Photo : Anandabazar
বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা থেকে : গত এক দশকের মধ্যে এ বছরই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে সর্বাধিক সংখ্যক বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার শিকার হয়েছে। বছর এখনো শেষ না হলেও এর মধ্যেই সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ৪৫ অতিক্রম করেছে। এ খবর লেখার সময় ২১ ডিসেম্বর বিকেলে লালমনিরহাটে বিএসএফ কর্তৃক গুলিবিদ্ধ একজন বাংলাদেশি মারাত্মক আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। তথ্য পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, চলতি বছর শুরুর দিকে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বেশি হলেও করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর তা আবার কমে আসে। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসের পর থেকে যেন ভারতীয় বাহিনীর মনোভাব ও দেহভঙ্গিই বদলে গেছে। চরম আগ্রাসী হয়ে উঠছে তারা। এই তিন মাসেই নয়জন বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করেছে বিএসএফ।
ভারত সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল দফায় দফায় বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও সীমান্তে হত্যা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মতে, ২০১৮ সালে যেখানে সীমান্তে হত্যার সংখ্যা ছিল ১১, সেখানে এ বছর ইতিমধ্যে তা চারগুণ ছাড়িয়ে গেছে। ভারত সরকারের ‘সবুজ সংকেত’ ছাড়া এভাবে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার কথা নয় বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। ভারত সরকার যেহেতু বাংলাদেশকে কৌশলগত বন্ধু হিসেবে তুলে ধরে, সেক্ষেত্রে সীমান্তে হত্যার নির্দেশ কে দিচ্ছে, কিংবা সেই হত্যা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে কে ভারত সরকারকে বাধা দিচ্ছে বাংলাদেশকে এটা খুঁজে বের করতে হবে বলে মনে করছেন তারা।
অনুসন্ধানে তথ্য মেলে, ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত রাকেশ আস্থানা বিএসএফের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা বেড়ে গেছে। দায়িত্ব পাওয়ার পর যদিও তিনি বিজিবি মহাপরিচালকের সঙ্গে আলাপে সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কার্যত ঘটেছে তার উল্টোটা। ভারতীয় বাহিনী এখন বাংলাদেশিদের নৃশংসভাবে আঘাত করছে বলে জানিয়েছেন উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলার মানুষরা। সরাসরি মুখমণ্ডলে গুলি চালানো থেকে শুরু করে মাথায় গুলির মতো ঘটনাও পাওয়া গেছে। এ ধরনের গুলি সাক্ষ্য দেয় যে, ভারতীয় বাহিনী আত্মরক্ষা বা পাচার ঠেকাতে গুলি করেনি, বরং চিহ্নিত ব্যক্তিকে তারা হিসাব-নিকাশ করেই গুলি করছে হত্যা বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে।
রাকেশ আস্থানা দায়িত্ব নেওয়ার সঙ্গে বাংলাদেশি হত্যার সম্পর্ক কী, তা খুঁজতে আমরা অনুসন্ধান চালাই ভারতে। পশ্চিমবঙ্গের কয়েকজন রাজনীতিকের সঙ্গে আলাপসূত্রে পুরো বিষয়টি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা মেলে। তারা জানান, নরেন্দ্র মোদির নিজের এলাকা গুজরাটের ছেলে এই রাকেশ। গুজরাট ক্যাডারের এই আইপিএস অফিসার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে পক্ষপাতদুষ্টের খেতাব পেয়েছেন বহুবার। আর তার এই পক্ষপাত ছিল বরাবরই হিন্দুত্ববাদী ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপির পক্ষে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উত্থানের সঙ্গেও জড়িত রয়েছে রাকেশের নাম।
২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গায় চরম নৃশংসতা ঘটেছিল যে সবরমতী এক্সপ্রেসে, সেই ঘটনার তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন রাকেশ আস্থানা। স্বাভাবিকভাবেই নরেন্দ্র মদি ও তার মিত্ররা নির্দোষ সাব্যস্ত হয়েছেন। তবে ২০১৮ সালে দুর্নীতির অভিযোগে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআই থেকে অব্যাহতি নিতে বাধ্য হওয়ার ঘটনায় রাকেশ আস্থানা বেশি আলোচনায় আসেন। তখন তার বিরুদ্ধে সরাসরি ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ এনেছিলেন সিবিআইয়ের আর এক ডিরেক্টর অলোক বর্মা। সিবিআই বনাম সিবিআই নামে পরিচিত এ মামলায় প্রশাসনে মোদি সরকারের অবৈধ হস্তক্ষেপের বিষয়ে নানা তথ্যপ্রমাণ উঠে আসে।
নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে বেছে বেছে বিরোধী দলের নেতাদের পিছনে সিবিআইকে কাজে লাগানোর অভিযোগ নতুন নয়। এ উদ্দেশ্যেই দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও আস্থাভাজন আইপিএস অফিসার রাকেশ আস্থানাকে সিবিআইয়ের বিশেষ পরিচালকের পদে বসান মোদী। কিন্তু আরেক পরিচালকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে রাকেশ সেখান থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হন। আস্থানাকে সিবিআইয়ে নিয়ে এসে তাকে অগুস্তা ওয়েস্টল্যান্ড কপ্টার দুর্নীতির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কপ্টার দুর্নীতিতে সোনিয়া গান্ধীর রাজনৈতিক সচিব অহমেদ প্যাটেলের নাম জড়িয়েছে। এ ঘটোনায় রাকেশ আস্থানার পদায়নের উদ্দেশ্যটা একেবারেই পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে।
