যুদ্ধপ্রবণ এই বিশ্বে অস্ত্রের চাহিদা বরাবরই অক্ষুণ্ণ থাকে। অস্ত্র চাহিদার ওপর নির্ভর করে বিশ্বে অস্ত্রেরও বিশাল বাজার রয়েছে। করোনা মহামারির কারণে লকডাউন, সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়া, গ্রাহকদের মধ্যে আতঙ্কসহ বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব থাকার পরেও বিশ্বে অস্ত্র বিক্রির ধুম ছিল।
ইউক্রেনে রাশিয়া অভিযানের পর সামরিক শক্তি বাড়ানোর দিকে নজর দিয়েছে ইউরোপের দেশগুলো। সামরিক ব্যয় বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে জার্মানি। তালিকায় রয়েছে ডেনমার্ক ও সুইডেনও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত পাঁচ বছরে ইউরোপে অস্ত্র আমদানিতে রেকর্ড হয়েছে।
সুইডেনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, আগের পাঁচ বছরের তুলনায় ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিশ্বে অস্ত্র রপ্তানি ৪ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে। তবে বিপরীত চিত্র ইউরোপে। সেখানে অস্ত্র আমদানি ১৯ শতাংশ বেড়েছে।
এসআইপিআরআইয়ের জ্যেষ্ঠ গবেষক সিমন ওয়েজম্যান বলছেন, ‘ইউরোপ অস্ত্রের নতুন হটস্পটে পরিণত হয়েছে। আমরা সামরিক ব্যয় ব্যাপকভাবে বাড়াচ্ছি। আমাদের নতুন অস্ত্র দরকার। এর বেশির ভাগই আমদানি করা হবে।’
এই অস্ত্রের বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অন্য দেশগুলো থেকে আমদানি করা হবে বলে মনে করছেন ওয়েজম্যান। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে বৈশ্বিক অস্ত্রবাণিজ্যে ইউরোপের অংশ ১০ থেকে ১৩ শতাংশ বেড়েছে। ভবিষ্যতেও তা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে থাকবে।
অস্ত্র কেনাবেচার অনেক চুক্তিতে অস্বচ্ছতা রাখা হয়। সহায়তা হিসেবে অস্ত্র সরবরাহ করলে সেখানে কোনো আর্থিক লেনদেন থাকে না। ফলে অস্ত্রবাণিজ্যের সঠিক চিত্র বের করা বেশ জটিল হয়ে পড়ে। এরপরও বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের অস্ত্র বিক্রি হবে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
এসআইপিআরআইয়ের দেওয়া তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে আগের মতোই অস্ত্র আমদানিতে শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে এশিয়া ও ওশেনিয়া অঞ্চল। আমদানি হওয়া মোট অস্ত্রের ৪৩ শতাংশেরই ঠিকানা হয়েছে এ অঞ্চলের দেশগুলোতে। এসব দেশের মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, পাকিস্তান ও জাপান।
গত পাঁচ বছরে আমদানি করা অস্ত্রের ৩২ শতাংশ গেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। এ অঞ্চলে অস্ত্র আমদানির হার বেড়েছে ৩ শতাংশ। অপর দিকে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো এবং আফ্রিকায় আমদানি যথাক্রমে ৩৬ ও ৩৪ শতাংশ হারে কমেছে। বিশ্বের আমদানি করা অস্ত্রের ৬ শতাংশ যায় আমেরিকার দেশগুলোতে। একই পরিমাণ অস্ত্র আমদানি করে আফ্রিকায়ও।
আঞ্চলিক হিসাবের বাইরে অস্ত্র আমদানির ক্ষেত্রে এককভাবে শীর্ষে রয়েছে ভারত ও সৌদি আরব। মোট অস্ত্রের ১১ শতাংশ করে মোট ২২ শতাংশ অস্ত্র যায় দেশ দুটিতে। এরপরই মিসর ৫ দশমিক ৭ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়া ৫ দশমিক ৪ শতাংশ ও চীন ৪ দশমিক ৮ শতাংশ অস্ত্র আমদানি করে।
গত পাঁচ বছরে বৈশ্বিক অস্ত্রবাণিজ্যে ইউরোপের অংশ ১০ থেকে ১৩ শতাংশ বেড়েছে। ভবিষ্যতেও তা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে থাকবে।
অপর দিকে অস্ত্র রপ্তানির দিক দিয়ে গত পাঁচ বছরে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মোট রপ্তানির ৩৯ শতাংশই দেশটির দখলে। ১৯ শতাংশ অস্ত্র রপ্তানি করে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে রাশিয়া। রপ্তানিতে শীর্ষ পাঁচে এরপরই রয়েছে ফ্রান্স, চীন ও জার্মানি।
