দেশজুড়ে মাদকের বিচরণ হলেও রাজধানী ঢাকা মাদকের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে মাদক ভেতরে প্রবেশ করছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে খুব সহজেই ঢাকায় আসছে মাদক।
সড়ক, নৌ, বিমান ও রেলপথে এসব মাদক সহজেই রাজধানীতে প্রবেশ করছে। আর তা ছড়িয়ে পড়ছে রাজধানীর বিভিন্ন মাদক স্পটে। আর তরুণ ও যুব সমাজকে টার্গেট করে রমরমা ব্যবসায় মেতেছেন মাদক ব্যবসায়ীরা।
২০২০ সালে ডিএনসির চারটি সরকারি কেন্দ্রে ১৪ হাজার ৯৫২ জন চিকিৎসা নেন। তবে দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা কত, এ-সংক্রান্ত কোনো সমীক্ষা নেই বলে জানান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
দেশের মাদক পরিস্থিত সম্পর্কে ডিএনসির প্রতিবেদনে বলা হয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের মাদক পরিস্থিতিরও পরিবর্তন হয়েছে। মাদক এখন শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়েছে। বাড়ি থেকে শুরু করে রাস্তা, কর্মক্ষেত্র, বস্তি, পার্ক, বিপণিবিতান এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত মাদক পৌঁছে গেছে। উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত—সব শ্রেণির মানুষ মাদকে আসক্ত হচ্ছেন। উদ্ধারের পরিসংখ্যান এবং তথ্য বলছে, সবচেয়ে বড় বাজার এখন ঢাকা।
প্রতিবেদনে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ডিএনসির কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে পাঁচ বছরে (২০১৬-২০) চিকিৎসা নেওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়। এই পাঁচ বছরে সেখানে ২ হাজার ৭৩৫ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চিকিৎসা নেওয়া মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৬৫ শতাংশের বয়স ৩০ বছরের কম। তাদের মধ্যে একটি বড় অংশই কর্মক্ষম নন।
ডিএনসির তথ্যভান্ডার বলছে, বেকার মাদকসেবীর সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৯ সালে দেশে মোট মাদকসেবীর মধ্যে প্রায় ৪১ শতাংশ ছিলেন বেকার। এক বছরের ব্যবধানে ২০২০ সালে এই হার বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৫৮ শতাংশ। পাঁচ বছর আগে এই হার ছিল প্রায় ৪৪ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ভৌগোলিকভাবে অবস্থানগত দিক থেকে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মাদক রুট গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল এবং গোল্ডেন ক্রিসেন্টের কাছাকাছি। এ কারণে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে আছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি অরক্ষিত সীমান্তের কারণে দেশের অন্তত ২০টি জেলার ৯৫টি রুট দিয়ে মাদক আসার তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, তরুণ মাদকসেবীদের কাছে ইয়াবার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানেও বেশি উদ্ধার হয় ইয়াবা। তবে চিকিৎসা নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে হেরোইনে আসক্ত ৩৪ শতাংশ ও ইয়াবায় আসক্ত ২৮ শতাংশ। অর্থাৎ চিকিৎসা নেওয়া ব্যক্তিদের অর্ধেকের বেশি হেরোইন ও ইয়াবায় আসক্ত। এর বাইরে ফেনসিডিল, গাঁজা, সিরিঞ্জের মাধ্যমে নেওয়া মাদক, মদ্য পান, ঘুমের ওষুধ সেবন এবং গুল সেবনে আসক্ত ব্যক্তি পাওয়া গেছে।
বেকার মাদকসেবীর সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৯ সালে দেশে মোট মাদকসেবীর মধ্যে প্রায় ৪১ শতাংশ ছিলেন বেকার। এক বছরের ব্যবধানে ২০২০ সালে এই হার বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৫৮ শতাংশ। পাঁচ বছর আগে এই হার ছিল প্রায় ৪৪ শতাংশ।
