বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন শুরুর আগে একটা ধারণা প্রচলিত ছিল যে, বিরোধী দলহীন এই স্থানীয় নির্বাচনে যারা সরকারি দলের প্রতীক নৌকা পাবেন তাদের বিজয় অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যাবে। তবে সত্য হল নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে হেরে গেছে প্রায় দেড় হাজারের বেশি প্রার্থী।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী একটি বেসরকারি সংস্থা ব্রতী’র শারমিন মুরশিদ অবশ্য বলছেন, এবারের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন ছিলো শাসক দলের জন্য আত্মঘাতী এবং দলের মধ্যকার বিশৃঙ্খলা এ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই বাইরে চলে এসেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান বলেছেন, আজই গণভবনে বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রীর সাথে আলোচনা করবেন তারা।
নিজেদের ঘাঁটিতেই হেরেছে নৌকা
প্রায় সাড়ে চার হাজারের মতো ইউনিয়ন পরিষদের সাত দফায় নির্বাচন শেষ হয়েছে গত সোমবার। নির্বাচনে প্রায় ১৬০০র বেশি ইউনিয়নে দলের প্রার্থীকে হারিয়ে চেয়ারম্যান হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, যাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগেরই নেতা যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন।
এর মধ্যে এমন কিছু এলাকা আছে যেসব এলাকাগুলো দীর্ঘকাল ধরেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত এলাকা হিসেবে রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচিত। এর মধ্যে আছে ফরিদপুরের বোয়ালমারী, পাবনা সদর উপজেলা ও সুনামগঞ্জের তাহিরপুর। বোয়ালমারীর দশটি ইউনিয়নের নয়টিতেই নৌকার প্রার্থীরা হেরে গেছে এই নির্বাচনে। এর মধ্যে জামানত হারিয়েছেন দলটির তিন জন প্রার্থী।
বোয়ালমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোশারফ হোসেন মুসা মিয়া শুধু বলেছেন, এটা আমাদের ব্যর্থতা। আমি আর কিছু বলতে পারবো না।
প্রসঙ্গত, এই এলাকায় আওয়ামী লীগের তিন নেতার মধ্যে প্রবল দ্বন্দ্ব। এ তিন নেতা হলেন দলটির সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদার। আর এখন এমপি মনজুর হোসেন।
এর আগে নির্বাচনের তৃতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত ফরিদপুরের ভাঙ্গা ও চরভদ্রাসনের ১৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ১৪টিতেই পরাজিত হয়েছে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা।
আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ফরিদপুর ছাড়াও রাজবাড়ী, নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, টাঙ্গাইল, রাঙামাটি, কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা হেরে গেছেন।
পাবনায় আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়েছে। জেলা সদরের নয় ইউনিয়নের সব কটিতে নৌকার প্রার্থীরা হেরেছেন। জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল করিম বলছেন নির্বাচনের এমন ফল নিয়ে তদন্ত শুরু করেছেন তারা।
পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল করিম জানান, দল থেকে তদন্ত করছি। প্রধানমন্ত্রীর অফিস ও দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে চিঠিও দিয়েছি। এ জবাব আমরাও চাই যে কেন নৌকার প্রার্থীরা হারলো। স্থানীয় নেতা ও এমপিরাই এগুলো ভালো বলতে পারবেন।
অর্থাৎ তার কথায় এটি স্পষ্ট যে স্থানীয় নেতা ও এমপিদের মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণেই এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের সবগুলোতেই চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হেরে গেছে।
কুমিল্লায় তেইশটি ইউনিয়নের মধ্যে নৌকা জিতেছে মাত্র ৭টিতে, ১৫টি বিদ্রোহী ও ১টিতে স্বতন্ত্র। অথচ জেলা দু জন প্রভাবশালী মন্ত্রী আছেন।
দলটির অনেক নেতারা এখন বলছেন, প্রার্থী মনোনয়নে ভুলের কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এবারের নির্বাচনটি ছিলো সহিংস ও শাসক দলের জন্য আত্মঘাতী।
আওয়ামী লীগের বিরোধী যারা অনানুষ্ঠানিক অংশ নিয়েছে তারাই বরং সফল। এ নির্বাচন রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভিতকে আহত করেছে কারণ দলের প্রবল সাংগঠনিক সংকট তৈরি হয়েছে। কিন্তু কয়জনকে বিদ্রোহী হিসেবে বাদ দিবে তারা? বাদ দিলে কি সুখকর হবে?
