রাস্তার ধারে স্তূপাকার আবর্জনা। আর সেই আস্তাকুঁড়ের মধ্যেই খাবারের জন্য হাতড়াচ্ছে দশ বছরের ছোট্ট এক কিশোর। বয়স বড়োজোর দশ বছর। খাবার জোগাড়ে এভাবে ময়লার স্তূপ হাতড়ে বেড়াচ্ছে আফগান শিশুরা।
এই স্তূপ থেকে থেকেই যদি খুঁজে পাওয়া যায় পুনর্ব্যবহারযোগ্য কোনো বাতিল জিনিসপত্র, তবে তা বিক্রি করে জুটবে পেট চালানোর মতো সামান্য খাবার। গোটা আফগানিস্তানের বর্তমান ছবি এমনটাই। অর্থনৈতিক ভরাডুবির কারণেই চরম অনাহারের শিকার লক্ষ লক্ষ আফগান শিশু।
পশ্চিমা-বিশ্ব সমর্থিত ক্ষমতাসীন সরকারের পতন এবং কট্টর ইসলামপন্থী গোষ্ঠী তালিবানের ক্ষমতা দখলের পর গভীর সঙ্কটে পড়েছে আফগানিস্তান। তালিবানের ক্ষমতা দখলের পর দেশটিতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের আন্তর্জাতিক সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই সঙ্কট আরও তীব্র হয়েছে।
গত বছর আগস্ট মাসেই আফগানিস্তানের দখল নিয়েছিল তালিবান। বলতে গেলে, তারপর সবদিক থেকেই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে আফগান শিশুদের ভবিষ্যৎ। তালিবান ক্ষমতায় আসার পর ভেঙে পড়েছিল গোটা দেশের আর্থিক পরিকাঠামো এবং উৎপাদন ব্যবস্থা।
ফলে কাজ হারান বহু মানুষ। সেইসঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় বৈদেশিক বিনিয়োগের পথও। মূলত, আফগানিস্তানের বাজেটের ৮০ শতাংশই আসে বৈদেশিক বিনিয়োগ থেকে। দারিদ্রসীমার নিচে অবস্থিত মানুষদের রেশনেরও বন্দোবস্ত হয় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার তহবিল থেকেই।
তালিবান শাসনে পশ্চিমি অর্থায়ন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে সঞ্চিত খাদ্যভাণ্ডার। তার ওপর শীতের প্রকোপ আরও কঠিনতর করে তুলেছে পরিস্থিতিকে।
বিগত তিন মাস ধরেই আফগানিস্তানজুড়ে ক্রমশ থাবা বসাচ্ছিল দুর্ভিক্ষ। ভয়ঙ্করভাবে যার প্রভাব পড়ছিল আফগান শিশুদের ওপর। এবার সেই পরিস্থিতিই পৌঁছেছে চরমে। রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট অনুযায়ী, আফগানিস্তানের ৯৭ শতাংশ শিশুই অনাহারের শিকার। পাঁচ লক্ষাধিক শিশু ভুগছে অপুষ্টিতে।
তহবিলের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে আফগানিস্তানের অধিকাংশ হাসপাতালও। ছাঁটাই করা হয়েছে মহিলা নার্সদেরও। ফলে ক্রমশ বাড়ছে শিশুমৃত্যুর সংখ্যা। দ্রুত সাহায্য না পৌঁছালে আরও ঘোরতর হয়ে উঠবে পরিস্থিতি, সে ব্যাপারেই সতর্ক করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জের শাখা ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম।
এই দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতিতে ভেঙে পড়েছে আফগানিস্তানের স্বাভাবিক সামাজিক জীবনযাপনও। বাড়ছে অপরাধ। গত কয়েক মাসে দ্রুত হারে বেড়েছে শিশু বিক্রির ঘটনা। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিশুশ্রমও। বাবা-মা কাজ হারানোয়, বাধ্য হয়ে উপার্জনের তাগিদে পথে নেমেছে প্রায় ২০ লক্ষ আফগান শিশু।
কেউ জুতো পালিশ করেই দু’পয়সা উপার্জনের চেষ্টা করছে। কেউ আবার আবর্জনা সংগ্রহ করেই লড়াই করছে অনাহারের বিরুদ্ধে। সবমিলিয়ে চূড়ান্ত এক অমানবিক ছবি গোটা আফগানিস্তানে। কিন্তু করুণাবস্থা দেখার পরেও কি আদৌ বদলাবে বৈদেশিক সংগঠনগুলির মনোভাব?
