আর্সেনিক দূষিত পানি শিশুদের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ বা রেজিস্ট্যান্সের অন্যতম কারণ বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশে (আইসিডিডিআর’বি)। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বিশ্বব্যাপী মানুষের হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। যদিও অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের প্রধান কারণ অ্যান্টিবায়োটিকের অত্যাধিক ব্যবহার এবং অপব্যবহার, কিন্তু প্রাকৃতিক উপাদান যেমন ভারী ধাতুগুলোও রেজিস্ট্যান্সের কারণ হতে পারে বলে জনিয়েছে সংস্থাটি।
তবে আর্সেনিক দূষিত পানি শিশুদের অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের অন্যতম একটি কারণ বলে আইসিডিডিআরবি এর গবেষণায় উঠে এসেছে। নতুন এই গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা বেশি আছে, এমন এলাকায় শিশুদের মল এবং পানিতে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ই. কোলাই (একটি ব্যাকটেরিয়া যা সাধারণত উষ্ণ রক্তের প্রাণীদের অন্ত্রের নিচের অংশে পাওয়া যায় এবং এটি ডায়রিয়ার অন্যতম কারণ) এর উচ্চ প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা গেছে।
এছাড়াও, কম আর্সেনিক দূষণযুক্ত অঞ্চলের তুলনায় খাবার পানিতে আর্সেনিক দূষণের মাত্রা বেশি, এমন এলাকায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ বেশি দেখা গেছে। গবেষণাটি প্লস প্যাথোজেন্সে প্রকাশিত হয়েছে।
অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ বিশ্বব্যাপী মানুষের হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। যদিও অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের প্রধান কারণ অ্যান্টিবায়োটিকের অত্যধিক ব্যবহার এবং অপব্যবহার। কিন্তু প্রাকৃতিক উপাদান যেমন ভারী ধাতুগুলোও অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের কারণ হতে পারে।
গবেষকরা চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ ও মতলব উপজেলার ১০০টি পরিবারের (প্রত্যেক উপজেলায় ৫০টি) মা ও শিশুদের মল এবং খাবার পানির নমুনা সংগ্রহ করেছেন। হাজীগঞ্জে বসবাসকারী পরিবারের মানুষেরা অগভীর নলকূপের পানি পান করে। এখানকার পানিতে আর্সেনিকের উচ্চ মাত্রা লক্ষ্য করা গেছে। অন্যদিকে, মতলবের পরিবারের সদস্যরা আর্সেনিকমুক্ত গভীর নলকূপ থেকে তাদের খাবার পানি সংগ্রহ করে।
হাজীগঞ্জের ৫০টি পানির নমুনায় মেডিয়ান আর্সেনিকের ঘনত্ব ছিল ৪৮১ ক্রম/খ, যেখানে খাবার পানিতে আর্সেনিকের সর্বোচ্চ সীমা ১০ ক্রম/খ হওয়া উচিত। অন্যদিকে, মতলবের ৫০টি নমুনায় মেডিয়ান আর্সেনিকের ঘনত্ব ছিল ০ ক্রম/খ। সামগ্রিকভাবে, দুটি এলাকার ৮৪ শতাংশ পানি এবং মলের নমুনায় ই. কোলাই উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
মতলবের ২২ শতাংশ, পানির তুলনায় হাজীগঞ্জে ৪৮ শতাংশ পানিতে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ই. কোলাই এর প্রাদুর্ভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি দেখা যায় এবং হাজীগঞ্জের ৯৪ শতাংশ শিশুদের দেহে ব্যাকটেরিয়াটির উপস্থিতি পাওয়া যায়, যা মতলবের শিশুদের ক্ষেত্রে ৭৬ শতাংশ। তবে কোনো এলাকার মায়েদের মধ্যে ই. কোলাই এর উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। এছাড়াও, হাজীগঞ্জের ই. কোলাই-এর উচ্চতর অনুপাত পেনিসিলিন, সেফালোস্পোরিন এবং ক্লোরামফেনিকলসহ একাধিক অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী ছিল।
গবেষকরা আশঙ্কা করেছেন যে, বাংলাদেশে আর্সেনিকের প্রাদুর্ভাবযুক্ত লাকার শিশুদের দেহে আর্সেনিকের উপস্থিতি এবং অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের মধ্যকার সম্পর্ক জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি উদ্বেগের বিষয়। ফলে আর্সেনিকের প্রভাব ও বিস্তার কমানোর প্রচেষ্টা আরও জোরদার করা প্রয়োজন।
গবেষণার প্রধান গবেষক আইসিডিডিআরবি-র অ্যাডজাঙ্কট সায়েন্টিস্ট ও যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম বলেন, আর্সেনিকের মতো ভারী ধাতু পরিবেশে অ্যান্টিবায়োটিকের চেয়ে বেশি স্থিতিশীল। এসকল ধাতু দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাকটেরিয়ার ওপর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। যার ফলাফল হিসেবে মানুষের মধ্যে অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল রেজিস্ট্যান্স গড়ে উঠছে।
গবেষণাটির অন্যতম গবেষক প্রভাত তালুকদার বলেন, আমরা দেখেছি যে আর্সেনিক-প্রতিরোধী ই. কোলাই এর একটি নির্দিষ্ট গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিকের, বিশেষ করে তৃতীয় প্রজন্মের সেফালোস্পোরিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, যা সাধারণত ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। আমাদের বর্তমান গবেষণা এই আইসোলেটগুলোর মধ্যে আর্সেনিক এবং অ্যান্টিবায়োটিকের সহ-প্রতিরোধের প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করে চলেছে।
এখানে আরও উল্লেখ্য, নিউ ইর্য়ক ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ তাদের প্রকাশিত নতুন এক রিপোর্টে বলছে বাংলাদেশের প্রায় দুই কোটি মানুষ এখনও আর্সেনিক দূষিত পানি পান করছে।
‘নেপোটিসম্ অ্যান্ড নেগলেক্ট: দ্য ফেলিং রেসপন্স টু আর্সেনিক ইন দ্য ড্রিঙ্কিং ওয়াটার অফ বাংলাদেশেস্ রুরাল পুওর’ নামে তাদের এই রিপোর্ট বলছে আর্সেনিক দূষণের বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সামনে আসার দুই দশক পরেও বাংলাদেশ সরকার এই সমস্যা সমাধানে মৌলিক পদক্ষেপগুলো নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দাবি বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে লক্ষ লক্ষ দরিদ্র মানুষ এখনও আর্সেনিকযুক্ত ভূগর্ভস্থ পানি পান করছে এবং বাংলাদেশ সরকার জনস্বাস্থ্যের ওপর আর্সেনিকের ঝুঁকি মূলত অগ্রাহ্য করছে।
মাটির নিচে প্রাকৃতিকভাবেই এই আর্সেনিক তৈরি হয় এবং তা ভূগর্ভস্থ পানির সঙ্গে মিশে যেতে পারে। মানবাধিকার এই সংস্থাটি দাবি করছে প্রতিবছর বাংলাদেশে এই আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে মৃত্যু ঘটছে ৪৩ হাজার মানুষের। তারা বলছে আর্সেনিক থেকে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ব্যক্তিবিশেষ এবং তার পরিবারের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
এসডব্লিউএসএস/১৮৪০
আপনার মতামত জানানঃ