স্বামী হত্যার দায়ে ইরানে এই সপ্তাহে এক দিনের ব্যবধানে ৩ জন নারীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। শুক্রবার (২৯ জুলাই) নরওয়ে ভিত্তিক ইরান হিউম্যান রাইটস (আইএইচআর) এমন তথ্য জানিয়েছে। খবর এএফপির।
স্থানীয় সময় গতকাল শুক্রবার তিন নারীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কথা জানায় আইএইচআর। ইরানে নারীদের ফাঁসি দেওয়ার ঘটনা বাড়ছে। এতে উদ্বেগ জানিয়েছেন আইএইচআর।
আইএইচআর জানায়, ২৭ জুলাই ইরানে স্বামী হত্যার দায়ে ৩ নারীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। তারা তিনজনই তাদের স্বামীদের হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ছিলেন বলে জানা যায়।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে, অথবা অত্যাচারের শিকার হওয়ার কারণে নারীরা তাদের স্বামীদের হত্যা করছেন।
তারা আরও বলছেন, ইরানের প্রচলিত আইনগুলো নারী বিদ্বেষী হওয়ায় তারা তালাক নিতে পারেন না। এমনকি পারিবারিক সহিংসতা এবং নির্যাতনের ক্ষেত্রেও তাদের চুপ থাকতে হয়। ফলে বাড়ছে হত্যার মত ঘটনা।
নরওয়েভিত্তিক ইরান হিউম্যান রাইটস বলছে, ২৭ জুলাই তিন নারীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মধ্য দিয়ে এ বছরে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ১০ নারীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো।
এর আগে তেহরানের বাইরে একটি কারাগারে আফগান নাগরিক সেনোবার জালালিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। দেশটির পশ্চিমাঞ্চলের সানানদাজ শহরে একটি কারাগারে ফাঁসি দেওয়া হয় সোহেলি আবেদি নামের এক নারীকে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে সোহেলির বিয়ে হয়। বিয়ের ১০ বছর পর তিনি স্বামীকে হত্যা করেন। ২০১৫ সালে এ ঘটনায় তিনি দোষী সাব্যস্ত হন।
পাঁচ বছর আগে স্বামীকে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন ফারানাক বেহেস্তি নামের একজন নারী। তাকে উর্মিয়া শহরের উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলের একটি কারাগারে ফাঁসি দেওয়া হয়।
ইরানের আইনে চাইলেই নারীরা দেশটিতে বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারেন না। এমনকি নির্যাতনের শিকার হলেও নারীরা বিচ্ছেদ চাইতে পারেন না। গত বছর অক্টোবরে আইএইচআরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, ২০১০ থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত কমপক্ষে ১৬৪ নারীকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। আইএইচআরের হিসেবে এ বছরই ইরানে কমপক্ষে ৩০৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
সাবেক বিচারপতি ইব্রাহিম রাইসি ২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে ইরানে মৃত্যুদণ্ড বাড়ছে বলে উদ্বেগ জানিয়েছেন মানবাধিকারকর্মীরা। মানবাধিকার ইস্যুতে তার অতীত নিয়ে পশ্চিমারা সমালোচনা করে আসছে। ইরানের শীর্ষস্থানীয় যে কয়েকজনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তাদের মধ্যে রাইসি অন্যতম।
ইরানে সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনার জন্য সাম্প্রতিক সপ্তাহে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন ‘দেয়ার ইজ নো এভিল’ চলচ্চিত্রের পরিচালক মোহাম্মদ রসুলফ। ইরানে মৃত্যুদণ্ডের প্রতিক্রিয়া নিয়ে তার নির্মিত এই চলচ্চিত্র ২০২০ সালে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন বিয়ার পুরস্কার জেতে।
২৭ জুলাই তিন নারীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মধ্য দিয়ে এ বছরে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ১০ নারীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো।
সম্প্রতি একদিনে এক মহিলা-সহ ১২ জন বেলুচকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে ইরানে। দক্ষিণ-পূর্ব ইরানের জেল-বন্দি ওই ১২ কয়েদিকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
নরওয়ে-ভিত্তিক ইরান হিউম্যান রাইটস (আইএইচআর) বলেছে, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া ১২ জনের মধ্যে ১১ জন পুরুষ এবং একজন নারী। তারা মাদক সংক্রান্ত এবং হত্যার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন। সোমবার সকালে সিসস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশের রাজধানী শহর জাহেদানের প্রধান কারাগারে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এই প্রদেশটি আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী।
এনজিওটি আরও জানায়, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা সবাই বেলুচ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য যারা ইসলামের সুন্নি মতাদর্শের লোক ছিলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়ারা দেশটির আধিপত্যশীল গোষ্ঠী। স্থানীয় কোনো সংবাদমাধ্যমে এই মৃত্যুদণ্ডের খবর প্রকাশিত হয়নি এবং দেশটির কোনো কর্মকর্তা এই খবর নিশ্চিত করেননি।
এনজিওটি আরও জানায়, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা সবাই বেলুচ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য যারা ইসলামের সুন্নি মতাদর্শের লোক ছিলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়ারা দেশটির আধিপত্যশীল গোষ্ঠী। স্থানীয় কোনো সংবাদমাধ্যমে এই মৃত্যুদণ্ডের খবর প্রকাশিত হয়নি এবং দেশটির কোনো কর্মকর্তা এই খবর নিশ্চিত করেননি।
অধিকার কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরেই দেশটিতে জাতিগত এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সদস্যদের টার্গেট করে দেওয়া সামঞ্জস্যহীন মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। বিশেষ করে দেশটির উত্তরপশ্চিমের কুর্দিদের, দক্ষিণপশ্চিমের আরবদের এবং দক্ষিণপূর্বের বেলুচদের ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটছে।
আইএইচআর জানায়, তাদের সংগ্রহ করা তথ্যে দেখা যায় ২০২১ সালে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া বন্দিদের মধ্যে ২১ শতাংশ ছিল বেলুচ। অথচ ইরানের মোট জনসংখ্যার মাত্র ২ থেকে ৬ শতাংশ হলো বেলুচ।
২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুদণ্ড উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে বলে জানিয়েছে মানবাধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। বিশ্বে ২০২১ সালে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সংখ্যা ২০ শতাংশ বেড়েছে, একই সঙ্গে মৃত্যুদণ্ডের রায়ের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশ।
একই সঙ্গে সংস্থাটি বলেছে, ইরান ২০১৭ সাল থেকে রেকর্ডসংখ্যক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট থেকে আরও জানা যায়, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর বেড়ে যাওয়ার শীর্ষে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরান। সেখানে ২০২১ সালে ৩১৪ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়, এর আগে ২০২০ সালে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় ২৪৬ জনের, অর্থাৎ ২৮ শতাংশ বেড়েছে। দেশটিতে মাদক সংক্রান্ত মামলায় দোষী সাব্যস্ত ১৩২ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় যা মোট মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ৪২ শতাংশ এবং ২০২০ সাল থেকে পাঁচগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২১৫
আপনার মতামত জানানঃ