দেশের মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীদের ওপর যৌন নির্যাতনের খবরে শিউরে উঠছে সারা দেশ। যদিও মাদ্রাসাগুলোতে ক্রমবর্ধমান এই ধর্ষণ নিয়ে মাথাব্যথা নেই সরকারের। দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সরব নয়। নেই বার্ষিক কোন প্রতিবেদন। তাই এই সব নির্যাতনের প্রকৃত চিত্র থেকে যাচ্ছে অজানা।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের পর শিক্ষার্থীরা লজ্জা, ভয়, নানান কিছুর কারণে তা প্রকাশ করে না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে সবথেকে কম কথা বলা হয়। এর কারণ হয়তো সেক্স, অপ্রাপ্তবয়স্ক ভুক্তভোগী এবং ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে মানুষের অন্ধবিশ্বাস।
মাদ্রাসা শিক্ষক কর্তৃক একের পর এক শিশু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা মাদ্রাসা বিষয়ে দেশবাসীর নিকট এক নেতিবাচক মনোভাব তৈরী হয়েছে। এরইমধ্যে শোনা গেল মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে নিখোঁজের ৬ দিন পর রাকিব হোসেন (১৩) নামের এক মাদ্রাসাছাত্রের অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
রবিবার সকাল ১০টার দিকে শ্রীনগর উপজেলার কেয়টখালী এলাকায় নির্মাণাধীন রেল লাইনের পাশের একটি ঘাস ক্ষেত থেকে মরদেহটি উদ্ধার করা হয়।
এর আগে গত ১৫ মার্চ লস্করপুর আজিজিয়া দারুল উলুম মাদ্রাসা থেকে হেফজ বিভাগের ছাত্র মোঃ রাকিব হোসেন (১৩) নিখোঁজ হয়। সে হাঁসাড়া ইউনিয়নের লস্করপুর চকরবাড়ি গ্রামের মোশারফ হোসেনের ছেলে।
রাকিবের মামী মদিনা বেগম জানান, রাকিব ও তার ছোট ভাই তাদের বাড়ি থেকে ৩শ গজ দূরের মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতো। ১৫ মার্চ সকাল ৮ টার দিকে তারা বাড়ি থেকে ভাত খেয়ে মাদ্রাসায় যায়। দুপুরে রাকিবের ছোট ভাই বাড়িতে এসে ভাইয়ের জন্য ভাত নিয়ে মাদ্রাসায় গিয়ে জানতে পারেন তার ভাই মাদ্রাসায় নেই।
খবর পেয়ে রাকিবের অভিভাবকরা মাদ্রাসায় এসে তার নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হন। এসময় মাইকিং করার প্রস্তুতি নিলে মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাদ্রাসার সন্মানহানির দোহাই দিয়ে মাইকিং করতে নিষেধ করেন। রাকিবের বাবা-মা বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুজি করে শ্রীনগর থানায় এসে ঐদিন রাতেই সাধারণ ডায়েরি করেন।
পরে আজ নিখোঁজের ৬ দিনের মাথায় রবিবার সকালে কেয়টখালী এলাকায় অর্ধগলিত মরদেহ দেখে স্থানীয়রা ৯৯৯ এর ফোন দেয়। শ্রীনগর থানা পুলিশ এসে মরদেহ উদ্ধার করে। রাকিব হাঁসাড়া ইউনিয়নের লস্করপুর চকেরবাড়ি গ্রামের মোশারফ হোসনেরে ছেলে। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে রাকির ভাইদের মধ্যে বড়।
অভিভাবকরা মাদ্রাসায় এসে তার নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হন। এসময় মাইকিং করার প্রস্তুতি নিলে মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাদ্রাসার সন্মানহানির দোহাই দিয়ে মাইকিং করতে নিষেধ করেন।
শ্রীনগর থানার এসআই আপন মজুমদার বলেন, মাদ্রাসায় পরিহিত পাঞ্জাবী দেখে রাকিবের স্বজনরা লাশ শনাক্ত করেছেন।
শ্রীনগর থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ আমিনুল ইসলাম বলেন, লাশটি ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে। থানায় মামলার প্রস্তুতি চলছে।
এর আগে চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে একটি মাদ্রাসা থেকে এক শিশুর গলা কাটা দেহ উদ্ধারের চারদিনের মাথায় আরও এক মাদ্রাসাছাত্রের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
পাঁচলাইশে আলী বিন আবি তালিব (রাঃ) নামে একটি মাদ্রাসার পেছন থেকে মঙ্গলবার (৮ মার্চ) বেলা ১১টার দিকে মো. আরমানের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
এর আগে বোয়ালখালী উপজেলার চরণদ্বীপ ইউনিয়নের আল্লামা শাহ আছিয়র রহমান হেফজখানা ও এতিমখানা থেকে ইফতেখার মালেকুল মাশফি নামে এক শিশু ছাত্রের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
