করোনা মহামারিতে মানুষের জীবন যাপন অনেকটাই কোণঠাসায় আটকে পড়েছে। দৈনন্দিন পরিকল্পনায় মানুষ আগের মতো স্বাভাবিকতা রাখতে পারছে না। দেশের অধিকাংশেরই আয় কমে গেছে, জীবন মানও নেমে গেছে অনেক। সংকটের ভেড়াজালে মানুষের কোনো রকম বেঁচে থাকাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরইমধ্যে গোঁদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো বাড়ছে দ্রব্যের মূল্য।
ভোজ্যতেল নিয়ে এখনও কারসাজি চলছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির দাম কমলেও সেই অনুপাতে দেশের বাজারে কমছে না। বিশ্ববাজার অনুযায়ী দেশে সয়াবিন ১২৪ টাকা লিটার হওয়ার কথা। কিন্তু সরকার দাম বেঁধে দিয়েছে ১৮৫ টাকা। বাস্তবে এ দামেও বাজারে সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না।
এছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটি আমদানিতে ভ্যাট ছাড়, এলসি কমিশন ও এলসি মার্জিন প্রত্যাহারের সুফলও ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছায়নি। ব্যবসায়ীরা এককভাবে এ সুবিধা নিয়ে মুনাফা করেছেন। এপ্রিলে এসব সুবিধা নিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটি আমদানি করেছেন বড় মিল মালিক ও আমদানিকারকরা। এতে দাম পড়ছে কম। কিন্তু বাজারে বিক্রি করছেন বেশি দামেই। বর্তমানে ডলারের দাম বৃদ্ধি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে সংকট চলছে। এর মধ্যেও এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী তেল নিয়ে ফায়দা লুটেই চলেছে।
দুই মাসের ব্যবধানে বিশ্ববাজারে সয়াবিনের দাম কমেছে ৩২ শতাংশ আর পাম তেলের দাম কমেছে ৪৮ শতাংশ। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশে তেলের দাম কমিয়েছে সরকার। যদিও এর প্রভাব এখনও পড়েনি বাজারে। খুচরা বাজারে এখনও আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে ভোজ্যতেল।
বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমায় গত ১৭ জুলাই বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটার প্রতি ১৪ টাকা কমিয়ে ১৮৫ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। এ দাম ১৮ জুলাই থেকেই কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আজতক নতুন দামে তেল বিক্রি হতে দেখা যায়নি। শুধু তাই নয়, সরকার নির্ধারিত দামে তেল কিনতে চাওয়া ক্রেতাদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়াতে দেখা গেছে বিক্রেতাদের।
রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার দোহাই দিয়ে দেশেও সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছিল। যা ২০৫ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের দাম কমলেও দেশি আমদানিকারকরা দাম কমানোর ক্ষেত্রে নানা অজুহাতে গড়িমসি করছিলেন। অতপর প্রথম দফায় প্রতিলিটারে ৬ টাকা কমিয়ে ১৯৯ টাকা এবং গত ১৭ জুলাই দ্বিতীয়বারের মতো ভোজ্যতেল আমদানিকারকদের সংগঠন প্রতিলিটারে ১৪ টাকা কমিয়ে প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম ১৯৯ টাকা থেকে কমিয়ে ১৮৫ টাকা নির্ধারণ করে। যা পরের দিন ১৮ জুলাই সোমবার থেকে কার্যকর করারও সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সিদ্ধান্তের চার দিন পরেও (বৃহস্পতিবার, ২১ জুলাই) এর প্রভাব বাজারে পড়েনি। এখনও আগের বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন তেল।
আজতক নতুন দামে তেল বিক্রি হতে দেখা যায়নি। শুধু তাই নয়, সরকার নির্ধারিত দামে তেল কিনতে চাওয়া ক্রেতাদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়াতে দেখা গেছে বিক্রেতাদের।
এ বছরের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় ভোগ্যপণ্যের মার্কেটপ্লেস যুক্তরাষ্ট্রের কমোডিটি এক্সচেঞ্জ শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম ওঠে ১ হাজার ৯৫০ ডলার। ওই সময় বাংলাদেশে এক ডলার কিনতে খরচ হত ৮৬ টাকা। সে হিসেবে প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১৫৩ টাকা।
ওই বাজারে গত ১৪ জুলাই প্রতি টন সয়াবিন বিক্রি হয় ১ হাজার ৩১৮ ডলারে। প্রতি ডলার ৯৩ টাকা ৯৫ পয়সা ধরে লিটারপ্রতি দর দাঁড়ায় ১১৩ টাকা। অর্থাৎ দুই মাসে বিশ্ব বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমেছে।
