দেশে করোনাকালে যেসব খাতের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে, তার মধ্যে একটি হলো শিক্ষা। করোনা সংক্রমণ শুরুর দুই বছর পর এখন সেই চিত্র উঠে আসছে।
করোনাকালে দেশে দেড় বছর বন্ধ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গত বছর সেপ্টেম্বরে স্কুল খুললেও দেখা গেছে, অনেক শিক্ষার্থীই অনুপস্থিত রয়েছে। তবে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা বেশি উপস্থিত। গত বছর প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তির হারও কমেছে। তবে বেড়েছে বিভিন্ন ধরনের মাদ্রাসায় ভর্তির হার।
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টের (ব্র্যাক আইইডি) এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার ব্র্যাক সেন্টারে কভিড মহামারির কারণে স্কুল বন্ধ থাকাকালে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। একই অনুষ্ঠানে ব্র্যাকের ‘ব্রিজ স্কুলে’র কোর্স কতটা কার্যকর তা বোঝাতে আরেকটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করা হয়।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টের (আইইডি) উদ্যোগে গবেষণাটি করা হয়। এ গবেষণার জন্য গত বছরের জুন থেকে অক্টোবরের মধ্যে ৬১টি গ্রাম ও ৩৯টি শহর এলাকা ১১ হাজার ৯৯৯টি পরিবারের ওপর জরিপ চালানো হয়।
এতে প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার ৪ হাজার ৬৮৯ জন শিক্ষার্থী এবং ৩৯৮ জন শিক্ষক (প্রাথমিক ও মাদ্রাসা) অংশ নেন।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালে প্রাক্-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার ছিল ৬২ দশমিক ৭ শতাংশ এবং প্রাথমিকে ৯৬ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২১ সালে তা কমে হয় ৪৯ দশমিক ৬ এবং ৯৩ দশমিক ৬ শতাংশ। অর্থাৎ করোনার সময়ে (২০২১ সালে) প্রাক্-প্রাথমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ভর্তির হার কমেছে। অন্যদিকে একই সময়ে কওমি, হাফেজিয়া ও নূরানি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী ভর্তির হার বেশি ছিল। ২০২০ সালে মাদ্রাসায় ৫ বছরের শিশুদের ভর্তির হার ছিল সাড়ে ৮ শতাংশ। সেটি ২০২১ সালে বেড়ে হয় সাড়ে ৯ শতাংশ। এ ছাড়া ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুদের মধ্যে ২০২০ সালে মাদ্রাসায় ভর্তির হার ছিল ১১ শতাংশ। এক বছর পর (২০২১ সাল) তা বেড়ে হয় ১৪ দশমিক ১ শতাংশ।
মাদ্রাসার ভর্তি বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে যেসব বিষয় গতকালের আলোচনায় (গবেষণার তথ্য প্রকাশ অনুষ্ঠানে) উঠে এসেছে তার মধ্যে রয়েছে, করোনার সময় বিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও মাদ্রাসা খুব বেশি দিন বন্ধ ছিল না। অনেক অভিভাবক ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়ের পরিবর্তে মাদ্রাসায় ভর্তি করান। এ ছাড়া কয়েক বছর ধরে মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী ভর্তির হার বাড়ছিল। গ্রামাঞ্চলে বেসরকারি সংস্থা পরিচালিত বিদ্যালয়ের সংখ্যা আগের চেয়ে কমেছে। ফলে যেসব শিক্ষার্থী সরকারি বিদ্যালয়ের বাইরে থাকছে, তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মাদ্রাসায় গিয়ে ভর্তি হচ্ছে।
গ্রামাঞ্চলে বেসরকারি সংস্থা পরিচালিত বিদ্যালয়ের সংখ্যা আগের চেয়ে কমেছে। ফলে যেসব শিক্ষার্থী সরকারি বিদ্যালয়ের বাইরে থাকছে, তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মাদ্রাসায় গিয়ে ভর্তি হচ্ছে।
গবেষণাটি করেছেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টের প্রোগ্রাম হেড সমীর রঞ্জন নাথ। গবেষণায় তিনি উল্লেখ করেছেন, দীর্ঘ বন্ধ শেষে প্রাথমিক বিদ্যালয় চালুর পর প্রায় ৭৬ শতাংশ ছেলে ও প্রায় ৮৯ শতাংশ মেয়ে শ্রেণিকক্ষে ফিরে আসে।
গবেষণায় উঠে এসেছে পঞ্চম শ্রেণির ৮৪ দশমিক ৭ শতাংশ কখনোই টেলিভিশনের ক্লাস করেনি। অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে এ হার ৯৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এ বিষয়ে গবেষক সমীর রঞ্জন নাথ জানান, সরকার টেলিভিশনের মাধ্যমে ক্লাস নিয়েছিল। কিন্তু সেই কনটেন্টগুলো আকর্ষণীয় ছিল না।
