দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম দেশ হিসেবে ভারত বরাবরই নিজের চারপাশে একটি নিজস্ব প্রভাব বলয় তৈরি করতে চেয়েছে, তাতে কোনও ভুল নেই। শুধু বিগত এক দশকের মধ্যেই তারা শ্রীলঙ্কার ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে বিরোধীদের একজোট করার চেষ্টা চালিয়েছে, নেপালের সংবিধান পছন্দ না হওয়ায় স্থলবেষ্টিত ওই দেশটিকে অবরোধের মুখে ঠেলে দিয়েছেন, কিংবা ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বাংলাদেশে গিয়ে কোনও রাজনৈতিক দলকে ভোটে অংশ নিতে বলেছেন, এমন দৃষ্টান্ত আছে অজস্র। বিবিসির খবর
বাংলাদেশে তো এমন একটা ধারণাও তৈরি হয়ে গেছে যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে আওয়ামী লীগ সরকার টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় রয়েছে, সেটা ভারতের সমর্থন ছাড়া কিছুতেই সম্ভব হত না।
এই পটভূমিতে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিঁকিয়ে রাখার জন্য দিল্লিতে গিয়ে তিনি ভারত সরকারকে অনুরোধ করে এসেছেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. কে. আবদুল মোমেনের এই মন্তব্যকে ঘিরে গত দু’দিন ধরে সঙ্গত কারণেই নজিরবিহীন তোলপাড় চলছে।
তবে ভারতও যে বাংলাদেশের ক্ষমতায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি বন্ধু সরকারকেই দেখতে চায়, সেটাও তারা কখনো গোপন করেনি।কিন্তু তারপরেও প্রশ্ন থেকে যায়, প্রতিবেশী দেশ হিসাবে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব বিস্তার করার বা হস্তক্ষেপের আদৌ কতটা ক্ষমতা আছে এবং সেটার কতটুকুই বা তারা প্রয়োগ করে থাকে?
তবে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা নিয়ে এই অঞ্চলে যে দেশটি চিরাচরিতভাবে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত তা নি:সন্দেহে বাংলাদেশ। গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত কীভাবে আর কতটা নাক গলিয়েছে, তা নিয়ে তর্কবিতর্কেরও যেন শেষ নেই।
দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্ক বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো শ্রীরাধা দত্তর মতে, প্রতিবেশী দেশে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চাইলেও ভারত সব সময় তা করতে পেরেছে তা কিন্তু নয়।
তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, “ঐতিহাসিক কারণেই হোক বা সমসাময়িক কোনও প্রয়োজনীয়তার নিরিখে, একটি বন্ধু দেশে একটি নির্দিষ্ট দলের সরকারকে দেখতে চাওয়াটা কিন্তু অস্বাভাবিক নয়।”
“হয়তো অন্য দলের শাসনকালে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাই সেখানে ফিরে যেতে চাওয়া হয় না। তাই বলে প্রতিবেশী দেশে তত বন্ধুত্বপূর্ণ সরকার ক্ষমতায় এলে ভারত মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, এমনও কিন্তু নয়,” বলছিলেন শ্রীরাধা দত্ত।
এই গবেষক বিশ্বাস করেন, অন্য একটি দেশে গিয়ে সে দেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার বা ফলাফলকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা যেমন ভারতের নেই, তেমনি অভিপ্রায়ও নেই।
“কিন্তু যে সরকারের সঙ্গে ভারতের অভিজ্ঞতা ভাল, যাদের আমলে ভালভাবে কাজকর্ম হয়েছে তারা ক্ষমতায় ফিরুক বা ক্ষমতায় থাকুক, এটা ভারত বরাবরই চেয়ে এসেছে,” বলছিলেন তিনি।
এই অঞ্চলের বাকি দেশগুলোর চেয়ে ভারত আকার, অর্থনীতি, জনসংখ্যা বা সামরিক শক্তিতে এতটাই এগিয়ে যে তাদের জন্য একটা হেজিমনিস্টিক বা আধিপত্যবাদী মনোভাব নিয়ে চলাটা খুব স্বাভাবিক আর তারা সেই চেষ্টাটা করেও।