মাদ্রাসার দ্বিতীয় তলায় তার গলা কাটা দেহ পাওয়া যায়। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, এদিন সকালে মাদ্রাসায় সবক (তালিম) দেয়ার পর থেকে নিখোঁজ ছিল মাশফি।
দেশে নারীর যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের চেয়ে বেশি পরিমাণে ঘটছে মাদ্রাসায় শিশু ধর্ষণ ও হত্যা। প্রায় প্রতিদিনই মাদ্রাসা শিক্ষক কর্তৃক শিশু ধর্ষণের খবর আসে। তবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মাদ্রাসায় শিশু ধর্ষণে কেবল মাদ্রাসা শিক্ষককেরাই জড়িত থাকে না, মাদ্রাসার বড় ভাইদেরও লালসার শিকার হন মাদ্রাসায় আগত শিশুরা। বড় ভাইয়ের যৌন নির্যাতন থেকে নিরাপদ থাকা এইসব বাচ্চাদের জন্য অনেকটাই জটিল। এসব হত্যায় এসমস্ত বড় ভাইদের হাত থাকতে পারে বলে মনে করেন তারা।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, আলিয়া মাদ্রাসা ছাড়া অন্য মাদ্রাসাগুলোতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ বা তদারকি সেভাবে নেই। সেজন্য যৌন নির্যাতন বা শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের সুযোগ থাকে। এছাড়া সেখানে পরিবেশ এমন যে, শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ অনেক সময় প্রকাশও হয় না। কওমি, এবতেদায়ী বা নূরানী-বিভিন্ন ধরনের মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য বেসরকারি উদ্যোগে কর্তৃপক্ষ যারা রয়েছে, তাদের তদারকি বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনেকে মনে করেন এরা আদব কায়দা শিক্ষা দেন। নৈতিকতা শিক্ষা দেন। সে কারণে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে হোক বা নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেকে ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসায় পড়াতে দেন। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, যে নিরাপত্তার কথা ভেবে মাদ্রাসায় ছেলেমেয়েদের পড়াতে দেয়া হয় সেখানে আদৌ নিরাপদ নয়। দেখা যায় ছেলেরাও নিরাপদ নয় এসব তথাকথিত হুজুরদের কাছে। এটিও সমাজের বৈকল্যতা।
মাদ্রাসায় শিশু ধর্ষণ নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন লেখক সাইফুল বাতেন টিটো। মাদ্রাসায় শিশু ধর্ষণ নিয়ে গবেষণা করে তিনি ‘বিষফোঁড়া’ নামের একটি উপন্যাস লিখেছেন। এসব হত্যা বিষয়ে তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি স্টেটওয়াচকে জানান, মাদ্রাসার শিশু বলে আজ এই ধর্ষণ হত্যা নিয়ে কেউ কোনো কথা বলবে না, কারণ শিশুটি মাদ্রাসার। প্রায়ই এমন হত্যাকাণ্ড ঘটছে মাদ্রাসায়। সেসব নিয়ে কোথাও কোনো কথা শোনা যায়নি। কিন্তু যখন আনুশকাকে হত্যা করা হলো তখন আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম, পথে দাঁড়িয়েছিলাম, টক শোতে টেবিল ফাটিয়েছিলাম। সেইসবের বিরোধীতা করছি না অবশ্য, অন্যায়ের প্রতিবাদ যত হবে ততই ভালো। কিন্তু এই সব মাদ্রাসার হত্যাকাণ্ড নিয়ে কেউ কথা বলে না।
তিনি বলেন, আমরা গরীবের শিশু হত্যার জন্যও পথে নামতে দেখেছি, টক শোতে কথাও বলতে দেখেছি। বড় বড় কলামিস্টদের কলাম পড়েছি। কিন্তু এই গরীব শিশুদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে কেন ওসব হয় না? কারণ একটাই, ধর্ম। একজন মুসলমান আরেক মুসলমানের দোষ গোপন করে চলেছে পরকালের ভয়ে। এখন প্রতিটি গ্রামে গড়ে তিনটা মাদ্রাসা। অর্থাৎ বিশাল কমিউনিটি এদের বিপক্ষে সরকার যেতে চায় না। তাদেরকে সরকার খুব ভয় পায়। তাদের চাপেই তো পাঠ্য বই থেকে হিন্দু লেখকদের লেখা উধাও হয়ে যাচ্ছে, হুমায়ুন আজাদের লেখা বাদ হচ্ছে।
তিনি বলেন, এসব হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত হোক। তারা কেন এবং কীভাবে মারা গেলো এবিষয়ে বিস্তারিত উদ্ঘাটন হোক। একইসাথে এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫৯
আপনার মতামত জানানঃ