অনুষ্ঠানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মুহিবুর রহমান বলেন, করোনা মহামারিতে শিখন ঘাটতি হয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। তবে আতঙ্কের কিছু নেই। এটা সারা বিশ্বেই হয়েছে। তিনি বলেন, সম্মিলিতভাবে কাজ করলে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
গবেষণার সুপারিশে বলা হয়, বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা কমে যাওয়া এবং প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও উপ–আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোকে আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। শিখন ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট সবাইকে কাজে লাগাতে হবে। সরকারের বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের মতো শিক্ষার ক্ষেত্রেও মেগা প্রকল্প প্রয়োজন।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বলেন, ‘মহামারি চলাকালে স্কুল বন্ধ হওয়ার কারণে শিক্ষার ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। পড়াশোনার ক্ষতি পুষিয়ে ঝরে পড়া এবং যাদের ঝরে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে সেসব শিশুকে ফিরিয়ে আনতে আমাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে মেয়ে, প্রতিবন্ধী এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের শিশুদের জন্য।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের ব্র্যাক ব্রিজ স্কুলের মডেল এবং ব্র্যাকের শিক্ষা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের করা গবেষণা প্রতিবেদনের ফল শিক্ষাব্যবস্থাকে ত্বরান্বিত করতে এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও ভালোভাবে গড়ে তুলতে নীতিনির্ধারক এবং অনুশীলনকারীদের উপকার করবে।’
করোনার কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা এবং অনেক অভিভাবকের আর্থিক অনটনের কারণে মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী বাড়ছে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা।
করোনার কারণে অনেক পরিবারে আর্থিক দুরবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এটাও মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী বাড়ার অন্যতম কারণ। এছাড়া সামাজিক নানা প্রেক্ষাপট তো রয়েছেই।
শিক্ষাবিদরা বলেন, ‘মূলত দুটি কারণে অভিভাবক তার সন্তানকে মাদ্রাসায় পড়াতে আগ্রহী হয়। একটি ধর্মীয় চিন্তা, অন্যটি আর্থিক অসংগতি। করোনার ফলে অনেক অভিভাবকের আর্থিক টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। এটাও মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী বাড়ার অন্যতম কারণ।’
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা দিনকে দিন কমছে। অবস্থা আশঙ্কা জনক বলে মনে করছেন শিক্ষকরা।
তারা বলছেন, এ প্রবণতা বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে শহরতলী ও গ্রামের স্কুলগুলোতে।
এর কারণ প্রসঙ্গে প্রাথমিকের একাধিক শিক্ষক নেতা জানান, করোনাকালে স্কুল বন্ধ থাকলেও মাদ্রাসা খোলা থাকা, প্রাথমিকে নিচের শ্রেণিতে ধর্মীয় পাঠ না থাকায় শিক্ষার্থীদের মাদ্রাসা গমনের প্রবণতা, পরিকল্পনা ছাড়া ও কোনোরূপ অনুমতি ব্যতিরেকে নুরাণী মাদ্রাসা গড়ে তোলা, অভিভাবকদের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে শিশুদের সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিমুখ করছে মাদ্রাসাগুলো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন স্কুল প্রধান শিক্ষক অভিযোগ করেন, করোনার অতিসংক্রমণকালে সব স্কুল বন্ধ করে কেবল হিফজ মাদ্রাসা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত ছিল। এ সুযোগে অন্যান্য মাদ্রাসাগুলো খোলা রেখে অভিভাবকদের প্রভাবিত করেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০২
আপনার মতামত জানানঃ