করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন গত ২৪ নভেম্বর শনাক্ত হয় সাউথ আফ্রিকায়। দ্রুত এটি ছড়িয়ে পড়ে যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, বতসোয়ানা, হংকং ও ইসরায়েলসহ বিশ্বের অনেক দেশে। করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন নিয়ে দুনিয়াজুড়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে এই ধরনকে ‘উদ্বেগজনক ভ্যারিয়েন্ট’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে বিশ্বকে এটি মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের বিরুদ্ধে সুরক্ষায় বাড়তি টিকার প্রয়োজন আছে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। করোনার রূপান্তরিত ধরন ওমিক্রনকে ঠেকাতে উন্নত দেশগুলোকে অতিরিক্ত টিকা মজুত করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। বৃহস্পতিবার জেনেভায় ডব্লিউএইচও সদর দফতরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন সংস্থার ভ্যাকসিন বিভাগের প্রধান কেট ও’ব্রায়েন।
পাশাপাশি, ‘করোনা টিকার তৃতীয় ডোজ ওমিক্রন ঠেকাতে সক্ষম’- বলে যে গুঞ্জন শুরু হয়েছে, সে বিষয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন বলেও জানিয়েছেন ডব্লিউএইচওর এই কর্মকর্তা।
সংবাদ সম্মেলনে কেট ও ব্রায়েন বলেন, ‘সম্প্রতি বলা হচ্ছে, করোনা টিকার তৃতীয় ডোজ ওমিক্রনের বিরুদ্ধে কার্যকর সুরক্ষা দিতে পারে এবং এই বিষয়টিতে আমরা উদ্বিগ্ন।’
‘আমাদের উদ্বেগের কারণ হলো, ধনী দেশগুলো নিজেদের জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে যদি ফের টিকা মজুত করা শুরু করে তাহলে বিশ্বজুড়ে টিকার বণ্টন ও সরবরাহ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উন্নত দেশগুলোর টিকার মজুত আরও বাড়বে এবং দরিদ্র দেশগুলো এখনও যে কিছু পরিমাণ টিকা পাচ্ছে, তাতে টান পড়বে।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টিকা পরামর্শক কেট ও ব্রায়েন সতর্ক করে বলেন, টিকার বাড়তি ডোজের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে যথাযথ প্রমাণ না মেলা পর্যন্ত তা মজুত করার পেছনে ছুটলে তাতে বিশ্বজুড়ে বিদ্যমান টিকাবৈষম্য আরও প্রকট হবে।
ও ব্রায়েন আরও বলেন, ওমিক্রন পরিস্থিতি যেদিকেই যাক না কেন, ধনী দেশগুলো আবারও টিকার বাড়তি মজুতের পথে হাঁটছে।
এর আগে গত বুধবার ফাইজার ও বায়োএনটেকের প্রাথমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে বলা হয়, তাদের টিকার বুস্টার ডোজ করোনার ওমিক্রন ধরনের বিরুদ্ধে কার্যকর সুরক্ষা গড়ে তোলে। স্বল্প পরিসরে চালানো এক গবেষণা শেষে প্রতিষ্ঠান দুটি জানিয়েছে, করোনার অন্য ধরনগুলোর বিরুদ্ধে টিকার দুটি ডোজ যে পরিমাণ সুরক্ষা দিয়ে এসেছে, ওমিক্রনের ক্ষেত্রে একই সুরক্ষা পেতে প্রয়োজন হবে বাড়তি একটি ডোজের।