ক্যাবের তথ্যমতে, গত রমজানের ঈদের পর ৫ মে দেশে ভোজ্যতেলের দাম সরকার পুনঃনির্ধারণ করেছিল। ওই সময়ে সয়াবিনের দাম লিটার প্রতি ৩৮ টাকা বাড়ানো হয়েছিল। এরপর গত ৯ জুন মিল পর্যায়ে ভোজ্যতেলের নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে এক লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম মিলগেটে ১৮০ টাকা, পরিবেশক পর্যায়ে ১৮২ টাকা ও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৮৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম মিলগেটে ১৯৫ টাকা, পরিবেশক পর্যায়ে ১৯৯ ও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ২০৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এক লিটারের খোলা পাম অয়েলের (সুপার) দাম মিলগেটে ১৫৩ টাকা, পরিবেশক পর্যায়ে ১৫৫ ও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৫৮ টাকা করা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে তিন মাসের ব্যবধানে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম কমেছে ২০০ থেকে ৪৯০ ডলার। অথচ ব্যবসায়ীরা এক মাসে দু’দফায় প্রতি লিটার সয়াবিনের দাম বাড়িয়েছেন ৫১ টাকা।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৯ সালে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের গড় মূল্য ছিল টনপ্রতি ৭৬৫ ডলার। ২০২০ সালে দাম ছিল ৮৩৮ ডলার এবং ২০২১ সালে সয়াবিনের টনপ্রতি দাম ছিল ১৩৮৫ ডলার। কিন্তু, চলতি বছরের মার্চে একপর্যায়ে তা বেড়ে যায়। মার্চে বিশ্ববাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম হয় ১৯৫৬ ডলার।
বিশ্বব্যাংকের ইনডেক্স মুন্ডির তথ্য মতে গত ১৮ জুলাই পাম অয়েলের দাম কমে প্রতিটন বিক্রি হয়েছে ৮৬৬ ডলার ৭৫ সেন্ট, যা গত মে মাসে ছিল ১৭১৬ ডলার। সে হিসেবে পাম তেলের দাম কমেছে সাড়ে ৪৯ শতাংশ। সয়াবিন তেলের দাম একইদিনে কমে হয় ১ হাজার ৩২৪ ডলার ৫৪ সেন্ট। সে হিসেবে সয়াবিন তেলের দাম কমেছে প্রায় সাড়ে ৩২ শতাংশ।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, যখন বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তি ছিল তখন পণ্যটি আমদানিতে সরকারের পক্ষ থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার ছাড়াও বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর ওই সুবিধা নিয়ে আমদানি করা তেল দেশের বাজারে এলে দাম কমার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে দাম কমলেও সে অনুপাতে কমানো হয়নি। তাই ক্রেতারা এর সুফল পুরোপুরি পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, বিশ্ববাজারে দাম কমেছে সেটা সত্য। সে অনুপাতে দেশের বাজারেও কমানো হচ্ছে। কিন্তু যে হারে কমছে সে হারে কমানো সম্ভব হচ্ছে না। কারণ দেশে ডলারের দাম বেড়ে গেছে। এ ছাড়া এই দামের সঙ্গে জাহাজ ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ যুক্ত হয়। পাশাপাশি বন্দর দিয়ে এখন যেসব তেল আমদানি হচ্ছে, তার ঋণপত্র বিশ্ববাজারে চড়া দাম থাকার সময় খোলা হয়েছে, যা এখন বাজারের সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু গত কিছু দিন ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে বড় দরপতন হচ্ছে। সেসব তেল দেশে আসতে দেড় মাস সময় লাগবে। হয়তো তখন দাম সমন্বয় করে বিক্রি হবে।
ক্যাব ভাইস প্রেসিডেন্ট নাজের হোসাইন বলেন, সরকার তেলের দাম বাড়ালে সঙ্গে সঙ্গে বিক্রেতারা বাড়তি দর কার্যকর করে বিক্রি করে। আর সরকার দাম কমালে সঙ্গে সঙ্গে কমায় না। বিক্রেতারা নানা অজুহাত দিয়ে বাড়তি দরেই বিক্রি করে। এ সময়ও বিক্রেতারা বাড়তি মুনাফা লুটে নেয়। যা বন্ধ করতে হবে।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, বিদেশের বাজারে আজকে কোনো পণ্যের মূল্য বাড়লে তার প্রভাব দেশের বাজারে পড়তে অন্তত দুই থেকে আড়াই মাস লাগে। কিন্তু দেশি বাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা থেকে মনে হয়, আড়াই মাস পরে তো দূরের কথা, দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারে সেটি কার্যকর করা হচ্ছে। শুধু কার্যকর নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারের চেয়ে বেশি বাড়ানো হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫৯
আপনার মতামত জানানঃ