গত তিন বছরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত থেকে ৭ হাজার ২৭১ জন বাংলাদেশি গ্রেপ্তার হয়েছেন। এর অধিকাংশই অনুপ্রবেশকারী এবং কিছু চোরাচালানকারী। এদের মধ্যে ২০২১ সালে গ্রেপ্তার হয় ২ হাজার ৩৬ জন । এ সময় পাচারের উদ্দেশে নেওয়া ৩৭ হাজার গরু উদ্ধারের পর আটক হয়েছে। পাশাপাশি ৭০ কেজির বেশি সোনা, ৬ কুইন্টাল রুপাসহ বিভিন্ন মাদক উদ্ধার করা হয়েছে।
কলকাতার নিউ টাউনে গতকাল মঙ্গলবার বিএসএফের দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। বিএসএফের দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ার কর্মকর্তারা বলেছেন, এ দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ৯১৩ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত যার নিরাপত্তার দায়িত্বে দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ার।
সংবাদ সম্মেলন থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত থেকে ২০১৯ সালে গ্রেপ্তার হয় ২ হাজার ১৭৫ জন, ২০২০ সালে গ্রেপ্তার হয় ৩ হাজার ৬০ জন এবং ২০২১ সালে গ্রেপ্তার হয় ২ হাজার ৩৬ জন। এই সময়ে ২ হাজার ২৯৫ জন ভারতীয় নাগরিককেও সীমান্ত থেকে আটক করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৫৮ জন বিদেশি নাগরিককে আটক করা হয়েছে যারা বাংলাদেশ-ভারতের নাগরিক নন।
দালাল ও নারী পাচারকারীদের আটক করা হচ্ছে উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২০২১ সালে নারী পাচার, চোরাচালান, চোরাচালান সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত ৮৪ জন দালালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এক বছর আগে বিএসএফ সীমান্তে মানব পাচার রোধে একটি বিশেষ ইউনিট গঠন করে। সে ইউনিট গত এক বছরে ২৯টি ঘটনায় ৩৩ জন বাংলাদেশি নারীকে উদ্ধার করেছে। এই নারীদের ভারতে কাজের লোভ দেখিয়ে পাচারকারীরা সীমান্তের ভারতীয় অংশে নিয়ে আসে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কলকাতার দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের আইজি অনুরাগ গর্গ, উপমহাপরিদর্শক ও জ্যেষ্ঠ জনসংযোগ কর্মকর্তা সুরজিৎ সিং গুলেরিয়া প্রমুখ।
এদিকে বুধবার দেশটির বার্তাসংস্থা এএনআইকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) দক্ষিণ বঙ্গ সীমান্তের মহাপরিদর্শক অনুরাগ গর্গ বলেছেন, বেড়া না থাকায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বিএসএফের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গর্গ বলেন, পশ্চিমবঙ্গ বিশাল এলাকা। আর সুন্দরবন থেকে শুরু করে মালদা পর্যন্ত দক্ষিণ বঙ্গের সীমান্ত। আমরা সীমান্তে বেড়া দেওয়ার চেষ্টা করলেও জমির অভাবে তা করা যায়নি।
তিনি বলেন, সীমান্তে বেড়া নির্মাণের জন্য ১৫০ মিটার খোলামেলা জমি প্রয়োজন। সীমান্তের আশপাশে গ্রামের পর গ্রাম আছে। আমরা জানি যে, দেড়শ মিটার উন্মুক্ত জমি প্রয়োজন। কিন্তু এখানে তা পাওয়া যায় না। এটা বোঝাও মুশকিল যে, কে বাঙালি আর কে বাংলাদেশি। এমনকি বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষী বাহিনীও (বিজিবি) মাদক নিয়ে উদ্বিগ্ন।
সীমান্তে বেড়া নির্মাণের জন্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের কাছে জমি চাওয়ার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে কি-না; এমন এক প্রশ্নের জবাবে বিএসএফের দক্ষিণ বঙ্গ সীমান্তের মহাপরিদর্শক অনুরাগ গর্গ বলেন, কিছু কিছু এলাকায় বেড়া দেওয়া সম্ভব নয়। রাজ্য সরকারের আওতাধীন হওয়ায় আমরা জমি পাওয়ার চেষ্টা করছি। তাদের (রাজ্য সরকারের) পক্ষ থেকে কোনও ধরনের প্রতিবন্ধকতা আসেনি।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত থেকে ২০১৯ সালে গ্রেপ্তার হয় ২ হাজার ১৭৫ জন, ২০২০ সালে গ্রেপ্তার হয় ৩ হাজার ৬০ জন এবং ২০২১ সালে গ্রেপ্তার হয় ২ হাজার ৩৬ জন। এই সময়ে ২ হাজার ২৯৫ জন ভারতীয় নাগরিককেও সীমান্ত থেকে আটক করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৫৮ জন বিদেশি নাগরিককে আটক করা হয়েছে যারা বাংলাদেশ-ভারতের নাগরিক নন।
