দেশের মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীদের ওপর যৌন নির্যাতনের খবরে শিউরে উঠছে সারা দেশ। যদিও মাদ্রাসাগুলোতে ক্রমবর্ধমান এই ধর্ষণ নিয়ে মাথাব্যথা নেই সরকারের। দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সরব নয়। নেই বার্ষিক কোন প্রতিবেদন। তাই এই সব নির্যাতনের প্রকৃত চিত্র থেকে যাচ্ছে অজানা।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের পর শিক্ষার্থীরা লজ্জা, ভয়, নানান কিছুর কারণে তা প্রকাশ করে না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে সবথেকে কম কথা বলা হয়। এর কারণ হয়তো সেক্স, অপ্রাপ্তবয়স্ক ভুক্তভোগী এবং ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে মানুষের অন্ধবিশ্বাস।
মাদ্রাসা শিক্ষক কর্তৃক একের পর এক শিশু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা মাদ্রাসা বিষয়ে দেশবাসীর নিকট এক নেতিবাচক মনোভাব তৈরী হয়েছে। এরইমধ্যে শোনা গেল নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় মাদ্রাসার শ্রেণিকক্ষ থেকে এক ছাত্রীর মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার (৭ এপ্রিল) রাতে সদর উপজেলার ফতুল্লা থানার পাগলা এলাকার নুরবাগ খাতুনে জান্নাত মহিলা (আবাসিক-অনাবাসিক) মাদ্রাসা থেকে মরদেহটি উদ্ধার করা হয়।
নিহত ছাত্রীর নাম হাফিজা নাহার হাবিবা (১৩)। সে ওই মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। হাবিবা ফতুল্লার পূর্ব দেলপাড়ার ইলিয়াসের বাড়ির ভাড়াটিয়া হাফিজুর রহমান আকাশের মেয়ে৷
নিহত হাবিবার পরিবারের দাবি, মায়ের সঙ্গে অভিমান করে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। তবে পুলিশ বলছে, বিষয়টি তারা খতিয়ে দেখছে।
নিহতের বাবা জানান, বৃহস্পতিবার (৭ এপ্রিল) বিকেল ৪টার দিকে প্রথমে সে তার মাকে ফোন করে কথা বলে। দ্বিতীয় দফায় ইফতারের সময় আবারও সে তার মাকে ফোন করে। এ সময় নিহতের মা মেয়েটিকে পড়ালেখায় মনোযোগী হওয়ার জন্য বলেন এবং কড়া ভাষায় শাসন করেন। এ ঘটনার পর রাত পৌনে ৮টার দিকে মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষ থেকে সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তারা মেয়ের মরদেহ দেখতে পান। মায়ের সঙ্গে অভিমান করেই মেয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে ধারণা বাবার।
মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হাজি মোহাম্মদ উল্লাহ মিজি জানান, মায়ের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথাকাটাকাটির জেরে অভিমান করে ছাত্রীটি আত্মহত্যা করেছে। ইফতার চলাকালীন মাদ্রাসার সবাই দ্বিতীয় তলায় ইফতার করছিল। ইফতার শেষে নামাজ পড়ে তৃতীয় তলায় গিয়ে দেখতে পায় শ্রেণিকক্ষের ভেতর থেকে দরজা আটকানো। জানালার ফাঁক দিয়ে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ওড়না প্যাঁচানো ঝুলন্ত দেহ দেখতে পায়। পরে পুলিশকে খবর দিলে রাত ৮টার দিকে নিহতের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
ইফতার শেষে নামাজ পড়ে তৃতীয় তলায় গিয়ে দেখতে পায় শ্রেণিকক্ষের ভেতর থেকে দরজা আটকানো। জানালার ফাঁক দিয়ে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ওড়না প্যাঁচানো ঝুলন্ত দেহ দেখতে পায়।
ফতুল্লা মডেল থানার উপপরিদর্শক মোস্তফা কামাল খান জানান, পুলিশ সংবাদ পেয়ে মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সদর জেনারেল হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। এ ঘটনায় নিহতের বাবা বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করেছেন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, আলিয়া মাদ্রাসা ছাড়া অন্য মাদ্রাসাগুলোতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ বা তদারকি সেভাবে নেই। সেজন্য যৌন নির্যাতন বা শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের সুযোগ থাকে। এছাড়া সেখানে পরিবেশ এমন যে, শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ অনেক সময় প্রকাশও হয় না। কওমি, এবতেদায়ী বা নূরানী-বিভিন্ন ধরনের মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য বেসরকারি উদ্যোগে কর্তৃপক্ষ যারা রয়েছে, তাদের তদারকি বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনেকে মনে করেন এরা আদব কায়দা শিক্ষা দেন। নৈতিকতা শিক্ষা দেন। সে কারণে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে হোক বা নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেকে ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসায় পড়াতে দেন। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, যে নিরাপত্তার কথা ভেবে মাদ্রাসায় ছেলেমেয়েদের পড়াতে দেয়া হয় সেখানে আদৌ নিরাপদ নয়। দেখা যায় ছেলেরাও নিরাপদ নয় এসব তথাকথিত হুজুরদের কাছে। এটিও সমাজের বৈকল্যতা।
মাদ্রাসায় শিশু ধর্ষণ নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন লেখক সাইফুল বাতেন টিটো। মাদ্রাসায় শিশু ধর্ষণ নিয়ে গবেষণা করে তিনি ‘বিষফোঁড়া’ নামের একটি উপন্যাস লিখেছেন। এসব হত্যা বিষয়ে তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি স্টেটওয়াচকে জানান, মাদ্রাসার ছাত্রী বলে আজ এই হত্যা নিয়ে কেউ কোনো কথা বলবে না, কারণ ছাত্রীটি মাদ্রাসার। প্রায়ই এমন হত্যাকাণ্ড ঘটছে মাদ্রাসায়। সেসব নিয়ে কোথাও কোনো কথা শোনা যায়নি। কিন্তু যখন আনুশকাকে হত্যা করা হলো তখন আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম, পথে দাঁড়িয়েছিলাম, টক শোতে টেবিল ফাটিয়েছিলাম। সেইসবের বিরোধীতা করছি না অবশ্য, অন্যায়ের প্রতিবাদ যত হবে ততই ভালো। কিন্তু এই সব মাদ্রাসার হত্যাকাণ্ড নিয়ে কেউ কথা বলে না।
তিনি বলেন, আমরা গরীবের শিশু হত্যার জন্যও পথে নামতে দেখেছি, টক শোতে কথাও বলতে দেখেছি। বড় বড় কলামিস্টদের কলাম পড়েছি। কিন্তু এই গরীব শিশুদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে কেন ওসব হয় না? কারণ একটাই, ধর্ম। একজন মুসলমান আরেক মুসলমানের দোষ গোপন করে চলেছে পরকালের ভয়ে। এখন প্রতিটি গ্রামে গড়ে তিনটা মাদ্রাসা। অর্থাৎ বিশাল কমিউনিটি এদের বিপক্ষে সরকার যেতে চায় না। তাদেরকে সরকার খুব ভয় পায়। তাদের চাপেই তো পাঠ্য বই থেকে হিন্দু লেখকদের লেখা উধাও হয়ে যাচ্ছে, হুমায়ুন আজাদের লেখা বাদ হচ্ছে।
তিনি বলেন, এসব হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত হোক। কেন এবং কীভাবে মারা গেলো এবিষয়ে বিস্তারিত উদ্ঘাটন হোক। একইসাথে এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৩৯
আপনার মতামত জানানঃ