জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি একটি দেশের মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে দুটি কারণ কাজ করেছিল। এক. পশ্চিম পাকিস্তান থেকে রাজনৈতিক মুক্তি, আরেকটি হলো অর্থনৈতিক মুক্তি। পাকিস্তান আমলে উন্নয়ন থেকে আমরা ছিলাম বঞ্চিত। ফলে রাজনৈতিক স্বাধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তি দুটিই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মূল উদ্দেশ্য।
নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ আমরা একটি পর্যায়ে উপনীত হয়েছি। এর মধ্যে বিভিন্ন সরকার ক্ষমতায় এসেছে। ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গণতন্ত্র। এরপর সরকার পরিবর্তন হচ্ছে; বিভিন্ন কার্যক্রমও গ্রহণ করা হচ্ছে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছে রাজনৈতিক দলগুলো। তবে আরও দ্রুত অগ্রগতি অর্জন করা যেত কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
এদিকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচকে অনেক পিছিয়েছে বাংলাদেশ। পাঁচ বছর ধরে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সূচকে উন্নতির ধারা অব্যাহত থাকলেও এইবার ১৭ ধাপ পিছিয়ে গেছে বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হেরিটেজ ফাউন্ডেশন প্রকাশিত অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচক-২০২২ এ ১৭ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৭৭ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এখন ১৩৭তম অবস্থানে। এই তালিকায় ২০২১ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২০তম।
হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের দেয়া তথ্যমতে, ২০২২ সালের সূচকে ৫২ দশমিক ৭ শতাংশ স্কোর পেয়েছে বাংলাদেশ, যা আগের বছরের স্কোর থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশ কম।
সূচকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, নাগরিকের শ্রম ও সম্পদের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রত্যেক ব্যক্তির মৌলিক অধিকার।
অর্থনৈতিকভাবে একটি সমাজে প্রতিটি নাগরিক শ্রম ও ব্যবসায় কতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করছেন। কর্ম, উৎপাদন, ভোগ এবং যেভাবে খুশি সেভাবে বিনিয়োগ করার স্বাধীনতা পাচ্ছেন কী না। অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন দেশে শ্রম, পুঁজি এবং উৎপাদিত পণ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে বাধ্য সরকার। এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে তৈরি করা হয় এই সূচক।
অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচকে অনেক পিছিয়েছে বাংলাদেশ। পাঁচ বছর ধরে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সূচকে উন্নতির ধারা অব্যাহত থাকলেও এইবার ১৭ ধাপ পিছিয়ে গেছে বাংলাদেশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার স্কোর ছিল ১০০ এর মধ্যে ৫২ দশমিক ৭। তার আগের বছর ৫৬ দশমিক ৫ স্কোর নিয়ে ১৮৪ দেশের মধ্যে ১২০তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ।
এর আগে ২০২০ সালের এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২২তম। ২০১৯ সালে ছিল ১২১তম। ২০১৮ এবং ২০১৭ সালে এই অবস্থান ছিল একই; ১২৮তম।
সবশেষ সূচকে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও নাগরিকের শ্রমের স্বাধীনতা কমে যাওয়ায় আগের বছরের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। তবে নাগরিকের ওপর করের বোঝা কমিয়ে আনা ও বিভিন্ন উন্নয়নকাজে সরকারের ব্যয় ছিল প্রশংসনীয়।
পাশাপাশি, সম্পত্তির অধিকার প্রতিষ্ঠায় বড় ধরনের বৈষম্য দেখা গেছে এই সূচকে। দলিল-পত্রের জটিলতা ও মানহীন ব্যবস্থাপনা সম্পত্তি হস্তান্তরে ব্যাপক বাধা হয়ে দেখা দিয়েছে।
শ্রমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে গত বছরের তুলনায় বড় ধরনের ছন্দপতন হয়েছে বাংলাদেশে। ২০২০ সালে শ্রম স্বাধীনতা ছিল রেকর্ড ৬৮ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০২১ সালে তা নেমে আসে মাত্র ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এ বছর বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। নেপাল, পাকিস্তান ও মালদ্বীপের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও ভূটান, ভারত ও শ্রীলঙ্কার পেছনে রয়েছে বাংলাদেশ। যদিও ২০২১ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল কেবল ভূটানের পরে, দ্বিতীয় অবস্থানে। এবার ৯৪তম অবস্থানে থাকা ভূটান দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ যা প্রথম ১০০ দেশের তালিকায় রয়েছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন দেশের সরকারের নেয়া মানহীন ও বিচ্ছিন্ন নীতিমালার কারণে এ বাবের সূচকে বৈশ্বিক গড় স্কোর কিছুটা কমেছে। এবারের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচকের গড় হচ্ছে ৬০ শতাংশ। আগের বার এর গড় ছিল ৬১ দশমিক ৬ শতাংশ। বাংলাদেশের অবস্থান বৈশ্বিক গড়ের নিচে।
অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচকে ৮০-এর বেশি স্কোর করে শীর্ষ সাতে রয়েছে সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও লুক্সেমবার্গ। সূচকে এই দেশগুলোকে রাখা হয়েছে ‘পূর্ণ স্বাধীন’ ক্যাটাগরিতে। ‘প্রায় পূর্ণ স্বাধীন’ ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ ২৭টি দেশকে। ‘মধ্যম স্বাধীন’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে জাপান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামসহ ৫৪টি দেশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের যে অঙ্গীকার ছিল, তা রক্ষা হয়নি; বরং সমাজে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার বৈষম্য বেড়েছে এবং এই দুই ধরনের বৈষম্য একটি অন্যটির শক্তি জোগাচ্ছে। সমাজে নৈতিকতার মান কমছে। একটি জ্ঞানমনস্ক বুদ্ধিবৃত্তিক মধ্যবিত্ত সমাজের পরিধি বাড়ার বদলে বরং কমছে। ‘সুশীল সমাজ’ কথাটিকে একটা হাসি ঠাট্টার বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে। অথচ জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায় পুরো সমাজেরই তো সুশীল পরিশীলিত হয়ে গড়ে ওঠার কথা।
সর্বোপরি এত বছরেও আমরা দেশশাসনের একটা টেকসই বন্দোবস্ত করতে পারিনি, যেখানে শাসনব্যবস্থার সর্বস্তরে জবাবদিহি থাকবে। গণতান্ত্রিক বা কর্তৃত্ববাদী যেকোনো শাসনব্যবস্থাতেই জবাবদিহি ছাড়া উন্নয়ন টেকসই হয় না। জবাবদিহি হলো কার্যকর প্রশাসনের একটা অপরিহার্য শর্ত, আর কর্তব্যপরায়ণতা হলো একটা ব্যক্তিগত নৈতিকতার বিষয়—দুটোই দরকার।
তারা বলেন, সময় এসেছে অর্থনৈতিকভাবে মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার এবং দেশকে আর্থসামাজিক দিক থেকে আরও এগিয়ে নেওয়ার। বর্তমান সরকার মেয়াদের শেষ দিকে চলে এসেছে। এমন সময়ে সরকার পরিবর্তন এবং আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিবার নির্বাচনের সময় অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে সামান্য সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই। এতে আমরা পিছিয়ে পড়ব। উন্নয়নের পূর্বশর্তই হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০৫
আপনার মতামত জানানঃ