বুস্টার ডোজ নিয়ে এক বিবৃতি দিয়েছেন ফাইজারের প্রধান নির্বাহী অ্যালবার্ট বোরলা। সেখানে তিনি জানান, টিকার বাড়তি একটি ডোজ ওমিক্রনের বিরুদ্ধে সুরক্ষা বাড়াবে। করোনার বিস্তার ঠেকাতে যত বেশি সম্ভব মানুষকে টিকার পূর্ণ ডোজ দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সর্বোত্তম উপায় হিসেবে রয়েছে বুস্টার ডোজ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়, ফাইজার ও বায়োএনটেকের তথ্য তারা পরীক্ষা করছে। ও’ব্রায়েন বলেন, অতিরিক্ত ডোজ অমিক্রনের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত সুরক্ষার ক্ষেত্রে উপকারী হলেও এখনো তা প্রাথমিক অবস্থায় আছে।
কেট ও’ব্রায়েন জানিয়েছেন, এখনই এই বিষয়ে এত নিশ্চিত হওয়ার মতো সময় আসেনি।
তিনি বলেন, ‘এটা সঠিক যে করোনা টিকার তৃতীয় ডোজ আপনাকে অধিক সুরক্ষা দেবে, কিন্তু কোনো কোম্পানির তৃতীয় ডোজের টিকা নিলেই ওমিক্রনের বিরুদ্ধে কার্যকর সুরক্ষা পাওয়া যাবে—এখনও এটি নিশ্চিত হওয়ার সময় আসেনি। এ বিষয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন।’
সংবাদ সম্মেলনে ডব্লিউএইচওর ভ্যাকসিন বিভাগের পরিচালক জানান, বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে এতদিন কোভ্যাক্সের মাধ্যমে দরিদ্র দেশগুলোতে নিয়মিতভাবে টিকা পাঠানো যায়নি। গত দুই মাস ধরে দরিদ্র দেশগুলোতে টিকার ডোজ পাঠানো কিছুটা নিয়মিত হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এবং আমরা এটি অব্যাহত রাখতে চাই এবং উন্নত দেশগুলোর কাছে আমাদের আহ্বান থাকবে—তাদের টিকা মজুতের প্রবণতার কারণে যেন এই প্রবাহ বাধাগ্রস্ত না হয়।’
‘আমাদের মনে রাখতে হবে- যতক্ষন পর্যন্ত এই বিশ্ব মহামারিমুক্ত না হচ্ছে, ততক্ষন আমরা কেউই নিরাপদ নই।’
এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল বলেছে, করোনা থেকে সুরক্ষায় একই টিকার দুটি ডোজ দেওয়া ভালো। তবে যেসব দেশে টিকার স্বল্পতা রয়েছে, সেখানে মিশ্র ডোজ দেওয়া ভালো সমাধান। গতকাল এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যান আলেজান্দ্রো ক্রাভিয়েতো বলেন, ‘আমরা এখনো মনে করি, দুটি প্রাথমিক ডোজের জন্য একই ভ্যাকসিন ব্যবহার করাই সর্বোত্তম পন্থা।’
এর আগে সপ্তাহের শুরুতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়, অ্যাস্ট্রাজেনেকা বা ফাইজারের টিকার সঙ্গে অন্য টিকার ডোজ মেশালে তাতে সবচেয়ে কম সুরক্ষা পাওয়া যায়।
স্বল্প ও মাঝারি আয়ের দেশগুলোকে করোনা টিকা সহায়তা দিতে এক বছর আগে ‘কোভ্যাক্স’ নামে একটি প্রকল্প খুলেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং টিকা সহায়তা প্রদানকারী আন্তর্জাতিক জোট গ্যাভি অ্যালায়েন্স।
তবে প্রকল্প চালু করার প্রাথমিক পর্যায়ে দরিদ্র দেশগুলোতে যে পরিমাণ টিকা সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছিল, এক বছরে তার ধারে কাছেও পৌঁছাতে পারেনি কোভ্যাক্স। তার প্রথম কারণ—বরাবরই চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় টিকার ডোজের সংকটে ভুগেছে কোভ্যাক্স এবং দ্বিতীয় কারণটি হলো—উন্নত দেশগুলো এই প্রকল্পে তাদের মজুত থেকে যেসব টিকার ডোজ দিচ্ছে—সেগুলো বড় অংশ অল্প সময়ের মধ্যেই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
