অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের অতি ব্যবহারের কারণে প্রতিরোধী হয়ে উঠছে জীবাণু, তৈরি হচ্ছে সুপারবাগ। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে অনেক ওষুধে আর কাজ হচ্ছে না। ফলে প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে রোগবালাই। চিকিৎসকরা বলছেন, আগামীতে এটাই সবচেয়ে বড় মহামারি হিসেবে দেখা দিতে পারে। চিকিৎসক এবং গবেষকেরা বলছেন, এর ফলে শিশু এবং হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রোগীরা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।
অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার করোনা মহামারির চয়ে বড় সংকট তৈরি করবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক মো. শারফুদ্দিন আহমেদ।
সোমবার বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর শাহবাগে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কক্ষে জাপানি এক প্রতিনিধিদল সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এলে তাদের কাছে এমন শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
উপাচার্য শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে ২০৫০ সালে করোনাভাইরাসের চেয়ে বেশি সংকটে পড়বে দেশ। মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে ২০৫০ সালে দেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর চেয়ে দ্বিগুণ মানুষ মৃত্যু হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘সবার স্বার্থে মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার রোধ করতে হবে। যত্রতত্র অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধ করতে হবে। রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া যাতে কোনো ফার্মেসি অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রি করতে না পারে, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গকে এগিয়ে আসতে হবে।’
অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের দীর্ঘকালের বন্ধুত্ব। জাপান বাংলাদেশের উন্নয়নের সঙ্গী। জাপান সরকারের সহায়তায় বর্তমানে দেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের মেট্রোরেল চালুর অপেক্ষায় রয়েছে। গাজীপুর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত দ্বিতীয় মেট্রোরেলও জাপানের সহায়তায় নির্মাণ হবে।’
জাপানি প্রতিনিধিদলের পক্ষে ওকোহামা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. মেহরুবা, তোমাকিই ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোম্পানি লিমিটেডের নির্বাহী ব্যবস্থাপক নাকাহার সন্তোষী, তোমাকিই বায়ো লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার ইমাই জুনইয়া এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
বিএসএমএমইউ উপাচার্য ও জাপানি প্রতিনিধিদলের আলাপকালে বাংলাদেশ ও জাপানের ঐতিহ্য, পারস্পরিক সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বের অতীত ইতিহাস উঠে আসে। এতে চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন উপাচার্য শারফুদ্দিন আহমেদ।
জাপান ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালসহ নানাবিধ বিষয়ে গবেষণা সম্পর্কে এ সময় আলোচনা হয়। আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পেলে বিএসএমএমইউ উপাচার্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ নিয়ে জাপানের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী বলে জানান।
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে ২০৫০ সালে করোনাভাইরাসের চেয়ে বেশি সংকটে পড়বে দেশ। মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে ২০৫০ সালে দেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর চেয়ে দ্বিগুণ মানুষ মৃত্যু হতে পারে।’
করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় যথাযথ বিবেচনা ছাড়াই হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দেওয়ার কথা উঠে এসেছে কয়েকটি সমীক্ষায়। এর সঙ্গে যুক্ত গবেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে এই জীবন রক্ষাকারী ওষুধগুলো ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলতে পারে।
গবেষকরা বলেছেন, ব্যয়বহুল অ্যান্টিবায়োটিকের অযৌক্তিক ব্যবহার রোগীদের ওপর অনাবশ্যক আর্থিক চাপে ফেলছে।
অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ও মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর ফলে অপ্রতিরোধ্য ব্যাকটেরিয়া বা ‘সুপারবাগ’-এর প্রাদুর্ভাব বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। সুপারবাগের বিরুদ্ধে প্রচলিত ওষুধগুলো কাজ করে না। মহামারি এই ঝুঁকি আরও বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে। ফলে আজ যেসব অসুখ আমরা সাধারণ বলে মনে করি, ভবিষ্যতে সেগুলোও মানুষের মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।
পেনিসিলিন আবিষ্কারের মাধ্যমে ১৯২৮ সালে পৃথিবীতে অ্যান্টিবায়োটিকের যাত্রা শুরু হয় এবং সে সময় থেকে নতুন নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে মানবদেহে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট। অ্যান্টিবায়োটিকের অপ্রয়োজনীয় ও অপর্যাপ্ত ব্যবহার (ওষুধের মাত্রা ও সময়কাল), কৃষি ও গবাদিপশুতে অনিয়ন্ত্রিত অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার ইত্যাদিই পৃথিবীজুড়ে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট বাড়ার জন্য মূলত দায়ী। বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে লুকিয়ে থাকা রেজিস্ট্যান্ট জিনগুলো প্রাণিদেহে আদান-প্রদান করে এবং খুব সহজে ও অল্প সময়েই তারা বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সক্ষমতা লাভ করে। গ্রাম-পজিটিভ ও গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে যারা এই সক্ষমতা অর্জন করে, তাদের ‘সুপারবাগ বা মাল্টিড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া’ বলা হয়।
একাধিক অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সক্ষমতাসম্পন্ন এসব ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে সৃষ্ট সংক্রমণ নিরাময়ের জন্য পৃথিবীব্যাপী কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের সংখ্যা নিতান্তই কম। এসব সংক্রমণে রোগীর মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেক বেশি। একই সঙ্গে এসব সংক্রমণ হাসপাতালে রোগীর অবস্থানকে দীর্ঘায়িত করে এবং রোগীর চিকিৎসার ব্যয় অনেক বাড়িয়ে দেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট বিশ্ব স্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি। মানুষ ও প্রাণিদেহে অবিবেচকের মতো অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারই এর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পাশাপাশি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে অজ্ঞতা, রোগী ও রোগীর চিকিৎসা সরঞ্জাম ময়লা হাতে ধরা এবং অপ্রয়োজনে বা ভাইরাল ইনফেকশনে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের প্রবণতা বিশ্বজুড়ে এই ভয়াবহতার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আপাতদৃষ্টিতে এর ভয়াবহতা পরিলক্ষিত না হলেও ভবিষ্যতে এটি সর্বোচ্চ ট্র্যাজেডি হতে যাচ্ছে, এ বিষয়ে নিশ্চিতভাবে বলা যায়। ২০০১ সালের দিকে এইচআইভি ভাইরাসের ভয়াবহতা নিয়ে দেশব্যাপী অনেক প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়েছিল, যার দরুন বাংলাদেশে এইচআইভি আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক কম। ব্যাপক ঘনবসতি হওয়ার কারণে বাংলাদেশে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্ট আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। এইচআইভির মতো এটি এত ভয়াবহ না হলেও অদূর ভবিষ্যতে এটি অনেক ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে।
দিন দিন সহজলভ্য অ্যান্টিবায়োটিকের এমন অকার্যকর হয়ে পড়াও চিকিৎসাপদ্ধতিকে কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল করে তুলছে। এর ফলে ক্রমবর্ধমান এই সমস্যার দিকে দৃষ্টি দেওয়া এখন সময়ের দাবি। চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট ও নার্সদের অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারে বিশেষভাবে সচেতন হতে হবে এবং একই লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে জনগণকেও বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণে সচেতন করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫৩
আপনার মতামত জানানঃ