ডিএনসির পরিচালক (চিকিৎসা ও পুনর্বাসন) মাসুদ হোসেন জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, চিকিৎসা নিতে আসা শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই কৌতূহল ও বন্ধুদের প্ররোচনায় প্রথমে ধূমপান করেন। ধীরে ধীরে তারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। তবে চিকিৎসার বাইরে থেকে যাচ্ছেন অধিকাংশ মাদকসেবী।
তিনি বলেন, সরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নেওয়া অধিকাংশ রোগীই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। যারা চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন, তাদের নিয়মিত খোঁজ নেওয়া হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশের মাদকের বাজার অনেকটাই গাঁজা ও ইয়াবার দখলে। আর জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে এগুলোর ব্যবহারও বাড়ছে। বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর অভিযান পরিচালনা কবরে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য ও ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তারও করছে। কিন্তু দেশের ভেতরে মাদক নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না বরং বাড়ছে।
শুধু ঢাকা বিভাগেই সাড়ে তিন হাজার মাদক কারবারি রয়েছে বলে জানিয়েছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। সম্প্রতি সংস্থাটির করা এক তালিকায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ও বাজার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এখন অন্যতম। প্রতিনিয়ত ধরা পড়ছে কারবারিরা। তবু থেমে নেই নতুন মাদকের আমদানি।
দেশে চার ধরনের নতুন মাদক পাওয়া গেছে গত দুই বছরে। এগুলো এখনও ঢাকার বাইরে ছড়ায়নি। এমনই ধারণা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর।
নতুন মাদক সংশ্লিষ্ট যারা গ্রেপ্তার হয়েছে তারা ঢাকা মহানগর এলাকাতেই ধরা পড়েছে। তবে ‘আইস’ বা ‘ক্রিস্টাল মেথ’ এর একটি বড় চালান টেকনাফ থেকে জব্দ করেছিল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। সেটিও ঢাকার জন্য আনা হচ্ছিল। ঢাকামুখী এসব মাদক কারবারিদের আটকানো না গেলে ইয়াবার মতো নতুন মাদকও সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে বলে আশংকা বিশেষজ্ঞদের।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর, পল্লবী, কালশী, জেনেভা ক্যাম্প, কমলাপুর রেলস্টেশন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, চাঁনখারপুল, গেণ্ডারিয়া, টিটিপাড়া, খিলগাঁও, পুরানা পল্টন, বাড্ডা, ভাটারা, বনানী, গুলশান, মতিঝিল, আরামবাগ, যাত্রাবাড়ী, দক্ষিণ বনশ্রী, ধানমণ্ডি, মিরপুর, তেজগাঁও রেলবস্তি, উত্তরা, গাবতলী, কাওরানবাজার রেলবস্তি, রূপনগর, শাহআলী, বংশাল, চকবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায় পাঁচ শতাধিক স্পটে প্রকাশ্যে চলে মাদক কেনাবেচা। আর এসব স্পট নিয়ন্ত্রণ করছে চিহ্নিত গডফাদাররা। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।
এদিকে আজ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযানে মাদক বিক্রি ও সেবনের অভিযোগে ৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এর বিভিন্ন অপরাধ ও গোয়েন্দা বিভাগ।
গ্রেপ্তারের সময় তাদের হেফাজত থেকে ২০৪১ পিস ইয়াবা, ৩২৫ গ্রাম ৪৩ পুরিয়া হেরোইন, ১ কেজি ৩৬৭ গ্রাম ৬৪ পুরিয়া গাঁজা ও ২৪০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধারমূলে জব্দ করা হয়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ এর নিয়মিত মাদকবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে ২৪ ডিসেম্বর সকাল ছয়টা থেকে আজ সকাল ছয়টা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তারসহ মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়।
গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ৪৭টি মামলা রুজু হয়েছে।
২০২০ সালে ডিএমপিতে ১২ হাজার ৬১৯টি মাদকের মামলা হয়েছে। এসময় গ্রেপ্তার হয়েছে ১৮ হাজার ৫৫৫ জন। ২০২১ সালের প্রথম ছয়মাসে ডিএমপিতে মাদক মামলা হয়েছে ৭ হাজার ৪৪৩টি। গ্রেপ্তার হয়েছে ১০ হাজার ৫৫০ জন।
২০১৮ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এক সমীক্ষা পরিচালনা করে। তাতে বলা হয়, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৩৬ লাখ। এর মধ্যে ১৮ বছর বা এর বেশি বয়সী মাদকাসক্ত আছে প্রায় ৩৫ লাখ ৩৫ হাজার। ৭ বছরের বেশি কিন্তু ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোর আছে ৫৬ হাজারের কিছু বেশি।
২০১৩ সালের নভেম্বরে দিল্লিতে জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (ইউএনওডিসি) তাদের রিজিওনাল অফিস থেকে বাংলাদেশের মাদক নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে মাদকসেবীর সংখ্যা ৪০ লাখ ৬০ হাজার বলে জানিয়েছে।
বাংলাদেশে মাদক গ্রহণের প্রবণতা ও ঊর্ধ্বগতি বিবেচনা করলে গত ৮ বছরে এই সংখ্যার সঙ্গে নতুন করে আরও ৫-৭ লাখ যুক্ত হবে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। সেই হিসাবে দেশে এখন মাদকাসক্ত আছে প্রায় ৫০ লাখ।
অবশ্য এ পরিসংখ্যানের সঙ্গে একমত নয় দেশের এনজিওগুলো। তারা দাবি করছে, বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭৫ লাখেরও বেশি।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর কোনও পরিসংখ্যানকেই অস্বীকার করছে না। কারণ এ নিয়ে তাদের নিজস্ব কোনও গবেষণা নেই। তারা সর্বোচ্চ সংখ্যাটাকে বিবেচনা করেই বার্ষিক পরিকল্পনা সাজায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘মাদক’ এক অভিশাপের নাম, এক সর্বনাশা ছোবলের নাম। এটি এমন এক সামাজিক সমস্যা, যা শুধু অপরাধের জন্ম দেয়নি বরং এর বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
বিশ্বব্যাপী প্রায় ২০০ মিলিয়ন মানুষ অবৈধ মাদক গ্রহণের সাথে জড়িত, যার অধিকাংশই তরুণ। আর এই মরণ নেশার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সামাজিক কাঠামোয়, আর্থ সামাজিক উন্নয়নে, ভারসাম্যে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে-এক কথায় জীবনের সর্বত্র। এই অভিশাপটা হাজার গুণ বেড়ে যায় তখনই, যখন শিক্ষার্থীরা এই নেশায় বুঁদ হয়ে যায়। কারণ একটি দেশের ভবিষ্যৎ, সম্ভাবনাময় তরুণরা যখন তাদের জীবন বিপন্ন করে ফেলে, তখন নিজের ধ্বংস টেনে আনে তো বটেই, সাথে দেশের জন্যও তা অশনিসংকেত।
তারা বলেন, হতাশা, কৌতূহল, সঙ্গদোষ এবং মাদকের সহজলভ্যতায় শিক্ষার্থীরা মাদকের নেশায় ঝুঁকে পড়ছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আজ মাদকের ভয়াবহ নেশায় আক্রান্ত। দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সন্ধ্যা নামলেই নির্জন জায়গা এবং হলের কক্ষগুলোতে বসায় মাদকের আসর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে তুলে ধরতে হবে। এছাড়া পড়ালেখার বাইরে তাদেরকে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত করতে হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, যেসব কারণে একজন শিক্ষার্থী মাদকাসক্ত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, সেসব বিষয় সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি তার অল্টারনেটিভ কর্মকৌশলও ঠিক করতে হবে। যাতে করে শিক্ষার্থীরা মাদকাসক্ত হওয়ার সুযোগ না পান। এ অবস্থা থেকে ঘুরে না দাঁড়ালে সামনের দিনের ভয়ঙ্কর পরিণতি রোধ করা যাবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩৬
আপনার মতামত জানানঃ