অর্থাৎ, গণটিকাদান কর্মসূচীতে ব্যবহারের জন্য কেনা যেসব টিকা শেষ পর্যন্ত ব্যবহার হয়নি এবং দীর্ঘসময় পড়ে থাকার কারণে আর অল্প কিছু দিনের মধ্যেই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাবে—এমন সব ডোজই কোভ্যাক্সে দান করছে অনেক ধনী রাষ্ট্র।
ফলে দরিদ্র দেশগুলোতে টিকার ডোজ পাঠিয়ে কোনো লাভ হচ্ছে না। অনেকক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ডোজ পৌঁছানোর পর তা টিকাদান কর্মসূচিতে ব্যবহার করার আগেই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে সেগুলো।
‘আমাদের উদ্বেগের কারণ হলো, ধনী দেশগুলো নিজেদের জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে যদি ফের টিকা মজুত করা শুরু করে তাহলে বিশ্বজুড়ে টিকার বণ্টন ও সরবরাহ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উন্নত দেশগুলোর টিকার মজুত আরও বাড়বে এবং দরিদ্র দেশগুলো এখনও যে কিছু পরিমাণ টিকা পাচ্ছে, তাতে টান পড়বে।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভ্যাকসিন বিভাগের পরিচালক কেট ও’ব্রায়েন বৃহস্পতিবার জেনেভায় ডব্লিউ এইচ ও কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে কোভ্যাক্সের এসব সমস্যা তুলে ধরেন। তিনি আরও বলেন, পর্যাপ্ত পরিমাণে টিকা পাঠিয়েও আফ্রিায় টিকাদান পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হচ্ছে না; এবং তার একটি বড় কারণ, দেশগুলোতে টিকার চালান পাঠানোর অল্প কিছু দিনের মধ্যেই সেগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করে তুলতে নাইজেরিয়ার উদাহারণ টেনেছেন ডব্লিউেএইচওর এই কর্মকর্তা। গত মাসে কোভ্যাক্সের পক্ষ থেকে ১০ লাখ ডোজ করোনা টিকা পাঠানো হয়েছিল নাইজেরিয়া; কিন্তু এই টিকাগুলো নাইজেরিয়ায় পৌঁছানোর দু’-তিনদিনের মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায় টিকার দুই ডোজ।
করোনাকে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণার পরপর টিকা পেতে উঠেপড়ে লাগে কয়েকটি দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পই অধিকাংশ টিকা নিজের দেশের জন্য অগ্রিম কিনে নেয়ার চেষ্টা করেন। এরপর ব্রিটেন, ইতালি, স্পেন, ব্রাজিলও একই ধরনের পদক্ষেপ নেয়। ধনী কতগুলো দেশ নিজেদের লোকজনের কথা ভেবে টিকা সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় উন্নীত হতে চায়, অন্যদিকে স্বাভাবিক টিকাদান থেকেও পিছিয়ে যায় স্বল্পোন্নত দেশগুলো। ধনী দেশগুলো দ্রুত টিকাদান কার্যক্রম এগিয়ে নিতে পারলেও পিছিয়ে আছে স্বল্পোন্নত দেশগুলো। দরিদ্র দেশগুলোতে ধীর গতিতে টিকা সরবরাহের অর্থ করোনা মহামারি দীর্ঘস্থায়ী হওয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলেছিল, করোনা মহামারি ২০২২ সালেও থাকতে পারে। করোনা মহামারি দীর্ঘ হওয়ার আশঙ্কার পেছনে দরিদ্র দেশগুলোর প্রয়োজনীয়সংখ্যক টিকা না পাওয়ার বিষয়টি সামনে এনেছে ডব্লিউএইচও।