তবে আমেরিকা যেভাবে সেন্ট্রাল আমেরিকার দেশগুলোতে সরকারের ওলটপালট ঘটাত কিংবা আজও চীন যেভাবে আশেপাশের এলাকায় ছড়ি ঘুরিয়ে থাকে, তার সঙ্গে কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ভূমিকার কোনও তুলনাই চলে না, বিবিসিকে বলছিলেন সাবেক সিনিয়র কূটনীতিবিদ ও প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ভাস্বতী মুখার্জি।
মিস মুখার্জির কথায়, “ভারতের ভূমিকা নিয়ে এই যে সব কথাবার্তা চলে আমি সেগুলো ‘মিথ’ বা ‘পারসেপশন’ও বলব না, বরং বলব ডাহা মিথ্যে কথা। এটা সত্যি হলে এই অঞ্চলে ভারত আরও অনেক ক্ষমতাশালী ভূমিকায় থাকতে পারত।”
শ্রীলঙ্কার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলছিলেন, শ্রীলঙ্কার চরম বিপদের সময় ভারত তাদের তেল, খাদ্যশস্য, আর্থিক ঋণ দিয়ে সাহায্য করেছে – অথচ সেই শ্রীলঙ্কাই ক’দিন বাদে ভারতের আপত্তি উপেক্ষা করে চীনা গুপ্তচর জাহাজকে হাম্বানটোটা বন্দরে ভিড়তে দিয়েছে।
বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেনের কথায়, “এই অঞ্চলের বাকি দেশগুলোর চেয়ে ভারত আকার, অর্থনীতি, জনসংখ্যা বা সামরিক শক্তিতে এতটাই এগিয়ে যে তাদের জন্য একটা হেজিমনিস্টিক বা আধিপত্যবাদী মনোভাব নিয়ে চলাটা খুব স্বাভাবিক আর তারা সেই চেষ্টাটা করেও।”
তবে তিনি সেই সঙ্গেই বিশ্বাস করেন, ভারত কোন দেশে সেটা কতটা করতে পারবে তা কিন্তু সেই দেশের ওপরেও বেশ খানিকটা নির্ভর করে।
তিনি বলছিলেন, মানে বলতে চাইছি, ওই দেশ ভারতের হস্তক্ষেপ কতটা গ্রহণ করবে সেটাও কিন্তু একটা ফ্যাক্টর। ভারত যেখানে বেশি ইন্টারেস্ট দেখাবে এবং যে দেশ সেটা ভারতকে বেশি করে করতে দেবে, বোঝাই যায় যে সেখানেই হস্তক্ষেপটা বেশি হবে|
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ লাইলুফার ইয়াসমিন মনে করেন, ২০২২ একটা আলাদা যুগ – ২০ বছর আগেও একটা দেশ যেভাবে অন্য দেশে হস্তক্ষেপ করতে পারত তা আজ আর সম্ভব নয়।
“বিংশ শতাব্দীতেও একটা দেশ যেভাবে অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখত, আজকের গ্লোবালাইজেশনের যুগে সেটা কিন্তু ওভাবে আর কাজ করে না,” তিনি বলছিলেন, আজকের বাংলাদেশেও ভারত কিছুতেই ওভাবে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।”
বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকার ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোকে দমন করতে যেভাবে সাহায্য করেছে, শুধুমাত্র ওই একটি কারণেই দিল্লি আওয়ামী লীগকে ঢাকায় আরও বহুকাল ক্ষমতায় দেখতে চাইবে, ভারতে বহু পর্যবেক্ষকই এ কথা বিশ্বাস করেন।
কিন্তু তার জন্য খুব বেশি হলে অর্থ বা রিসোর্সেস দিয়ে বন্ধুদের সাহায্য করা যেতে পারে, নৈতিক সমর্থন দেওয়া যেতে পারে – কিন্তু ভোটটা সেই দলকে নিজেদেরই জিতে আসতে হবে বলে তাদের অভিমত।
এই প্রসঙ্গে সাবেক কূটনীতিবিদ তৌহিদ হোসেন আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, “বাংলাদেশে ২০১৪র নির্বাচনে ভারত যে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছিল পাবলিক ডোমেইনেই তার প্রমাণ আছে।”
“আর ২০১৮তেও বাংলাদেশে কোনও সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হয়নি – এবং এদেশের বহু মানুষ বিশ্বাস করেন ভারতের আশীর্বাদ ছাড়া সেটা কিছুতেই সম্ভব ছিল না।”
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০০
আপনার মতামত জানানঃ