
বিশ্ব এখনও বাস করছে করোনাভাইরাসের মহামারির মধ্যে। বিভিন্ন দেশে দৈনিক সংক্রমণও বাড়ছে নতুন করে। এরইমধ্য অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের এক গোপন মহামারি চলছে পৃথিবীতে। আর এ মহামারিতে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে লাখ লাখ মানুষ।
সম্প্রতি এক বড় আকারের গবেষণা থেকে জানা গেছে, ২০১৯ সালে ওই মহামারিতে সারা বিশ্বে ১২ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। খবর বিবিসি বাংলার।
এইডস কিংবা ম্যালেরিয়াতে প্রতিবছর যত সংখ্যক লোক মারা যায়, এই সংখ্যা তার দ্বিগুণ বলে গবেষণার ফলাফলে জানা যাচ্ছে। দরিদ্র দেশগুলোতে সংক্রমণ পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে দরিদ্র দেশগুলো তবে এটি সবার জন্যই হুমকি। এই সংক্রমণ মোকাবিলায় নতুন ওষুধে বিনিয়োগ এবং বর্তমান ওষুধগুলো আরও বেশি বিবেচনা করে ব্যবহারের আহ্বান জানিয়েছে প্রতিবেদনটি।
গত কয়েক বছর ধরে অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহার ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে এগুলোকে অকার্যকর করে তুলেছে। ফলে মারাত্মক আক্রান্ত রোগীদের বিরুদ্ধে কাজ করছে না এসব অ্যান্টিবায়োটিক। আর এতে অতি সাধারণ রোগে মারা যাচ্ছে মানুষ। অথচ কিছুদিন আগেও এসব রোগের বিরুদ্ধে কার্যকর ছিল এসব ওষুধ।
ব্রিটিশ স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা সতর্ক করে বলেছেন, কভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক যদি দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ব্যবহার করা না হয় তাহলে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণ একটা ‘গোপন মহামারি’ হয়ে উঠতে পারে।
অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাক্টেরিয়া (এএমআর) সংক্রমণে মৃত্যু নিয়ে নতুন প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয়েছে ল্যানসেট জার্নালে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক একটি গবেষক দল ২০৪টি দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। তারা হিসাব করে দেখেছেন ২০১৯ সালে ৫০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যুতে এএমআর একটি ভূমিকা রেখেছে। আর সরাসরি এর কারণে মৃত্যু হয়েছে ১২ লাখের বেশি মানুষের। একই বছর এইডস এ মৃত্যু হয়েছে আট লাখ ৬০ হাজার মানুষের, আর ম্যালেরিয়ায় মারা গেছে ছয় লাখ ৪০ হাজার।
অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার বন্ধে জাতিসংঘসহ একাধিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সংস্থা একাধিকবার বিশ্বে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আসছে। কিন্তু কোনো হুঁশিয়ারিতেই এর ব্যবহার নিয়মানুসারে করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে চিকিৎসকরা প্রায় অধিকাংশ রোগের পথ্য হিসেবেই অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ করেন। তবে বিশ্লেষকরা, অ্যান্টিবায়োটিকের এমন ব্যবহারের পেছনে ওষুধ কোম্পানিগুলোকেও দায়ী করেন। অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করতে ওষুধ কোম্পানিগুলোর যে বাড়তি চাপ থাকে, সেই কারণেই অধিকাংশ চিকিৎসককে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে দেখা যায় রোগীদের।
এএমআর-এ মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে নিউমোনিয়ার মতো লোয়ার রেসপিরেটরি সংক্রমণ এবং রক্তের সংক্রমণকে, যেখান থেকে পরে সেপসিস হয়। এমআরএসএ (মেথিসিলিন রেজিস্টান্ট স্টেফাইলোকক্কাস অরিউস) ব্যাকটেরিয়াকে এই গবেষণায় বিশেষভাবে প্রাণঘাতী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০১৯ সালে ৫০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যুতে এএমআর একটি ভূমিকা রেখেছে। আর সরাসরি এর কারণে মৃত্যু হয়েছে ১২ লাখের বেশি মানুষের। একই বছর এইডস এ মৃত্যু হয়েছে আট লাখ ৬০ হাজার মানুষের, আর ম্যালেরিয়ায় মারা গেছে ছয় লাখ ৪০ হাজার।
ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের অধ্যাপক ক্রিস মারে বলছেন, এই গবেষণায় সারা বিশ্বে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাব কমে যাওয়ার প্রকৃত চিত্রটি ফুটে উঠেছে। আমরা যদি এই লড়াইয়ে টিকে থাকতে চাই তাহলে যে এখনই দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে, গবেষণা থেকে তার পরিষ্কার ইংগিতই পাওয়া যাচ্ছে।
কতটা ঝুঁকিতে বাংলাদেশ?
এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থাও ব্যতিক্রম কিছু নয়। প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ, সাধারণ ভাইরাসজনিত সর্দিজ্বরে ইচ্ছেমতো অ্যান্টিবায়োটিক নেওয়া, ফার্মেসিগুলোতে প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রয়, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসকদের নিয়ম না মেনে ইচ্ছামতো অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার, হাঁস-মুরগি, পশু ও কৃষিতে ব্যাপক হারে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে অজ্ঞতা/অসচেতনতাই এই সমস্যার মূল কারণ।
অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাব, পশু-পাখির খাবারে, শাক-সবজিতে বা কৃষিকাজে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার- ইত্যাদি নানান কারণে বাংলাদেশে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকের অনেকগুলো কার্যক্ষমতা কমে গেছে বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের এক চলমান গবেষণায় উঠে এসেছে যে দেশে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে অন্তত ১৭টির কার্যক্ষমতা অনেকাংশে কমে গেছে।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান জাকির হোসেন হাবিব বলেন, অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কারণে অনেক ওষুধই ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে অপেক্ষাকৃত কম কার্যকর হয়ে পড়ছে।
তিনি বলেন, আমরা যখন মেডিকেল শিক্ষার্থী ছিলাম তখন সেফট্রিয়াক্সোন অত্যন্ত কার্যকর একটি অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ছিল। কিন্তু এখন যদি রেজিস্টান্স প্যাটার্ন দেখেন- তাহলে দেখবেন আমরা যেসব জীবাণু দেখিয়েছি, তার প্রত্যেকটি অন্তত ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ এই অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টান্ট। অর্থাৎ ২০ থেকে ৩০ বছর আগেও যেই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণের বিরুদ্ধে কার্যকর ছিল, তা এখন অনেকাংশে কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। এমনকি কিছুদিন আগেও যেসব অ্যান্টিবায়োটিক বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর ছিল, সেগুলোও কার্যকারিতা হারাতে শুরু করেছে।
জাকির হোসেন হাবিব বলেন, বাংলাদেশে কয়েক বছর আগেও ইমিপেনাম, মেরোপেনাম গ্রুপের ড্রাগ বেশ কার্যকর ছিল। কিন্তু কোভিডের সময় এই গ্রুপের ড্রাগ রোগীদের অতিরিক্ত পরিমাণে দিয়ে এটির কার্যকারিতাও নষ্ট করে ফেলছেন চিকিৎসকরা। এই গ্রুপের ড্রাগ কার্যকারিতা হারালে এরপর আমাদের হাতে আর খুব বেশি অ্যান্টিবায়োটিক থাকবে না। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো বাংলাদেশে হাসপাতালগুলোতে এমন জীবাণুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে যা সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী। অর্থাৎ কোনো অ্যান্টিবায়োটিকেই ওই জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর হবে না।
বাংলাদেশের হাসপাতালর রোগীদের দেহে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা ও জীবাণুর ধরন নিয়ে পরিচালিত হওয়া এক গবেষণার বরাত দিয়ে ডা. হাবিব বলেন, ‘জীবাণুদের আমরা মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট, এক্সটেনসিভ ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট আর প্যান ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট- এই তিন ভাগে ভাগ করেছি। যার মধ্যে প্যান ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট হলো এমন জীবাণু ,যার বিরুদ্ধে কোন অ্যান্টিবায়োটিকই কার্যকর নয়। প্রচলিত কোন অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করা সম্ভব নয়— এমন জীবাণু পাওয়া গেছে প্রায় সাত ভাগ।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, আপাতদৃষ্টিতে এর ভয়াবহতা পরিলক্ষিত না হলেও ভবিষ্যতে এটি সর্বোচ্চ ট্র্যাজেডি হতে যাচ্ছে, এ বিষয়ে নিশ্চিতভাবে বলা যায়। ২০০১ সালের দিকে এইচআইভি ভাইরাসের ভয়াবহতা নিয়ে দেশব্যাপী অনেক প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়েছিল, যার দরুন বাংলাদেশে এইচআইভি আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক কম। ব্যাপক ঘনবসতি হওয়ার কারণে বাংলাদেশে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্ট আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। এইচআইভির মতো এটি এত ভয়াবহ না হলেও অদূর ভবিষ্যতে এটি অনেক ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে।
দিন দিন সহজলভ্য অ্যান্টিবায়োটিকের এমন অকার্যকর হয়ে পড়াও চিকিৎসাপদ্ধতিকে কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল করে তুলছে। এর ফলে ক্রমবর্ধমান এই সমস্যার দিকে দৃষ্টি দেওয়া এখন সময়ের দাবি। চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট ও নার্সদের অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারে বিশেষভাবে সচেতন হতে হবে এবং একই লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে জনগণকেও বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণে সচেতন করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে ব্যাকটেরিয়াসমূহ অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। ব্যাকটেরিয়ায় সংক্রমিত রোগী পূর্ণ মেয়াদে অ্যান্টিবায়োটিক না খেয়ে রোগ কমেছে ভেবে পূর্ণ মেয়াদের আগেই অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া বন্ধ করেন। তবে ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। ব্যাকটেরিয়ার প্লাজমিড অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীন বহন করে। পরীক্ষা করে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি এবং স্বরূপ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা উচিত।
শুধু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী পূর্ণ মেয়াদে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেন তারা।
তারা বলেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিক নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। কারা রোগীর ব্যবস্থাপত্রে অ্যান্টিবায়োটিক লিখতে পারবেন, কারা কিসের ভিত্তিতে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রয় করতে পারবেন। রোগীর সঠিক নিয়মে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করা ইত্যাদি বিশদভাবে নীতিমালায় উল্লেখ থাকবে।’
এছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্টের বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে অন্য কোন কার্যকর ব্যবস্থা দেখছেন না বলে অভিমত ব্যক্ত করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৪৪
আপনার মতামত জানানঃ