রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের আত্মীয় পরিচয়ে বিনা টিকিটে ট্রেনে ভ্রমণ করার অপরাধে ৩ যাত্রীকে জরিমানা করেছিলেন ট্রাভেলিং টিকিট এক্সামিনার (টিটিই)। গত বৃহস্পতিবার(০৫ মে) রাতের এ ঘটনার পর ওই টিটিইকে মুঠোফোনে বরখাস্ত করার কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। সাময়িক বরখাস্ত আদেশে তার বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ আনা হয়েছে বলে রেল সূত্রে জানা গেছে।
বরখাস্ত হওয়া টিটিই হলেন মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি পশ্চিম রেলের সদর দপ্তর ঈশ্বরদীতে সংযুক্ত।
পশ্চিমাঞ্চলীয় বিভাগীয় রেল দপ্তর জানায়, বৃহস্পতিবার রাতে ঈশ্বরদী থেকে আন্তঃনগর সুন্দরবন এক্সপ্রেসের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনে ওঠেন তিন যাত্রী। চেকিং-এর সময় কর্তব্যরত টিটিই শফিকুল ইসলাম তাদের টিকিট দেখতে চাইলে টিকিট নেই জানিয়ে তারা নিজেদের রেলমন্ত্রীর আত্মীয় বলে পরিচয় দেন।
এ অবস্থায় বিষয়টি পাকশী বিভাগীয় রেলের সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (এসিও) মো. নুরুল আলমের সঙ্গে কথা বলে রেলমন্ত্রীর আত্মীয়দের সর্বনিম্ন ভাড়া দিয়ে টিকিট কাটার পরামর্শ দেন টিটিই। তিনি ওই তিন যাত্রীকে এসি টিকিটের পরিবর্তে মোট ১ হাজার ৫০ টাকা নিয়ে জরিমানাসহ সুলভ শ্রেণির নন এসি কোচে সাধারণ আসনের টিকিট করে দেন। এ সময় ট্রেনে কর্তব্যরত অ্যাটেনডেন্টসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রেল কর্মকর্তা জানান, ওই তিন যাত্রী তাৎক্ষণিকভাবে লিখিত কোনও অভিযোগ না দিলেও তারা ঢাকায় পৌঁছে রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে টিটিই শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে অসদাচরণের মিথ্যা অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগ পেয়ে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) নাসির উদ্দিন সংশ্লিষ্ট টিটিইকে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ দেন। এ নিয়ে রেল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে।
বরখাস্ত আদেশের বিষয়টি ঈশ্বরদীর টিটিই হেডকোয়ার্টারের ভারপ্রাপ্ত সিনিয়র টিটিই মো. বরকতুল্লাহ আলামিন ফোনে শুক্রবার শফিকুল ইসলামকে জানান। সে সময় তিনি সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনে ডিউটিতে ছিলেন।
শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বিনা টিকিটে ট্রেনে ভ্রমণ করা ওই তিন যাত্রীর কাছে টিকিট দেখতে চাইলে তারা রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দেন। পরে তাদের এসি কামরা থেকে শোভন কামরার টিকিট দেওয়া হয়। এই অপরাধেই আমাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।’
তবে টিটিই শফিকুল ইসলাম বলেছেন, তিনি ওই তিন যাত্রীর সঙ্গে কোনো অশোভন আচরণ করেননি।
বিনা টিকিটে ট্রেনে ভ্রমণ করা ওই তিন যাত্রীর কাছে টিকিট দেখতে চাইলে তারা রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দেন। পরে তাদের এসি কামরা থেকে শোভন কামরার টিকিট দেওয়া হয়। এই অপরাধেই আমাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে বাণিজ্যিক কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন বলেন, ‘ঘটনার বিষয়ে লিখিত অভিযোগ ছিল না। তবে সুন্দরবন ট্রেনে বিনা টিকিটে ভ্রমণকারী তিন যাত্রীর সঙ্গে কর্তব্যরত টিটিই অসদাচরণ করেছেন বলে তারা রেলওয়ের মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ফোন করে অভিযোগ দেন। বিষয়টি আমাকেও অবহিত করা হয়। ওই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে টিটিই শফিকুল ইসলামকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে’।
