌতুহলবশত তারা কয়েকটি প্রশ্ন করেন। এর মধ্যে দুটি উল্লেখযোগ্য ছিল: দেড় বছরে কত সেকেন্ড এবং ৭০ বছর ১৭ দিন ১২ ঘন্টা বয়সী একজন মানুষ কত সেকেন্ড বেঁচে ছিলেন?
তিনি দুটি উত্তর দুই মিনিটেরও কম সময়ে দিয়েছিলেন।
প্রথমটির জবাবে বলেছিলেন, দেড় বছরে ৪৭,৩০৪,০০০ সেকেন্ড ছিল।
দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবে বলেন, ৭০ বছর ১৭ দিন ১২ ঘন্টা বয়সী একজন মানুষ ২,২১০,৫০০,৮০০ সেকেন্ড বেঁচে ছিলেন।
একজন আপত্তি তুলেছিলেন। বলেছিলেন তার গণনা ভুল। তিনি সঠিক হিসাবের চেয়ে কম বলেছেন।
তখন ফুলার জবাব দিয়েছিলেন, আপনি বোধহয় লিপ ইয়ার ভুলে গেছেন!
পর্যবেক্ষক তখন আবার গণনা করেন এবং ফুলারের সংখ্যাই সঠিক বলে গ্রহণ করেন। ফুলারের গণনা করার এই আশ্চর্য ক্ষমতা সম্পর্কে তাদের পর্যবেক্ষণ একটি সংস্থায় জমা দেন তারা।
ফুলারকে নিয়ে আইনি লড়াই
ফুলারের অসাধারণ প্রতিভা যা করেছে তা হলো দেশটির জন্য অসাধারণ কিছু। ফুলার প্রমাণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল যে আফ্রিকানরা সাদা মানুষের মতো স্মার্ট। তিনি সম্ভবত জানতেন কী চলছে। তিনি মেধাবী এবং অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ ছিলেন। সুতরাং তিনি সম্ভবত এই কথাটি বলেছিলেন যে, বর্ণবাদ বিলুপ্তির আইনি লড়াইয়ে তিনি একটি সরঞ্জাম হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছেন।
মৌখিকভাবেই, তিনি জিনিসগুলো কত দূরত্বে ছিল তা গুণ করার একটি নতুন উপায়ও খুঁজে বের করেছিলেন। জটিল জ্যোতির্বিদ্যা-সম্পর্কিত গণনায় যা এখন কম্পিউটারের মাধ্যমে করা হয়।
ফুলার তার পরবর্তী বছরগুলোতে অনেক দর্শনার্থী পেয়েছিলেন, যাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন দার্শনিক, শিক্ষাবিদ এবং ডাক্তার। এই সমস্ত দর্শনার্থী উপস্থিত থাকতেন, তাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতেন, তাদের অনুসন্ধানগুলো লিখে রাখতেন, তারপরে দাসত্ব বিলুপ্তির জন্য তাদের কেস তৈরি করতে উত্তর রাজ্যে ফিরে যেতেন।
এই দর্শনার্থীদের মধ্যে একজন ছিলেন বেঞ্জামিন রাশ। আমেরিকায় মনোচিকিৎসার জনক হিসাবে বিবেচিত রাশ একজন চিকিৎসক এবং রসায়নবিদ ছিলেন। তিনি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের স্বাক্ষরকারীও ছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি দাসত্ব বিলোপের জন্য পেনসিলভেনিয়া সোসাইটির সেক্রেটারি ছিলেন।
বেঞ্জামিন রাশ দাসত্বকে বিলুপ্ত দেখতে চেয়েছিল। তিনি ভেবেছিলেন মামলায় লড়ার জন্য ফুলার একজন উপযুক্ত ব্যক্তি। দুর্ভাগ্যক্রমে, দাসপ্রথার সুবিধা ভোগকারী প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তি রাশের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগে। তারা দাসপ্রথাকে আইনিভাবে টিকিয়ে রাখার পক্ষে ছিলেন এবং এ বিষয়ে তখন ব্যাপক জনমতও গড়ে তোলেন।
তবে রাশ বরাবরই এ মানসিকতার বিরুদ্ধে ছিলেন। তাই রাশ তার মামলার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি হিসাবে ফুলারকে উপস্থাপন করেন। রাশের নিকট দাস-মালিক এবং দাসপ্রথার সুবিধাভোগী প্রভাবশালীদের কাছে ফুলারকে উপস্থাপণ করে তখন প্রমাণ করার দরকার ছিল যে, মালিকদের চেয়ে দাসেরাও কম বুদ্ধিমান নয়! তাই রাশ সিদ্ধান্ত নিলেন ফুলারকে নিয়ে তিনি যেসব লেখা লিখেছেন সেসবের মাধ্যমেই ফুলারের শক্তি প্রকাশ করবেন।
যেভাবে ছড়িয়ে পড়েন ফুলার
রাশের মাধ্যমে ফুলারের খবর প্রথম ছড়িয়ে পড়ে উত্তর রাজ্যগুলোতে। রাশের অনুসন্ধান ও ফুলারকে নিয়ে আরও অনেক লেখক, দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবীরাও পত্রিকায় লেখালেখি করতে থাকেন। এতে উত্তর রাজ্য ছাড়িয়ে দক্ষিণ রাজ্যেও ফুলারের খবর ছড়িয়ে পড়ে। দাসপ্রথা বিলোপ প্রত্যাশীরা দাসপ্রথার বিরুদ্ধে তাদের কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন।
এদিকে ফুলারের খবর বিদেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিবিদ এবং দার্শনিকরা ফুলার সম্পর্কে আলাপ তুলতে শুরু করেন। তারা তার বুদ্ধিমত্তাকে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের দাসত্বের বিরুদ্ধে একটি ‘কেস স্টাডি’ হিসাবে ব্যবহার করেছিল। সুতরাং, কয়েক বছরের মধ্যেই ফুলার একটি আন্তর্জাতিক প্রতিভা হয়েছিলেন।
ফুলারের মৃত্যু
ফুলার ১৭৯০ সালে আলেকজান্দ্রিয়া, ভার্জিনিয়ার কাছে কক্স ফার্মে মারা যান। তখন তার বয়স ছিল ৮০ বছর।
কলম্বিয়ান সেন্টিনেল, বোস্টন, ম্যাসাচুসেটস পত্রিকাগুলোতে ফুলারের মৃত্যুতে উল্লেখ করেছে: “এইভাবে ‘নিগ্রো টম’ মারা গেলেন, এই স্ব-শিক্ষিত গণিতবিদ, এই অশিক্ষিত পণ্ডিত!
পত্রিকাগুলো আরও বলে, তাকে কি তার হাজারো সহকর্মীর মতো উন্নতির সমান সুবিধা দেয়া হয়েছিল! লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি, প্যারিসের অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স, এমনকি নিউটন নিজেও তাকে ‘বিজ্ঞানের ভাই’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে লজ্জা পাওয়ার কি দরকার ছিল!
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০২
আপনার মতামত জানানঃ