চলতি বছর বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান সমস্যা হবে কর্মসংস্থান ও জীবিকার সংকট। এ ছাড়া পরিবেশ বিপর্যয়, সাইবার দুর্বলতা, ডিজিটাল বৈষম্যও অর্থনীতির ঝুঁকির তালিকায় থাকছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বৈশ্বিক ঝুঁকি প্রতিবেদন-২০২২ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব ঝুঁকির কথা উঠে এসেছে। এই সংকটের কারণে প্রবৃদ্ধি আরও বেশি অসম হয়ে ওঠে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদেরা।
এবার নিয়ে ১৭ বার বৈশ্বিক ঝুঁকি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম। প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার ভার্চ্যুয়াল এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। প্রতিবেদনে সংস্থাটি শতাধিক দেশের প্রধান চারটি ঝুঁকি চিহ্নিত করেছে। অর্থনৈতিক ঝুঁকির পাশাপাশি সামাজিক-রাজনৈতিক-পরিবেশগত ঝুঁকির কথাও উঠে এসেছে এই প্রতিবেদনে।
কর্মসংস্থান ও জীবিকার পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য আরেকটি বড় ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিবেদনে। সেটা হলো দেশের কৌশলগত সম্পদের ভূরাজনীতিকীকরণ। বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলা না হলেও এটা স্পষ্ট যে দেশের বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে স্থাপনা নির্মাণে এশিয়ার বৃহৎ দুটি দেশের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছে, তার দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। এই প্রতিযোগিতার সুবিধা হচ্ছে, বাংলাদেশ এখন বড় প্রকল্পে সহজেই বিনিয়োগ পাচ্ছে। কিন্তু এই পরিস্থিতি দীর্ঘদিন চললে উন্নয়নের পরিবেশ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কাও থাকে।
প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সভাপতি বোর্হে বেন্দে, ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদিয়া জাহিদি প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সাদিয়া জাহিদি বলেন, বিশ্বের পরিস্থিতি নিয়ে অধিকাংশ মানুষই আশাহত। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৮৪ শতাংশ মানুষই বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছেন। মাত্র ৪ শতাংশ মানুষ আশাবাদী।
অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ক্রমবর্ধমান অসমতা খুবই উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মহামারির কারণে অসমতা আরও বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে বিশ্বব্যবস্থাই হুমকির মুখে পড়বে।
২০২০ সালের বিশ্ব অর্থনীতির সংকোচন হয়েছে ৩ দশমিক ১ শতাংশ। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম মনে করছে, ২০২১ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ৫ দশমিক ১ শতাংশ। আর ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়াবে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারি না এলে বিশ্ব অর্থনীতি যেখানে থাকত, মহামারির প্রভাবে ২০২৪ সালে বিশ্ব অর্থনীতি তার তুলনায় ২ দশমিক ৩ শতাংশ সংকুচিত হবে।
ক্রমবর্ধমান অসমতা খুবই উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মহামারির কারণে অসমতা আরও বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে বিশ্বব্যবস্থাই হুমকির মুখে পড়বে।
মহামারির শুরু থেকেই সরবরাহ–সংকট বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২০ সালের তুলনায় পণ্যমূল্য ৩০ শতাংশ বেড়েছে। জ্বালানি–সংকট নিয়ে ইউরোপ, রাশিয়া ও চীনের দ্বন্দ্বের কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। তবে এখন সারা বিশ্বে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা যাচ্ছে, তার প্রধান কারণ সরবরাহ–সংকট। অর্থাৎ এই মূল্যস্ফীতি চাহিদাজনিত নয়, বরং সরবরাহজনিত। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরবরাহ–সংকট ২০২২ সালেও চলবে। অর্থাৎ আইএমএফসহ অন্যান্য বৈশ্বিক সংস্থা যে বলে আসছিল, এ বছরের মাঝামাঝি নাগাদ মূল্যস্ফীতি কমে আসবে, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম তা মনে করছে না।