তিনি আরো জানান, আজ শনিবার তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের রির্পোট পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দিয়ে বিনা টিকেটে রেল ভ্রমণ করা এবং তাদেরকে জরিমানা করার কারণে রেলের একজন কর্মীকে শাস্তি দেয়ার একটি খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হবার পর রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বলছেন, ওই তিনজন তার আত্মীয় কিনা, তা তিনি জানেন না।
রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, ওদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। নাম ভাঙিয়ে কেউ হয়তো সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। ঘটনার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।
শনিবার (৭ মে) গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে মন্ত্রী এমনটা দাবি করেছেন।
নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, ঘটনাটি শনিবার সকালেই শুনেছি। রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানতে পেরেছি, ওই টিটিই বিনা টিকিটের যাত্রীদের সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ আচরণ করেছেন। সে কারণেই তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
রেলের দাপ্তরিক কার্যক্রমের সঙ্গে মন্ত্রীর কোনো সংযোগ নেই জানিয়ে নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, ঘটনার সঙ্গে আমার কোনো আত্মীয় জড়িত নন। রেল কর্মকর্তারা ওই টিটিই’র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না।
রেলমন্ত্রী বলেন, মাঝেমধ্যেই টিটিইরা বিভিন্নভাবে যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন, বিভিন্নভাবে হেনস্তা করেন। এমন অভিযোগ আমরা প্রায়ই পাচ্ছি। তবে লোকবল সংকটের কারণে আমরা এসবের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারি না। তবে একেবারেই ছাড় দিলে রেলের দুর্নাম হয়ে যায়। তাই টিটিইদের বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
রেলমন্ত্রী বলছেন, যাত্রীদের কাছ থেকে ‘অসাদাচরণের’ লিখিত অভিযোগ পেয়ে ওই রেলকর্মীকে বরখাস্ত করা হয়।
তিনি বিবিসিকে বলেছেন, বাংলাদেশ রেলওয়েতে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন বরখাস্ত হওয়া টিটিইর বিরুদ্ধে যাত্রীর সঙ্গে ‘অসদাচরণ’ করা হয়েছে এমন লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষাপটে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিয়েছে। এক্ষেত্রে মন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয়ে বিনা টিকেটে ভ্রমণ করা কাউকে জরিমানা করার অপরাধে কাউকে ‘সাসপেন্ড’ করা হয়েছে, বিষয়টি তেমন নয় বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
তিনি বলেছেন, আমি রেলওয়েতে খবর নিয়ে জেনেছি, তা হলে ওই টিটিই’র বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন যাত্রী যে তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে, এবং ইয়ে করেছে..। লিখিত কমপ্লেইনের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিয়েছে রেলওয়ে। এখন হতে পারে টিটিইর যে অপরাধ সেটা থেকে সে নিজেকে সেভ করার জন্য এটা বলতেছে’।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেখা যাচ্ছে, ঈদের সরকারি ছুটির মধ্যে যে রাতে ‘অসদাচরণের’ ঘটনা ঘটেছে, তার পরদিনই লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে এবং ওই অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওই রেলকর্মীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশে সাধারণ কোন নাগরিকের কোন একটি অভিযোগের জেরে একজন সরকারি কর্মচারীকে এত দ্রুততম সময়ের মধ্যে শাস্তির আওতায় আনার ঘটনা একেবারেই বিরল। সেখানে ঈদের মতো ব্যস্ততম সময়ে এত দ্রুত টিটিইর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো গোপন কোন প্রভাবের বলয়ে?
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৫৬
আপনার মতামত জানানঃ