বিশ্বের সবদেশের নারীরাই কমবেশি সহিংসতার শিকার হন। বর্তমানে নারীর প্রতি সহিংসতা আরও বেড়েছে। করোনা মহামারির পর থেকে নারীর অবস্থা আরও নাজুক হয়ে উঠেছে।
দিন দিন বাড়ছে নারীর প্রতি নির্যাতনের মাত্রা। পরিবার, সমাজ কোথাও রেহাই পাচ্ছেন না তারা। নারী নির্যাতন বলতে নারীদের ওপর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক যে কোনো ধরনের নিপীড়ন ও নির্যাতনকে বোঝায়।
গতকাল ছিল আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। এদিন নারীর প্রতি সহিংসতার অবসান চেয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ হয়েছে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এনডিটিভি ও বার্তা সংস্থা এএফপি। প্রতিবেদনে বলা হয়, বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে এই বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়।
মেক্সিকো সিটি, মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, প্যারিস ও লন্ডনের রাস্তায় হাজারো মানুষ বিক্ষোভে শামিল হন। চিলি, ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া, উরুগুয়ে, কোস্টারিকা, পানামা, কলম্বিয়াতেও বিক্ষোভ হয়েছে।
মেক্সিকোতে প্রতিদিন প্রায় ১০ জন নারী হত্যার শিকার হন। দেশটিতে নারীর প্রতি সহিংসতার অবসান চেয়ে হওয়া বিক্ষোভে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের হাতে থাকা ব্যানারে লেখা ছিল, ‘তারা মারা যাননি, তাদের হত্যা করা হয়েছে’।
মেক্সিকো সিটিতে কর্মসূচি চলাকালে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে পুলিশ। এ সময় কিছু বিক্ষোভকারী পুলিশের আত্মরক্ষার সরঞ্জাম কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন।
এদিকে তুরস্ক সরকারকে নারীর প্রতি সুরক্ষামূলক একটি আন্তর্জাতিক চুক্তিতে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে ইস্তাম্বুলের রাস্তায় বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। এতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, তুরস্কে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৩৪৫ জন নারী হত্যাকাণ্ডের শিকার।
২০১১ সালে নারীদের সুরক্ষায় স্বাক্ষরিত হয় ইস্তাম্বুল কনভেনশন। এতে স্বাক্ষর করে ৪৫টি দেশ। প্রথম দেশ হিসেবে তুরস্ক এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও গত বছরের জুলাইতে প্রথম দেশ হিসেবেই তারা এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়। ওই সময় তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান দাবি করেন, সমকামিতাকে স্বাভাবিক করতে চাওয়া মানুষেরা এই উদ্যোগ ছিনিয়ে নিয়েছে।
গত বছরের মার্চে এরদোয়ান যখন প্রথম প্রত্যাহারের আগ্রহের কথা ঘোষণা করেন তখনও তুর্কি নারীরা বিক্ষোভ করেন। জুলাইতে আনুষ্ঠানিকভাবে তুরস্ক বেরিয়ে যাওয়ার পরও বড় আকারের বিক্ষোভ হয়।
এরদোয়ান দাবি করে আসছেন, বিদ্যমান আইন দিয়েই তুরস্ক যথেষ্ট পরিমাণে নারী সুরক্ষা দিচ্ছে। তবে নারী মানবাধিকার গ্রুপগুলো বলছে, কনভেনশনে যেসব গুরুত্বপূর্ণ আইনের রোডম্যাপ বর্ণনা করা হয়, সেগুলো তুর্কি সরকার কখনোই বাস্তবায়ন করেনি।
তুরস্কের একটি বেসরকারি সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, ২০২১ সালে এখন পর্যন্ত দেশটিতে পুরুষের হাতে হত্যার শিকার হয়েছে ২৮৫ নারী। বৃহস্পতিবার তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বীকার করেন গত বছরের চেয়ে এই সংখ্যা অনেক বেশি। তবে সরকার এর পরিমাণ নামিয়ে আনতে কাজ করছে।
স্পেনের মাদ্রিদ ও বার্সেলোনার রাস্তায় বেগুনি পতাকা হাতে নিয়ে বিক্ষোভ করেন হাজারো মানুষ। স্পেনের রাজধানীতে বিক্ষোভকারীদের মুখে ছিলো বেগুনি রঙের মাস্ক। এ ছাড়া একই রঙের টুপি ও স্কার্ফে ঢাকা ছিলো তাদের মাথা। তাদের হাতে থাকা ব্যানারে লেখা ছিলো, ‘নারীর প্রতি সহিংসতার এখন সমাধান চাই’।
স্পেনের বিভিন্ন ভবনও বেগুনি রঙে সাজানো হয়েছিলো। এসব ভবনের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দেন, ‘আমাদের সবাই এখানে নেই, নিহত ব্যক্তিরা তো আর উপস্থিত হতে পারেননি।’ তাদের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিলো, ‘আর একটি মৃত্যুও চাই না’।
জাতিসংঘের আঞ্চলিক কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে ২০২০ সালে কমপক্ষে ৪ হাজার ৯১ জন নারী জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার শিকার হয়ে মারা গেছেন।