সূত্র মতে, আফগানিস্তানের ক্রেডিট মার্কেটে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ বহুগুণে বেড়েছে। দেশটিতে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ২০২০ সালে যেখানে ছিল শতকরা ২০ ভাগ, সেটি চলতি বছরে ৫৭ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছে ইউএনডিপি।
এর মধ্যে জাতিসংঘ শিশু বিষয়ক তহবিল জানিয়েছিল, আফগানিস্তানের ৩০ লাখের বেশি শিশু অপুষ্টির সঙ্গে লড়াই করছে। কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে এর মধ্যে ১০ লাখেরও বেশি শিশু মৃত্যুর মুখে পড়বে।
নাগরিক অধিকারকর্মীরা বলছেন, আফগানিস্তানে জরুরি সহায়তা না দেওয়া হলে বিশেষ করে শিশুদের পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ নেবে। এমন বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ।
গত আগস্টে তালিবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের আগে দেশটিতে মানুষের মধ্যে প্রত্যাশা ছিল যে, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সরকার আসন্ন শীতকালীন সংকট মোকাবিলায় সক্ষম হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সহায়তা পাঠাবে। কিন্তু গনির সরকারের পতন আর তালিবানের ক্ষমতা দখলের পর সেই সাহায্য বন্ধ হয়ে গেছে।
পশ্চিমা দেশগুলো আফগানিস্তানে সহায়তা পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। দেশগুলো মনে করছে, এখন যদি সহায়তা পাঠানো হয়, তাহলে সেটা তালিবানের হাতে পড়বে। এতে কাজের কাজ কিছু হবে না। বরং লাভবান হবে তালিবান। সেই কারণে সাধারণ আফগানরা নানা ধরনের সংকটের মধ্যে দিন অতিবাহিত করলেও তাদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে না দেশগুলো।
তালিবানের ক্ষমতা দখলের পর বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভরশীল আফগান অর্থনীতি আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, একটি দেশের মোট দেশীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ১০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি বিদেশি সাহায্য থেকে এলে তাকে সাহায্য নির্ভর দেশ বলে ধরা হয়। আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে জিডিপির প্রায় ৪০ শতাংশই ছিল আন্তর্জাতিক সাহায্য।
দেশটির দারিদ্র্যের কারণে বহু দিন ধরেই প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশ অর্থ সাহায্য করেছে। কিন্তু এই অস্থির পরিস্থিতিতে কেউই আগের মতো আর্থিক সাহায্য করছে না। ফলে সেখানকার অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। বেহাল অর্থনীতির কারণেই মানুষের দারিদ্র্য চরমসীমায় পৌঁছেছে। তাই অবিলম্বে আন্তর্জাতিক মহল ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে বাধ্য।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন সন্ত্রাসী কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকা তালিবান ভেবেছিল সরকার চালানো বোধহয় খুব সহজ। মানুষ খুন করা আর দেশ চালানো যে এক নয়, সেটা তারা বোঝেনি। দুর্নীতি আর বেহাল অর্থনীতি শুরুতেই কাঁধে চেপে বসেছে তালিবান শাসকদের। অর্থনীতি তো দূরের কথা, শান্তি ফেরাতেও হিমশিম খাচ্ছে দখলদার সরকার।
ক্ষমতায় আসার আগে আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তালিবান। বোঝাতে চেয়েছিল, গত দুই দশকে তাদের মানসিকতার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু তারা যে বিন্দুমাত্র নিজেদের মানসিকতা বদলায়নি ক্ষমতায় এসেই চরম বর্বরতার পরিচয় দিয়ে তারা সেটা আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে বুঝিয়ে দিয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক সাহায্যের বহর কমছে।
মনে করা হচ্ছে, তালিবানকে সাহায্য করা মানেই জঙ্গিবাদ ও মাদক চোরাকারবারীদের মদদ। আত্মঘাতী বোমারুদের যেমন তারা প্রকাশ্যেই উৎসাহিত করছে, তেমনি ক্ষমতায় আসার পর ফের মাদক ব্যবসার কথাও বলছেন তালিবান মন্ত্রীরা। নারী ও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বহরও কমেনি। তাই বেশিরভাগ দেশই তালিবানের ওপর ক্ষুব্ধ।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৩৫
আপনার মতামত জানানঃ