বাংলাদেশে প্রথম লকডাউন চালুর পর পার হয়েছে দুই বছর। শিশু অধিকার কর্মীরা বলছেন, দেশের হাজার হাজার শিক্ষার্থী আর বিদ্যালয়ে ফিরতে পারেনি, যাদের অধিকাংশের বয়স ১২ বা তার বেশি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সময়টায় দরিদ্র পরিবারের এসব সন্তান পুরোদস্তুর শিশুশ্রমিকে পরিণত হয়েছে।
২০২০ সালের মার্চে সরকার প্রথম যখন করোনা সংক্রমণ রোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন কেউই ভাবেনি এরপর ১৮ মাস স্কুল বন্ধ থাকবে। বাংলাদেশের এই শিক্ষাখাতের অচলাবস্থা পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম দীর্ঘতম স্কুল-কলেজ বন্ধের ঘটনা।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সশরীরে পাঠদান পুনরায় শুরু হলেও, ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট বিস্তারের কারণে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব আবারও বাড়লে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে টানা চার সপ্তাহ বন্ধ ছিল স্কুল।
আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে জানা যায়, জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক তহবিল ইউনিসেফ গত আগস্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশের শিশুরা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চরম ঝুঁকির মুখে পড়েছে। দেশগুলো হলো বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও ভারত। আর বিশ্বজুড়ে ৩৩টি দেশের প্রায় ১০০ কোটি শিশু এমন চরম ঝুঁকিতে পড়েছে।
এ বিষয়ে ইউনিসেফের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক আঞ্চলিক পরিচালক জর্জ লারইয়া-আজি বলেন, ‘এবারই প্রথমবারের মতো আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় কয়েক লাখ শিশুর চরম ঝুঁকিতে পড়ার সুস্পষ্ট তথ্য–প্রমাণ পেয়েছি।’ সংস্থাটির কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া বিশেষত খরা, বন্যা ও নদীভাঙন দক্ষিণ এশিয়ার লাখো শিশুকে গৃহহীন করেছে। তাদের প্রয়োজনীয় খাবার, স্বাস্থ্যসেবা ও সুপেয় পানির সংকটে ফেলেছে। অনেক ক্ষেত্রেই এসব শিশু বিদ্যালয় ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
নদীবিধৌত দেশ হওয়ায় বাংলাদেশে দুর্যোগ, বিশেষত ঝড়, বন্যা ও নদীভাঙনের ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু। তাই জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগে এসব শিশুকে খেসারত দিতে হয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের অনেকেই।
ইউনিসেফের তথ্যমতে, শহরের বস্তিতে থাকা বেশির ভাগ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায় না। আর দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় শিশুদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ আরও কম। সংস্থাটির গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রায় ১৭ লাখ শিশু নিষিদ্ধ ও ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। তাদের প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের বয়স ১১ বছর কিংবা তারও কম। অনেক মেয়েশিশু গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে। তাদের সঠিক তথ্য ও গল্প গবেষণায় যুক্ত করা কঠিন। তা করা হলে সংখ্যাটি আরও বাড়বে।
ঢাকা ও আশপাশের বস্তিতে বসবাস করা বেশির ভাগ শিশু ট্যানারি, লঞ্চইয়ার্ড, দরজির দোকান, অটোমোবাইল কারখানায় কাজ করে। অনেকে ফল ও সবজির বাজারে মাল টানা এবং বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট কিংবা রেলস্টেশনে কুলির কাজ করে। তাদের বেশির ভাগ দুর্যোগপ্রবণ বিভিন্ন জেলা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ঢাকায় এসেছে।
এদিকে গত বছরের বন্যায় দেশের ১০ জেলায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সংবাদমাধ্যম রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ তথ্য জানিয়েছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। তিনি জানান, ক্ষতিগ্রস্ত এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। পানি শুকানোর পর কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে সংস্কার করে ক্লাস নেওয়ার উপযোগী করা সম্ভব হয়েছে।
নদীবিধৌত দেশ হওয়ায় বাংলাদেশে দুর্যোগ, বিশেষত ঝড়, বন্যা ও নদীভাঙনের ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু। তাই জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগে এসব শিশুকে খেসারত দিতে হয়
বন্যার কারণে দীর্ঘ সময় দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় বিদ্যালয়ের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। কেননা এসব এলাকায় বিদ্যালয় ভবন দুর্যোগে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া করোনা মহামারির কারণে শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ সময় বিদ্যালয়ে যেতে পারেনি। এর মধ্য ঝরে পড়েছে বিদ্যালয়গামী অনেক শিশু।
প্রাথমিক বিদ্যালয়সংক্রান্ত বার্ষিক শুমারিতে গত বছর বলা হয়েছে, দেশে ৬৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। আর শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক কোটির বেশি। কিন্তু গত বছর বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার হার ১৭ শতাংশের বেশি। সংখ্যার হিসাবে ২০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনার পাট চুকিয়েছে।
