মাদ্রাসার শিক্ষক কর্তৃক মাদ্রাসার ছাত্র ছাত্রীদের ধর্ষণের অভিযোগ প্রায় নিয়মিত খবরে দাঁড়িয়ে গেছে। মাদ্রাসার কোমলমতি শিশুদের এহেন ধর্ষণে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে দেশ। মাদ্রাসা ও মাদ্রাসা শিক্ষকদের নিয়ে মানুষের মনেও জন্মেছে নেতিবাচক মনোভাব। এসব খবরের মধ্যে ইতিমধ্যে শোনা গেলো গভীর রাতে মাদ্রাসার সিসিটিভি ক্যামেরার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ছাত্রদের নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার এক মাদ্রাসা শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
পুলিশ জানিয়েছে, অভিযুক্ত শিক্ষক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ায় তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
সোনাগাজী মডেল থানার ওসি মোহাম্মদ খালেদ হোসেন দাইয়ান গণমাধ্যমকে এসব তথ্য জানান।
তিনি জানান, অভিযুক্ত শিক্ষকের নাম মোস্তাকিম বিল্লাহ ধর্মপুরী। সে সোনাগাজী উপজেলার মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদ্রাসা ও এতিমখানার হেফজ বিভাগের শিক্ষক। তার বাড়ি নোয়াখালীর সদর উপজেলার ধর্মপুর ইউনিয়নের ধর্মপুর এলাকায়।
গত শনিবার ১৪ বছরের এক ছাত্রকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে সোনাগাজী মডেল থানা পুলিশ তাকে মাদ্রাসা থেকে গ্রেপ্তার করে। পরে মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদের সহসভাপতি হুমায়ুন কবির বাদী হয়ে মোস্তাকিম বিল্লাহকে আসামি করে সোনাগাজী মডেল থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা করেন।
মামলার পর গত রোববার ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফারহানা লোকমানের আদালতে তিনি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয় ওই শিক্ষক।
মামলা সূত্রে জানা গেছে,শিক্ষক মোস্তাকিম বিল্লাহ ধর্মপুরী রাতে ওই ছাত্রকে তার কক্ষে ডেকে নিয়ে যৌন নির্যাতন করেন। ছাত্রটি ভয়ে কাউকে কিছু না বললেও পরদিন সকালে ছাত্ররা নিজেদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলে ঘটনাটি জানাজানি হয়। পরে বিষয়টি মাদ্রাসার অন্যান্য শিক্ষক, পরিচালনা পর্ষদ ও অভিভাবকেরা জানতে পারেন।
যৌন নির্যাতনের শিকার একাধিক ছাত্রের পিতা জাতীয় এক দৈনিককে বলেন,শিক্ষকের ভয়ে সন্তানেরা আমাদের কিছুই জানায়নি। গত শুক্রবার মাদ্রাসায় যৌন নির্যাতনের পর শিক্ষক পুলিশ গ্রেপ্তার করলে সন্তানেরা তাদের উপর যৌন নির্যাতনের কথা আমাদের জানায়। তারা আমাদের জানায় মাদ্রাসার সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে ‘আল্লাহর ভয়’ দেখিয়ে শিক্ষক তাদের বহুবার যৌন নির্যাতন করেছেন।
মাদ্রাসার সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে ‘আল্লাহর ভয়’ দেখিয়ে শিক্ষক তাদের বহুবার যৌন নির্যাতন করেছেন।
দেশের মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীদের ওপর যৌন নির্যাতনের খবরে শিউরে উঠছে সারা দেশ। যদিও মাদ্রাসাগুলোতে ক্রমবর্ধমান এই ধর্ষণ নিয়ে মাথাব্যথা নেই সরকারের। দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সরব নয়। নেই বার্ষিক কোন প্রতিবেদন। তাই এই সব নির্যাতনের প্রকৃত চিত্র থেকে যাচ্ছে অজানা।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের পর শিক্ষার্থীরা লজ্জা, ভয়, নানান কিছুর কারণে তা প্রকাশ করে না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে সবথেকে কম কথা বলা হয়। এর কারণ হয়তো সেক্স, অপ্রাপ্তবয়স্ক ভুক্তভোগী এবং ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে মানুষের অন্ধবিশ্বাস।