মোদি সরকার শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়েছিল আস্থানাকে সিবিআইয়ে পুনরায় নিয়োগ দিতে। কিন্তু আস্থানার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে সিবিআইতেই এফআইআর দায়ের করিয়েছিলেন বর্মা। আস্থানা সেই এফআইআর খারিজ করতে দিল্লি হাইকোর্টে আবেদন করলেও লাভ হয়নি। হাইকোর্ট উল্টে দ্রুত সেই তদন্ত শেষ করার নির্দেশ দিয়েছে। ফলে ইচ্ছে থাকলেও আস্থানাকে সিবিআইয়ের নতুন ডিরেক্টর করার উপায় ছিল না সরকারের সামনে। এ অবস্থায় আস্থানা যেন হতাশ না হন, তাই তাকে ব্যুরো অব সিভিল এভিয়েশন ও নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরোর শীর্ষ পদে নিয়োগ দেয়া হয়।
অবশ্য আস্থানাকে নিয়ে দ্রুতই নতুন পরিকল্পনা সাজান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আস্থানাকে তিনি সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী বিএসএসফের ডিরেক্টর জেনারেলের দায়িত্ব দেন আগস্ট মাসের মাঝামাঝি। দায়িত্ব পাওয়ার পর গত ১৯ সেপ্টেম্বর বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের চার দিনব্যাপী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আস্থানা প্রতিশ্রুতি দেন যে, সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনা হবে। ২০১৮ সালের চুক্তি অনুযায়ী প্রাণঘাতি কোনো অস্ত্র সীমান্তে ব্যবহৃত হবে না এবং কোমরের ওপরে শরীরের কোথাও গুলি না চালানোর যে সমঝোতা আছে তাও ভারতীয় বাহিনী মেনে চলবে। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতির পর থেকেই বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর নৃশংসতা যেন আগের থেকে বেড়ে গেছে। রাকেশ আস্থানা দায়িত্ব নেয়ার পর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমার্ধেই বিএসএফের গুলিতে চারজন নিহত হন।
ভারতীয় সূত্রমতে, রাকেশ আস্থানা মোদি সরকারের একান্ত আস্থাভাজন। সরকারের পরিকল্পনা এবং দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নেই কাজ করছেন তিনি। সুতরাং সীমান্তে হত্যার পেছনে ভারতের বর্তমান মোদি সরকার দায় এড়াতে পারে না, কারণ এসব হত্যা বন্ধে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের শাস্তি দেয়া দূরে থাক, এমনকি জবাবদিহহিতাও চায় না তার নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার। বিজেপি নেতারা মনে করেন, ভারতে তাদের রাজনৈতিক বিকাশের জন্য বাংলাদেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রচার অব্যাহত রাখতে হবে। এতে বাংলাদেশ সরকার যেমন চাপে থাকে, তেমনি ভারতের অভ্যন্তরে জনপ্রিয়তা বাড়ে।
সমাজ বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাকেশ আস্থানার পদায়নের ফলে বিএসএফ নামক সীমান্তরক্ষী বাহিনীটিতে এক ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদের চর্চা হচ্ছে। ওই জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশিদের হীন চোখে দেখে। এ কারণেই এ ধরনের ‘নিচুস্তরের’ মানুষকে তাদের খুন করতে বাধছে না। এই জাতীয়তাবাদী প্রচারই মিয়ানমারের বাহিনীকে রোহিঙ্গাদের হত্যায় নৈতিক মনোবল জুগিয়েছিল। পাকিস্তানের রাজনীতিকরাও এরকম প্রচারে সাঁয় দিয়েছিলেন বিধায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালিদের ঘৃণার চোখে দেখেছে এবং সুযোগ আসা মাত্র পাইকারী দরে হত্যা চালিয়েছে। বিএসএফের ক্ষেত্রেও এখন সেটাই ঘটছে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহা. রুহুল আমীন সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘সীমান্ত হত্যার পেছনেও ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সন্দেহ রয়েছে। ভারত ছোট দেশকে সব সময় ছোট করেই রাখতে চায়। তাই সীমান্ত হত্যাসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধান হচ্ছে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক শুধু কাগজে কলমে। তাই ভারতের ক্ষমতাসীনদের মধ্যে বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।’
বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোঃ মইনুল ইসলাম বলেছেন, ‘কেবল রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তিই সীমান্তে হত্যার সংখ্যা হ্রাস করতে পারে’। গোটা দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা এ প্রশ্নে একমত যে, কেবল ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বাংলাদেশের সরকার বাধ্য করতে পারলেই সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা সম্ভব হতে পারে।
এসডাব্লিউ/এসএন/আরা/১৭০০
আপনার মতামত জানানঃ