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘মহামারির এ বিশ্বে আমরা কেউই নিরাপদ নই, যতক্ষণ না প্রত্যেকেই নিরাপদ হই। আমরা কেউই দৌড়ে জিতব না, যতক্ষণ না প্রত্যেকেই জিতব’। বিশ্ব টিকা জোগান দাতা ‘কোভ্যাক্সে’র এই স্লোগান টিকা বৈষম্যহীন বিশ্ব গড়ার এক অনন্য স্বপ্নছোঁয়া স্লোগান। কথা ছিল সবার জন্য টিকা, এখন কতকের জন্য টিকা আর কতকের জন্য টিকা ভিক্ষা। বিশ্বব্যাপী টিকা বৈষম্যের এ দুর্দশা দেখে মনে পড়ছে আরেকটি অগ্নিঝরা স্লোগান। আর তা হলো ‘টিকা বৈষম্যের এ আগুন, ছড়াবে বহুগুণ সবখানে’। একসময় ছিল টিকা অসচেতনতায় ভরা বিশ্ব ইতিহাস, যার জন্য দায়ী করা হতো বিশ্ব জনতাকে; আর এখন রচিত হতে যাচ্ছে টিকা বৈষম্যে ভরা আরেকটি নতুন ইতিহাস, যার জন্য দায়ী করতে হবে পশ্চিমা বিশ্বকে। টিকাকরণের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বব্যাপী একসাথে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ গড়ে তোলা, ঝুঁকিযুক্ত দুর্বলদের ঝুঁকিমুক্ত করা। আর এখন হবে শুধু সবলরা ঝুঁকিমুক্ত আর দুর্বল-অবলারা হবে আরো ঝুঁকিযুক্ত, আরো দুর্বল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আসলে এখন পৃথিবীতে একটি নতুন ধরনের জাতীয়তাবাদ জন্ম নিয়েছে— ‘টিকা জাতীয়তাবাদ’। যেখানে ধনী দেশেরা লাভবান হচ্ছে। কিন্তু যদি পৃথিবীর সব দেশে টিকাকরণ প্রক্রিয়া ঠিকমতো না হয় তাহলে এই মহামারি আরও অনেক বছর প্রলম্বিত হতে পারে। বিশ্বনেতৃত্বের এখন সময় এসেছে টিকা ও অন্যান্য স্বাস্থ্যপ্রযুক্তিতে বিশ্ব স্বাস্থ্যের জগতে সবার সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করার, যা অবশ্যই সবার কাছে সুলভ হবে এবং সবার কাছে পৌঁছাবে। যদি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বা ‘ক্রিটিক্যাল মাস’-এর কাছে টিকা পৌঁছানোর এই কাজটি সফলভাবে করা যায় তাহলে পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষের শরীরে কৃত্রিমভাবে ইমিউনিটি তৈরি করা যাবে, যেমনটা স্মল পক্স বা পোলিওর ক্ষেত্রে হয়েছে। এর পরিণতিতে এই রোগটির বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি বা গোষ্ঠী অনাক্রমণ্যতা গড়ে উঠবে এবং রোগটি আপাতত নিস্তেজ অবস্থায় চলে যাবে (যদিও এর জ্ঞাতি-গোষ্ঠীরা আবার সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে কখন পরিস্থিতি বুঝে মানুষের শরীরে বাসা বাঁধা যায়)।
তারা বলেন, এ কথা ঠিক যে, করোনার টিকা সবার জন্য সহজলভ্য করার কাজটি রাতারাতি হবে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে যাদের সামর্থ্য আছে তারাই শুধু এই টিকা পাবে। এজন্য উদ্যোগ নিতে হবে। উন্নত দেশগুলোকে মনে রাখতে হবে যে, যেসব জায়গায় এই টিকা সবচেয়ে বেশি দরকার, সেখানে যদি এটা না দেওয়া যায়, তাহলে এই মহামারি চলতেই থাকবে এবং শেষ পর্যন্ত তারাও নিরাপদ থাকবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫২৮
আপনার মতামত জানানঃ