জাতিসংঘের লৈঙ্গিক সমতাবিষয়ক সংস্থা ইউএন উইমেনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে একজন শারীরিক কিংবা যৌন সহিংসতার শিকার হন।
জাতিসংঘের লৈঙ্গিক সমতাবিষয়ক সংস্থা ইউএন উইমেনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে একজন শারীরিক কিংবা যৌন সহিংসতার শিকার হন।
এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়তনে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে নারী আন্দোলন, মানবাধিকার আন্দোলন ও সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ রয়েছে। তার পরও নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা ও ভয়াবহতা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। করোনা মহামারি এই সংকটকে আরও গভীর করছে।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনকালে দেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নে লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এখনো সম্ভব হয়নি। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে নারী আন্দোলন, মানবাধিকার আন্দোলন ও সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ আছে। তা সত্ত্বেও নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা ও ভয়াবহতা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।
সংগঠনের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতার ইস্যুতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যই যথেষ্ট নয়। তবে প্রকাশিত তথ্যের ওপর তাদের সংগঠন সহিংসতার শিকার নারীদের জন্য আইনি সহায়তা দিয়ে থাকেন। তাদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে সহায়তা করেন। পাশাপাশি নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে কেন্দ্র ও জেলাপর্যায়ে সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের পাশাপাশি দিনে দিনে মানবসমাজে নতুন অপরাধের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। যার অন্যতম উদাহরণ ‘নারীর প্রতি সহিংসতা’ বা নারী নির্যাতন। বর্তমানে ধর্ষণ ও পারিবারিক নির্যাতন ভয়ংকর অবস্থায় পৌঁছে গেছে। বিশেষ করে নারী নির্যাতনের মতো ঘটনা ইদানীং ব্যাপক আকারে বেড়েছে। এ নিয়ে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে এর কোনো প্রতিকার হবে না।
সমাজে নারীদের প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানসিকভাবে অপদস্ত হতে হচ্ছে। প্রাচীন আমলের বিভিন্ন সামাজিকপ্রথা, কুসংস্কার এমনকি লোকলজ্জার ভয় কাটিয়ে নারী এখন পুরুষের পাশাপাশি পথ চলতে শুরু করেছে। কিন্তু এসময়ে এসেও পথেঘাটে, বাস-ট্রেনে এমনকি বাসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কর্মস্থলেও নারীরা ব্যাপকহারে নির্যাতিত হচ্ছে।
নারীর ওপর পুরুষের অবিরাম ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে সম্প্রতি এই নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে চলেছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। প্রতিদিন দেশের কোনো না কোনো স্থান থেকে ধর্ষণের খবর পাওয়া যায়। প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই পাওয়া যায় একাধিক ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের খবর। পৃথিবীব্যাপী এসব সহিংসতার শিকার হয়ে প্রতি বছর অসংখ্য নারীর মৃত্যু হচ্ছে।
তারা বলেন, নারী সহিংসতা রোধে আছে আইন, বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক চুক্তি। কিন্তু এগুলোর তেমন কোনো বাস্তবায়ন নেই। এসব আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষও সচেতন নয়। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে তাই প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। সহিংসতা রোধে প্রচলিত আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি নারীদেরও সোচ্চার হতে হবে। কথা বলতে হবে নিজ অধিকার আদায়ে।
এ সমস্যা মোকাবিলায় নারীর ক্ষমতায়নের ওপর জোর দেয়া দরকার। উন্নত আইনব্যবস্থা, সামাজিক রীতিনীতি বদল ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির দিক থেকে পুরুষেরও এগিয়ে আসা দরকার। নারী নির্যাতন প্রতিরোধের দায়িত্ব শুধু পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ ও সামাজিক সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ সমাবেশই নয় বরং ব্যক্তি, সমাজ ও সরকারের মূল দায়িত্বটা পালন করা জরুরি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫০
আপনার মতামত জানানঃ