মহামারির কারণে অধিকাংশ দেশেরই রাজস্ব আয় কমেছে। উন্নত দেশগুলো অনেক প্রণোদনা দিয়েছে। ২০২০ সালে বিভিন্ন দেশের সরকারি ঋণ ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে জিডিপির ৯৭ শতাংশে উঠেছে। এতে ডলারের সাপেক্ষে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মুদ্রার অবনমন হতে পারে। জরিপে অংশগ্রহণকারীরা আগামী এক দশকের জন্য ঋণবৃদ্ধিকে গুরুতর সংকট হিসেব চিহ্নিত করেছেন। তবে বাংলাদেশ সরকারের ঋণ এখনো খুব বেশি নয়।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অন্যান্য যেসব ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলো হলো পরিবেশ বিপর্যয়, সাইবার দুর্বলতা, ডিজিটাল অসমতা ইত্যাদি। বিশ্বের প্রায় এক হাজার বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন খাতের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে এই জরিপ করা হয়েছে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলেছে, কভিডের অভিঘাতে বাংলাদেশে কত মানুষের আয় কমেছে বা কত মানুষ কাজ হারিয়েছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সরকার এ নিয়ে বিশেষ জরিপ করেনি। আবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব জরিপ করেছে, তার ফলাফল সরকার মেনে নেয়নি।
সানেম ও ব্র্যাক বিআইজিডি গত প্রায় দুই বছরে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য নিয়ে ধারাবাহিক জরিপ করেছে। তাদের জরিপে একটি বিষয় পরিষ্কার, দেশের অনেক মানুষের আয় কমেছে। অনেক মানুষ আবার তুলনামূলকভাবে উচ্চ দক্ষতার কাজ থেকে নিম্ন দক্ষতার কাজ নিতে বাধ্য হয়েছেন। এমনকি অনেক মানুষ কভিডের শুরুতে ২০২০ সালের মার্চ-এপ্রিলে যে গ্রামে গিয়েছিল, তাদের অনেকেই শহরে ফেরেনি।
ফোরামের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বেকারত্বের সঙ্গে যোগ হয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এতে দেশের দরিদ্র ও অরক্ষিত মানুষ বিপাকে পড়েছে। ফলে এসব মানুষ খাদ্য ব্যয় কমিয়েছেন, যার প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপর।
বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের তুলনায় পণ্যমূল্য এখন ৩০ শতাংশ বেড়েছে। জ্বালানি সংকট নিয়ে ইউরোপ, রাশিয়া ও চীনের দ্বন্দ্বের কারণে পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে। তবে এখন সারা বিশ্বে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা যাচ্ছে, তার প্রধান কারণ সরবরাহ সংকট। অর্থাৎ এই মূল্যস্ফীতি চাহিদাজনিত নয়, বরং সরবরাহজনিত।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সরবরাহ সংকট ২০২২ সালেও চলবে। আইএমএফসহ অন্যান্য বৈশ্বিক সংস্থা এ বছরের মাঝামাঝি মূল্যস্ফীতি কমে আসবে বলে পূর্বাভাস দিলেও সংস্থাটি সেটি মনে করছে না।
বিশ্লেষকরা বলেন, ‘দেশে কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এ রকম প্রবৃদ্ধি আরো বৈষম্য সৃষ্টি করবে। বৈষম্য থাকলে সমাজ টেকসই হয় না। জনগোষ্ঠীর বিরাট একটি অংশ চাকরির বাজারের বাইরে থাকলে তাদের অবদান থেকে সমাজ বঞ্চিত হয়। শুধু তারাই নয়, অর্থনীতিও বঞ্চিত হয়। কোনো না কোনো সময় গিয়ে সেই প্রবৃদ্ধি আর ধরে রাখা সম্ভব হয় না।’
ডিজিটাল বৈষম্যও বাড়ছে উল্লেখ করে তারা বলেন, যারা উচ্চ আয়ের মানুষ তারাই বেশি ডিজিটাল সুবিধা পাচ্ছে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের স্বার্থে সামগ্রিক ডিজিটাল বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে নজর দিতে হবে।
তারা বলেন, ‘ডিজিটাল প্রযুক্তির যত প্রসার ঘটছে, বৈষম্যও তত বাড়ছে। যেকোনো প্রযুক্তির বিকাশের প্রথম পর্যায়ে এই বৈষম্য থাকবে। কিন্তু ডিজিটাল বৈষম্য কমানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২০
আপনার মতামত জানানঃ