এই মুহূর্তে দলের মধ্যে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা তারা কিভাবে সামাল দেয় সেটিই হবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
বিভিন্ন ধাপে নির্বাচনের সার্বিক অবস্থা
নির্বাচন কমিশনকে থেকে পাওয়া অনানুষ্ঠানিক হিসেবে অন্তত ১৬৯৪টি ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে হারিয়ে জয় পেয়েছে। অন্যদিকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রায় একশসহ মোট ২০৪৩ জন নৌকা প্রতীক নিয়ে জয় পেয়েছেন। যদিও সাত দফার মোট ফল চূড়ান্ত হলে এ সংখ্যায় কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে।
প্রথম ধাপে ১৪৮টি ইউনিয়ন পরিষদে নৌকার প্রার্থী জয়লাভ করেছে। আর স্বতন্ত্র হিসেবে জয় পেয়েছিলেন ৪৯ জন প্রার্থী। এছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ একটি, জাতীয় পার্টি-জেপি ও জাতীয় পার্টি-জাপা পেয়েছে তিনটি করে চেয়ারম্যান পদে জয় পায়।
পরে ১১ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ৮৩৪টির মধ্যে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা চেয়ারম্যান পদে জয় পায় ৪৮৬টিতে এবং ৩৩০টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পান।
এ ধাপে জাতীয় পার্টি ১০টিতে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ চারটি এবং জাতীয় পার্টি (জেপি), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, খেলাফত মজলিশ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) একটি করে ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে জয় পেয়েছে।
তৃতীয় ধাপে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাদে সরাসরি ভোট অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলো স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। সরাসরি ভোট অনুষ্ঠিত ৯০৮টি ইউপির মধ্যে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৪৪৫টিতে এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা ৪২৬টিতে জয়ী হয়েছে। অবশ্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় যে ৯৯ জন নির্বাচিত হয়েছিলেন তারা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের।
চতুর্থ ধাপের ভোটে চেয়ারম্যান পদে নৌকার প্রার্থীরা প্রায় অর্ধেক ইউনিয়নেই হেরে গেছেন। এর মধ্যে ১৬২টি ইউনিয়ন পরিষদে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থীরা মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই ছিলেন না। এ ধাপে ৭৯৭টি ইউনিয়ন পরিষদের সরাসরি ভোটে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়ী হয়েছেন ৩৫০টিতে আর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন ৩৮৯টিতে।
পঞ্চম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনেও চেয়ারম্যানপদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলো স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এ ধাপে ৭০৮টি ইউপির মধ্যে ৬৮৬ টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থীর ফলাফল পাওয়া গেছে। এতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জিতেছে ৩৩২ জন আর স্বতন্ত্র নির্বাচিত হয়েছে ৩৪৯ জন।
তবে ষষ্ঠ ধাপে এসে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৯৫টি আর আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জিতেছে ১১৭টি ইউনিয়ন পরিষদে। আর সর্বশেষ সোমবার সপ্তম ধাপের ১৩৮টির মধ্যে সবগুলোর মধ্যে ফল এখনও জানা যায়নি। তবে এখন পর্যন্ত ৫৮টিতে আওয়ামী লীগ ও ৩৫টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন।
আ’লীগের এই বিপর্যয় কেন?