দক্ষিণ এশিয়ায়ও বেড়েছে অস্ত্র ব্যবসা। পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফ্রাঙ্কফুটের (পিআরআইএফ) বিশেষজ্ঞ সিমোন উইসোটজকি বলেছিলেন, তিনি অবাক হয়েছেন যে, বিশ্বের এই অঞ্চলটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তিনি ভারতের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, একশটির মধ্যে ভারতেরও তিনটি কোম্পানি রয়েছে, যাদের সামগ্রিক বিক্রি ১ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে, যা দক্ষিণ কোরিয়ার সমান।
সিপ্রির এ তালিকায় চীনা পাঁচটি কোম্পানিও রয়েছে। চীন সামরিক আধুনিকায়ন কর্মসূচি হাতে নেওয়ার ফলে তাদের অস্ত্র কোম্পানিগুলো লাভবান হচ্ছে। চীনা কোম্পানিগুলোর বিক্রি বেড়েছে ১৩ শতাংশ।
তথ্য প্রযুক্তিকে এই অস্ত্র ব্যবসার কাজে লাগানো হচ্ছে আরও বেশি মুনাফা লাভের জন্য। সিমোন বলেন, বেসামরিক এবং সামরিক প্রযুক্তি ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে উঠছে। তথ্যপ্রযুক্তি এবং অস্ত্রপ্রযুক্তি আর আলাদা নয়। তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলোই অস্ত্র ব্যবসার প্রধান হিসেবে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।
মার্কস্টেইনার জোর দিয়ে বলেন, আপনি যদি অস্ত্র শিল্পের একটি পরিষ্কার চিত্র চান, আপনি কেবল লকহিড মার্টিনের মতো ঐতিহ্যবাহী খেলোয়াড়দের সম্পর্কে কথা বলতে পারবেন না। সম্প্রতি কয়েক বছরে গুগল, মাইক্রোসফট এবং ওরাকলের মতো কিছু সিলিকন ভ্যালি জায়ান্ট অস্ত্র ব্যবসায় তাদের সম্পৃক্ততা আরও গভীর করার চেষ্টা করেছে এবং লাভজনক চুক্তিতে উপনীত হয়েছে।
মাইক্রোসফট ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের ২২ বিলিয়ন ডলারের চুক্তির কথাও জানা যায় সম্প্রতি। এই চুক্তির আওতায় মার্কিন সেনাবাহিনীকে ইন্টিগ্রেটেড ভিজ্যুয়াল অগমেন্টেশন সিস্টেম নামে এক ধরনের সুপার-গ্লাস সরবরাহ করার জন্য কোম্পানিটিকে চুক্তিবদ্ধ করা হয়েছে, যা সৈন্যদের যুদ্ধক্ষেত্র সম্পর্কে বাস্তব-সময়ের কৌশলগত তথ্য সরবরাহ করবে।
এদিকে ফ্রান্সের সঙ্গে অস্ত্র বিক্রিতে পিছিয়ে পড়েছে রাশিয়া। ২০১৯ সালের চেয়ে রাশিয়ার নয়টি কোম্পানি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ অস্ত্র বিক্রি করেছে।
মার্কাস বায়ারের মতে, একশটি দেশের তালিকায় ৫ শতাংশ বিক্রি কমেছে রাশিয়ার, যেটি সরাসরি ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কারণ তারা নিজেরাই উৎপাদন করছে। পূর্বে তারা রাশিয়ার বড় ক্রেতা ছিল।
ইউরোপের অস্ত্র কোম্পানিগুলো একশটি দেশের মধ্যে ২১ শতাংশ সামগ্রিকভাবে অস্ত্র বিক্রি করেছে। ২০২০ সালে ইউরোপের ২৬টি কোম্পানি অস্ত্র বিক্রিতে মুনাফা করেছে ১০৯ বিলিয়ন ডলার। যেখানে চারটি সম্পূর্ণ জার্মান অস্ত্র কোম্পানি এই মোট মুনাফার নয় বিলিয়ন ডলারের নিচে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্ব নেতারা হাজির হয়ে শান্তির কথা বলেন৷ অস্ত্র নয়, মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার কথা বলেন৷ কিন্তু তাদের কথায় এবং কাজে যে বিস্তর ফারাক, আন্তর্জাতিক শান্তি সংস্থাটির রিপোর্ট তা চোখে আঙুল দেখিয়ে দিল৷ তাদের রিপোর্টে যার উল্লেখ নেই, ভারতীয় উপমহাদেশের কোনও কোনও রিপোর্টে সে সত্যও এতদিনে স্পষ্ট হয়েছে৷ কেবল পশ্চিম দুনিয়া নয়, পাল্লা দিয়ে সামরিক শক্তি বাড়িয়ে চলেছে উপমহাদেশের দেশগুলি৷ গত কয়েক বছরে সামরিক খাতে তাদের বরাদ্দও বেড়েছে চোখে পড়ার মতো৷ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এভাবে অস্ত্র ব্যবসা বাড়তে থাকলে ভবিষ্যতে আরও বড় অশান্তির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১১৫৫
আপনার মতামত জানানঃ