তিনি বলেন, এটি রাজ্য সরকারের জন্যও এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। কারণ সীমান্তে বসবাসকারী লোকজন জমি অধিগ্রহণের অনুমতি দেয় না।
সীমান্তে যানবাহনের ভুয়া লাইসেন্স জব্দ করার বিষয়ে গর্গ বলেন, সীমান্ত এলাকায় ভুয়া লাইসেন্সধারীদের প্রবেশ উদ্বেগজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে বিএসএফ এখন সীমান্ত এলাকায় আসা-যাওয়া করা পণ্যবাহী যানবাহনের লাইসেন্স যাচাই-বাছাই করছে।
তিনি বলেন, আমরা ভুয়া লাইসেন্সসহ অনেক যানবাহন আটক করেছি এবং এফআইআর দায়ের করার জন্য পুলিশকে নাম জানিয়ে দিয়েছি।
ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু চোরাচালান মোকাবিলায় ২০১৮ সাল ছিল মোড় ঘোরানো বছর। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ সীমান্তে ১ লাখ ১৯ হাজার ২৯৯টি গরু আটক করে বিএসএফ। ২০১৮ সালে তা ৫০ শতাংশ কমে ৬৩ হাজার ৭১৬টিতে নেমে আসে। গত দুই বছরে এ সংখ্যা আরও দ্রুত কমে ২০১৯ সালে হয় ৪৬ হাজার ৮০৯টি ও ২০২১ সালে ২০ হাজার ৪১৫টি।
২০১৪ সালের মে মাসে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিজেপি নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার গোসুরক্ষায় ও গরু চোরাচালান প্রতিরোধে বিশেষ মনোযোগ দেয়। ২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের একটি সীমান্ত ফাঁড়িতে বিএসএফ কর্মীদের উদ্দেশে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছিলেন, তিনি এই বাহিনীকে গরু চোরাচালানের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে ব্যবহার করতে চান, যাতে বাংলাদেশ গরুর মাংস খাওয়া ছেড়ে দেয়।
রাজনাথ সিংয়ের এমন মন্তব্যের পর গবাদিপশু পাচার বন্ধ করতে সীমান্তে সার্বক্ষণিক নজরদারি শুরু করে বিএসএফ। এ কাজের জন্য তারা অতিরিক্ত সদস্যও মোতায়েন করে। নদীপথে গবাদিপশু পরিবহনকারী চোরাকারবারি ঠেকাতে বাড়ানো হয় স্পিডবোটে টহল। এই ধরনের আন্তসীমান্ত অপরাধীদের ওপর প্রাণঘাতী নয়, এমন অস্ত্রের ব্যবহারও শুরু করে বিএসএফ। গত বছর ভারত সরকারের এক বিবৃতিতে বলা হয়, বিএসএফ গবাদিপশু পাচারকারীদের ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ বলে আখ্যায়িত করেছে।
তবে বিএসএফের সূত্রগুলো বলেছে, গবাদিপশু চোরাচালান অনেকটাই আটকে যাওয়ার পেছনে অন্য কারণও রয়েছে। একজন জ্যেষ্ঠ বিএসএফ কর্মকর্তা বলেন, ‘এর আগে আমরা গবাদিপশু জব্দ করার পর শুল্ক কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করতাম, যা তারা পরে নিলামে বিক্রি করত। তখন নিলাম করা গবাদিপশুগুলো প্রায়ই একই চোরাকারবারিরা কিনে নিত।’
নাম প্রকাশ না করা ওই কর্মকর্তা বলেন, ২০১৮ সালে এসে এই নিলাম প্রক্রিয়া বন্ধ করা হয়। জব্দ করা গরুর দায়িত্ব স্থানীয় পুলিশের নেওয়ার কথা থাকলেও তারা এ বিষয়ে সহযোগিতা করেনি। তাই বিএসএফ কিছু এনজিওর সহায়তায় জব্দ পশুর দেখভাল শুরু করে। পরে সেগুলো গো-আশ্রয়ণে পাঠিয়ে দেয়। বিএসএফকে এর জন্য খরচও বহন করতে হয়েছে। এ উদ্যোগে চোরাকারবারি আটকের সংখ্যাও কমেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশ বছরের পর বছর নিজস্ব দুগ্ধ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়িয়ে এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি করছে। এটিও সীমান্তে গবাদিপশুর চোরাচালান সীমিত করেছে। আরেক বিএসএফ কর্মকর্তা বলেন, হরিয়ানা জাতের গরু এখন সীমান্তে খুব কমই আটক করা হচ্ছে। কিন্তু উত্তর প্রদেশ ও বিহারের লোকেরা এখনো এ জাতের গরু চোরাচালানে সক্রিয় আছেন। রাজ্য সরকারগুলো এগিয়ে এলে বিএসএফকে গরু চোরাচালান ঠেকানোর কাজ আর করতে হবে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গরু চোরাচালান সীমান্ত হত্যার প্রধান কারন হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। গরু চোরাচালান বন্ধের সহজ উপায় হল এই ব্যবসাকে বৈধতা দেওয়া। এতে করে সীমান্ত হত্যা কমে যাবে, উল্লেখযোগ্য পরিমান অর্থ সরকারী কোষাগারে জমা হবে এবং ব্যবসায়ীরাও লাভবান হবে। বাংলাদেশ সব সময়ই ভারত থেকে বৈধভাবে গরু আমদানী করতে আগ্রহী। কিন্তু ভারত সরকার গরু রফতানী করতে আগ্রহী নয় যদিও ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীরা একে বৈধতা দেওয়ার পক্ষে।
বাংলাদেশ-ভারত যদিও বন্ধুরাষ্ট্র, তবুও এ দুই দেশের সীমান্তে রাষ্ট্রীয় হত্যা হয় গোটা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। তবে এই গুলির ঘটনা একতরফা। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পক্ষ থেকে ভারতীয় কোনো নাগরিক গুলিবিদ্ধ না হলেও ভারতের পক্ষ থেকে নিয়ম করেই গুলি চালিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করা হচ্ছে।
মানবাধিকার সংস্থার মতে, ২০০০-২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কমপক্ষে ১,১৮৫ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে সীমান্তে মোট ৪৮ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করে বিএসএফ৷ এর মধ্যে ৪২ জনকে গুলি করে এবং ছয় জনকে হত্যা করা হয় নির্যাতন চালিয়ে৷ অপহরণ করা হয় ২২ বাংলাদেশিকে৷
ওই সময়ে ২৬ জন বিএসএফ-এর গুলি ও নির্যাতনে গুরুতর আহত হন৷ অপহৃতদের মধ্যে মাত্র পাঁচ জনকে ফেরত দেয়া হয়েছে৷ বাকিদের ভাগ্যে কী ঘটেছে জানা যায়নি৷
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মতে বিএসএফ আত্মরক্ষার জন্য হত্যা করে। কিন্তু, বাস্তবতা তা বলে না। বেশ কয়েক বছর আগে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) ‘ট্রিগার হ্যাপি’ নামে একটি প্রতিবেদনে এ ধরনের বেশ কয়েকটি মামলার উল্লেখ করেছে। যাতে বেঁচে যাওয়া এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেছেন যে বিএসএফ তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা না করে বা সতর্ক না করেই নির্বিচারে গুলি চালায়। বিএসএফ আরও দাবি করেছে যে দুর্বৃত্তরা গ্রেপ্তার এড়ানোর চেষ্টা করলে তাদের সদস্যরা গুলি চালায়। তবে কোনও অপরাধের সন্দেহে প্রাণঘাতি অস্ত্রের ব্যবহার ন্যায়সঙ্গত হয় না।
বিশ্লেষকরা বলেন, ভালো প্রতিবেশী দেশ সীমান্তে চলাচলকারীদের সঙ্গে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আচরণ করে। ভারত সরকারের এটা নিশ্চিত করা উচিত যে তার সীমান্ত রক্ষী বাহিনী মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রতি সম্মান করছে এবং আইনের শাসন অনুসরণ করছে। বিএসএফ এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে জাতিসংঘের সাধারণ নীতিমালা মেনে চলার জন্য প্রকাশ্যে আদেশ দেওয়া উচিত। বিএসএফের নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত তার সদস্যদের বিচার করতে পারেনি। ভারত সরকার বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে নির্যাতনের মামলাগুলো তদন্তের অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫৭
আপনার মতামত জানানঃ