এক বছরে এত পরিমাণ শিশু বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার পেছনে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম বলেছেন, ঝরে পড়ার এ হার উদ্বেগজনক। অস্বীকার করার উপায় নেই, এটার পেছনে বড় একটি কারণ জলবায়ু পরিবর্তন।
আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম আরও বলেন, গত বছরের বন্যায় দেশে পাঁচ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হলে দীর্ঘ সময় শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে যেতে পারেনি। এ সময় ঝরে পড়া শিশুদের অনেকে আর বিদ্যালয়ে ফিরবে না। এসব শিশু পরিবারের আয় বাড়াতে বিভিন্ন কাজে যুক্ত হয়ে পড়েছে।
এ ছাড়া করোনা মহামারিতে দেশে ১৪ হাজারের বেশি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এ তথ্য জানিয়েছেন বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর সংগঠনের চেয়ারম্যান ইকবাল বাহার চৌধুরী। তিনি বলেন, সাময়িক বন্ধ হয়ে যাওয়া এসব বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন বিঘ্নিত হয়েছে।
ইউনিসেফ ও ইউনেসকোর যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে মহামারির কারণে শিক্ষাজীবন বিঘ্নিত হওয়া বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ।
মহামারির কারণে স্কুল প্রথম বন্ধের সময় কিন্তু অবস্থা এতোটা খারাপ ছিল না। তারপর একদিন শুরু হলো লকডাউন। যত দিন যায়, কর্মজীবী এলাকার মানুষের আর্থিক সামর্থ্য ততো কমতে থাকে।
বাংলাদেশে যখন মহামারি প্রথম আঘাত হানে, তখন নাগরিক ও সুশীল সমাজের বেশিরভাগের উদ্বেগ ছিল কন্যা শিশুদের নিয়ে। কারণ, অভাব-অনটনের কারণে বহু পরিবার অল্পবয়সী কন্যাদের বাল্যবিবাহ দেয়। সংসারে অন্নের মুখ কমানোর এ চেষ্টায় অনেক মেয়ের বিয়ে হয় দ্বিগুণ বা তিনগুণ বয়সী পুরুষের সাথে।
‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’-এর এক জরিপে লকডাউনের প্রথম ছয় মাসেই বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চলে প্রায় ১৪ হাজার বাল্যবিবাহ রেকর্ড করা হয়। এসব কন্যাশিশুদের অন্তত অর্ধেকের বয়স ছিল ১৩-১৫ বছর।
বাংলাদেশে সার্বিকভাবে মাধ্যমিক শিক্ষা অবৈতনিক নয়। শিক্ষার্থীদের বার্ষিক বেতন দিতে হয় গড়ে ৩ হাজার টাকা (৩৫ ডলার)। অথচ মহামারির আগেই দেশে প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে একজনের দৈনিক আয় ছিল এক দশমিক ৯০ ডলারের চেয়েও কম। তার ওপর রয়েছে লাগাতার মূল্যস্ফীতি। গত দুই বছরে স্টেশনারি পণ্য, পাঠ্যপুস্তক বা ইউনিফর্মসহ সব শিক্ষাপণ্যেরও দাম বেড়েছে।
নারী শিক্ষায় যেন দেশ পিছিয়ে না পড়ে, সেজন্য উপবৃত্তি বা ভাতা দেয় সরকার। ১১-১৬ বছরের কন্যাশিশুরা স্কুলে পড়লে, বছরে তারা উপবৃত্তি ও বিদ্যালয়ের বেতনে সরকারের দেওয়া ভর্তুকিসহ গড়ে সাড়ে তিন হাজার টাকা (৪০ ডলার) পায়। এভাবে বাল্যবিবাহ কমাতেও সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। অনেক পরিবার এখন তাদের মেয়েদের স্কুলে রাখতেই বেশি আগ্রহ দেখায়।
সে তুলনায় ছেলে সন্তানদের কথা এখন অনেকটা আলাদা। ব্র্যাকের শিক্ষা-বিষয়ক পরিচালক সাফি খান বলেন, “সে তুলনায় কিন্তু ছেলে শিশু যেসব পরিবারে রয়েছে, তাদের কাছে শিক্ষার ব্যয় একটি বড় দুশ্চিন্তা। পরিস্থিতি বেশ নাজুক হলেও, সে তুলনায় তেমন সহায়তার উদ্যোগ নেই।”
লকডাউনের সময় ব্যবসা-বাণিজ্যের মন্দা, জনজীবনে স্থবিরতা প্রান্তিক ব্যবসায়ী ও খেটেখাওয়া মানুষের জীবন সংগ্রামকে কঠিনতর করে তোলে। আর তখনই ছেলে শিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া শুরু হয় বলে মন্তব্য করেন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা- আইএলও’র বাংলাদেশ শাখার পরিচালক তুমো পৌতিয়ানিয়েন।
“এই অবস্থায় লিঙ্গের কারণেও পার্থক্য তৈরি হয়েছে। স্কুল বন্ধ হওয়ার পর বেশিরভাগ দরিদ্র মানুষ তাদের কন্যাদের কাজে পাঠানো নিরাপদ মনে করেনি, সে তুলনায় ছেলে সন্তানদের কাজে পাঠানো তাদের কাছে খুব দরকারি আয়ের উৎস হিসেবে গণ্য হয়।”
বিশেষজ্ঞরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এখনই। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব উপকূলীয় অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, যেখানে শিশুদের ওপর এর প্রভাব বেশি মারাত্মক। বৈশ্বিক এই সংকট মোকাবিলায় সরকারি-বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর একযোগে কাজের কোনো বিকল্প নেই। সরকারের পাশাপাশি আমরা যদি সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করি, তবেই সম্ভব সব দুর্যোগ মোকাবিলা করে শিশুসহ সবার নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে জলবায়ু বিপর্যয়ের অনেক সাধারণ চিহ্ন রয়েছে। তবে সবকিছুকে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত করা যাবে না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাঁধ ভেঙে গেছে বলার চেয়ে বাঁধটি সঠিকভাবে নির্মাণ হয়েছিল কিনা, তা দেখা গুরুত্বপূর্ণ। দেশের কিছু জেলায় কোনো না কোনো কারণে শিশুদের সুরক্ষা দুর্বল। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তা আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। শিশুদের সুরক্ষার জন্য সেসব এলাকায় আরো মনোযোগ দিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১৬
আপনার মতামত জানানঃ