অনেকেই অবশ্য বলার চেষ্টা করছেন যে, যারা জিতেছে তারাও তো নৌকারই লোক। কিন্তু এ যে অক্ষমের সান্ত্বনা তা বলাই বাহুল্য। কারণ যারা জিতেছে তারা নৌকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই জিতেছে। তাদের মার্কা আর যাই হোক, নৌকা নয়। তাই তাদের ‘নৌকার লোক’ বলে চালিয়ে দিয়ে সার্বিক পরিস্থিতিকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
মনে রাখা দরকার, সেই ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে তদানীন্তন আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে যে ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করেছিল, তখন থেকেই এ দেশের মানুষের কাছে ‘আওয়ামী লীগ’ ও ‘নৌকা’ এই দুটো শব্দ প্রায় সমার্থক হয়ে আছে।
অবস্থাটা এমনই যে, গ্রামের একজন সাধারণ মানুষ পর্যন্ত মনে করেন আওয়ামী লীগ মানেই নৌকা আর নৌকা মানেই আওয়ামী লীগ। তাই হয়তো আওয়ামী লীগ সমর্থকরা গর্ব করে বলে থাকেন ‘আমি নৌকার লোক’। তাই যদি হবে, তাহলে নৌকার এমন বিপর্যয় কেন? এটা কি কেবলই সরকারি দলের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের ফল, নাকি আরও অধিক কিছু? তাহলে কি সময়ের সঙ্গে নৌকার টানে ভাটা পড়েছে?
এ কথাতো সবাই জানেন যে, চলমান ইউপি নির্বাচনে দেশের অন্যতম প্রধান বিরোধী দল বিএনপি দলীয়ভাবে অংশ নিচ্ছে না। ছোট দুই-একটা দল অংশ নিলেও বাস্তবে এটা যে একদলীয় নির্বাচন তাতে কারও কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। তারপরেও নির্বাচনে কেন এত বিদ্রোহী প্রার্থী? আর নির্বাচন এলেই কেবল বিদ্রোহের ডঙ্কা বেজে উঠে কেন? অন্য সময় এটা কেন হয় না? ৫ বছর ধরে যে ব্যক্তিটির পেছনে মিটিং-মিছিল করে জয়ধ্বনি দেওয়া হয়, হঠাৎ করেই সে শত্রু হয়ে যায় কেমন করে?
এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক অবস্থার দিকে নজর দিতে হবে। প্রথমত, আমাদের দেশে নির্বাচন হলো একটা উঁচু পর্যায়ের ‘বিনিয়োগ’। হোক তা সংসদ নির্বাচন কিংবা হোক ইউপি নির্বাচন। সবাই বিশ্বাস করে একবার নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে পারলে ১০ দিক ঠেলে লক্ষ্মী এসে ঘরে ঢুকবে এবং ঢুকতেই থাকবে।
আর এ জন্য কারও কাছেই কোনো জবাবদিহিতা করতে হবে না। প্রশাসন, পুলিশ, আইন, সব রাতারাতি এসে যাবে হাতের মুঠোয়। খুন থেকে শুরু করে নদী দখল সবই হয়ে যাবে জলের মতো তরল। তাই একবার একটা রিস্ক নিলে কী এমন ক্ষতি?
দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চার জায়গাটা খুবই দুর্বল। সে কারণে দলের অভ্যন্তরে চেইন অব কমান্ড বলতেও কিছু নেই। ফলশ্রুতিতে প্রতিটা উপজেলাতেই রয়েছে একাধিক উপদল। এর সঙ্গে আছে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ভবিষ্যৎ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের এলাকায় প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা।
অন্যদিকে গত দেড় দশকে যে হারে দুর্নীতির শাখা-প্রশাখা প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে, তাতে দলের প্রতিটা কর্মীই বিশ্বাস করে কোনো রকমে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা কাঠামোতে একবার ঢুকে যেতে পারলে আর ঠেকায় কে? সে কারণে মোটামুটি একটু পরিচিতিসম্পন্ন সবাই যেভাবেই হোক শক্তি কাঠামোতে ঠাঁই করে নিতে চায়। এজন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ে, বাড়ে ‘বিদ্রোহী’।
এতে করে নৌকার বিজয় সম্ভাবনা যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে নৌকার বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টা কাজ করেছে বলে মনে হচ্ছে, তা হলো গত দেড় দশক ধরে টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এতই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, স্থানীয় জনগণের সঙ্গে তাদের সম্পর্কটা হয়ে উঠেছে ভীতির, ভালোবাসার নয়। ভয় আর ক্ষমতার দর্প দেখিয়ে যে মানুষের মন জয় করা যায় না এ কথাটি দলটির মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা ভুলেই গেছেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৫৭
আপনার মতামত জানানঃ