মাদ্রাসা শিক্ষক কর্তৃক একের পর এক শিশু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা মাদ্রাসা বিষয়ে দেশবাসীর নিকট এক নেতিবাচক মনোভাব তৈরী হয়েছে।
আজকের শিশুরাই আগামী দিনের দেশ গড়ার কারিগর। আজ যারা শিশু, কাল তারাই বিশ্বের নেতৃত্ব দেবে। আজ যারা বিখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, একদিন তারাও শিশু ছিলেন। তাই শিশুদের নিয়ে তাদের রয়েছে নানা ভাবনা। কিন্তু সারাদেশে বিভিন্ন মাদ্রাসায় বহু ছেলেশিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। আর এর জন্য দায়ী হচ্ছেন কখনো খোদ মাদ্রাসা শিক্ষক তথা মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টরা। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যানে উঠে আসা তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ মাসে মাদ্রাসায় ধর্ষণের শিকার হয়েছে অন্তত ৬২ শিশু। যাদের মধ্যে তিনজন মারা গেছে।
সংশ্নিষ্টরা জানান, মাদ্রাসাগুলোয় দিনের পর দিন ছেলে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চললেও তা বন্ধে এখনও তেমন কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে বিপথগামী কিছু শিক্ষক ও মাদ্রাসাসংশ্নিষ্টরা এটাকে অপরাধ বলেই গণ্য করেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজেদের অপরাধ আড়াল করতে ধর্মের নানা অপব্যাখ্যা দেন জড়িতরা। আবার ধর্ষণের দৃশ্য ভিডিও করে রেখে তা ছড়ানোর ভয় দেখিয়ে শিশুদের জিম্মি করার ঘটনাও রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, আলিয়া মাদ্রাসা ছাড়া অন্য মাদ্রাসাগুলোতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ বা তদারকি সেভাবে নেই। সেজন্য যৌন নির্যাতন বা শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের সুযোগ থাকে। এছাড়া সেখানে পরিবেশ এমন যে, শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ অনেক সময় প্রকাশও হয় না। কওমি, এবতেদায়ী বা নূরানী-বিভিন্ন ধরনের মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য বেসরকারি উদ্যোগে কর্তৃপক্ষ যারা রয়েছে, তাদের তদারকি বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনেকে মনে করেন এরা আদব কায়দা শিক্ষা দেন। নৈতিকতা শিক্ষা দেন। সে কারণে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে হোক বা নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেকে ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসায় পড়াতে দেন। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, যে নিরাপত্তার কথা ভেবে মাদ্রাসায় ছেলেমেয়েদের পড়াতে দেয়া হয় সেখানে আদৌ নিরাপদ নয়। দেখা যায় ছেলেরাও নিরাপদ নয় এসব তথাকথিত হুজুরদের কাছে। এটিও সমাজের বৈকল্যতা।
তারা বলেন, এমন ঘটনা অনেক হচ্ছে, তবে তা জানা যাচ্ছে কম। যখন কেউ মারা যায় বা নির্যাতনে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে তখনই কেবল তা প্রকাশ্যে আসে। মাদ্রাসা বোর্ডকে এ ব্যাপারে শক্ত ভূমিকা রাখতে হবে। কেন এসব ঘটছে তা খুঁজে বের করতে হবে। জড়িতদের যথাযথ শাস্তি দিতে হবে।
আরও বলেন, সেখানে এমন কোনো কমিটিও নেই যেখানে নির্যাতনের শিকার শিশুরা কথা বলতে পারবে। আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দরিদ্র শিশুরা মাদ্রাসায় পড়ে বলে তাদের নানা অজুহাতে দমিয়ে রাখাও সহজ হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭২৩
আপনার মতামত জানানঃ