যে হারে নারীর অগ্রগতি হয়েছে সে হারে কমেনি নারীর প্রতি সহিংসতা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটলেও নারীর প্রতি সহিংসতা কমেনি আশানুরূপ। বরং ক্রমান্বয়ে এ সহিংসতা বেড়েই চলেছে। এমনকি করোনাকালে সহিংসতা আরো বেড়েছে। করোনা সংকটের কারণে চলমান অবরুদ্ধ ও আতঙ্কগ্রস্ত পরিস্থিতিতে যেখানে নারীরা অধিক সহানুভূতি পাওয়ার কথা, সেখানে তাদের প্রতি সহিংসতার হার বেড়ে যাওয়া অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
ভার্চুয়াল আদালতের কারণে গত বছরের তুলনায় চলতি বছর মামলা নিষ্পত্তি বেশি হলেও বেড়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা। মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে উত্থাপন করা মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর কার্যাবলি সম্পর্কিত বার্ষিক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।
উল্লেখ্য, রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী, প্রতি অর্থবছরে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সম্পাদিত কার্যাবলি সম্পর্কিত বার্ষিক প্রতিবেদন মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হয়ে থাকে।
সচিবালয়ে সোমবার মন্ত্রিসভা বৈঠকে এই প্রতিবেদন অনুমোদন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এ বৈঠক হয়। এতে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত ছিলেন সরকার প্রধান। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে আদালত চালু করার কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৯১ হাজার মামলা এ বছর কমে এসেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬ লাখ ৬১ হাজার মামলা ছিল, আর ২০২০-২১ এর জুন মাসের শেষে আছে ৫ লাখ ৬৯ হাজার ৩৬২। অর্থাৎ প্রায় ৯১ হাজারের মতো মামলা ডিস্পোজাল হয়ে গেছে।
‘২০১৯-২০ এ ডাকাতি মামলা ছিল ৩৩৬টি, এ বছর ৩২১। রাহাজানি ছিল ৯১৯, এ বছর বেড়ে হয়েছে এক হাজার ৪৮। অস্ত্র আইনের মামলা ছিল ২ হাজার ১৬৬টি, এ বছর ছিল ১ হাজার ৭৪৭টি। খুন ছিল আগের বছর ৩ হাজার ৪৮৫, এবছর ৩ হাজার ৪৫৮।
তিনি বলেন, ‘গত বছর ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৮৪২, এবছর ছিল ৭ হাজার ২২২। নারী নির্যাতন ছিল ১২ হাজার ৬৬০ এবার ১৪ হাজার ৫৮৭টি।
‘সার্বিক মূল্যায়নে মামলা আগের চেয়ে কমেছে। এর কারণ ২০১৯-২০ এ তো আমাদের ডিজিটাল কোর্ট শুরু হয়নি। গতবছর ডিজিটাল কোর্ট হওয়ার ফলে আইনজীবীরা বাসা থেকে বা অন্য শহরে থাকলেও অনলাইনে মামলাগুলো হ্যান্ডেল করতে পেরেছেন। এতে খুব জলদি ডিস্পোজাল করা গেছে।’
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ৩০ জুন পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির রিপোর্ট আমাদের কাছে আসেনি। এখন ইলেকশন বা তেলে দাম বৃদ্ধির ঘটনায় যেগুলো, সেগুলোও আসেনি।
এদিকে ইন্টারনেট সুবিধাসহ প্রযুক্তির নানামাত্রিক ব্যবহার যতোই সহজলভ্য হচ্ছে ততোই সাইবার জগতে নারীদের সহিংসতার ঘটনা বাড়ছে। দেশের ৬৮ শতাংশ নারী সাইবার জগতে নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া এই নারীদের বেশির ভাগই তরুণী। ১৮-২৪ বছর বয়সী এসব তরুণীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ঘটছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এদিকে সাইবার হয়রানির শিকার ৮৮ শতাংশ নারীই মামলা করেন না।
সাইবার জগতে নারীদের হয়রানি প্রতিরোধে গত বছর ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’ নামের একটি সেবা চালু করে পুলিশ সদর দপ্তর। প্রতিষ্ঠার পর থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১২ হাজার ৬৪১ জন ভুক্তভোগী নারী সাইবার জগতে হয়রানিসংক্রান্ত বিষয়ে যোগাযোগ করেছেন এ সেবায়। তাদের মধ্যে সেবা পেয়েছেন ৮ হাজার ২২১ জন। কিন্তু অভিযোগকারীদের বেশির ভাগই মামলা বা জিডি করতে চান না। শুধু হয়রানি করা ফেক আইডি কিংবা কনটেন্ট ডিলিটের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতে চেয়েছেন।
‘গত বছর ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৮৪২, এবছর ছিল ৭ হাজার ২২২। নারী নির্যাতন ছিল ১২ হাজার ৬৬০ এবার ১৪ হাজার ৫৮৭টি।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন প্রতিষ্ঠার পর ১৭ হাজার ২৮০ জন সেবাপ্রত্যাশী যোগাযোগ করেছেন। এর মধ্যে হয়রানিসংক্রান্ত ১২ হাজার ৬৪১ অভিযোগের মধ্যে ৮ হাজার ২২১ জনকে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রযুক্তিগত ও আইনগত পরামর্শ এবং সহায়তা দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ করা ১২ হাজার ৬৪১ জন ভুক্তভোগীর মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ জিডি বা মামলা করেছেন। অর্থাৎ ৮৮ শতাংশ ভুক্তভোগী মামলা করেননি। যে ১২ শতাংশ ভুক্তভোগী মামলা করেছেন, তাদের মধ্যে আবার ৮৭ শতাংশ ভুক্তভোগী অভিযুক্তের পরিচয় ও অবস্থান শনাক্তের পর তাদের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনগত প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে সহযোগিতায় আগ্রহী ছিলেন না।
সম্প্রতি জর্জটাউন ইনস্টিটিউট ফর উইমেন, পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি (জিআইডব্লিউপিএস) নারীদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রকাশিত প্রতিবেদন জানায়, ‘নারী, শান্তি ও নিরাপত্তা সূচক-২০২১’-এ বিশ্বের ১৭০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫২তম। সূচকে নারী নিরাপত্তায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও ভুটান বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে এবং পাকিস্তান ও আফগানিস্তান পিছিয়ে রয়েছে।
সূচকে তিনটি মৌলিক বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে অন্তর্ভুক্তি, ন্যায্যতা ও নিরাপত্তা। এক্ষেত্রে মোট ১১টি সূচক ব্যবহার করা হয়েছে। অন্তর্ভুক্তির সূচকগুলো হচ্ছে শিক্ষা, অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি, কর্মসংস্থান, মোবাইল ব্যবহার ও সংসদে প্রতিনিধিত্ব। ন্যায্যতার সূচকগুলো হচ্ছে আইনগত বৈষম্য না থাকা, পুত্র সন্তানের প্রতি পক্ষপাত এবং বৈষম্যমূলক রীতিনীতিকে। নিরাপত্তার সূচকগুলো হচ্ছে স্বামী বা সঙ্গীর নির্যাতন, সামাজিক নিরাপত্তা ও কাঠামোগত সহিংসতা।
সূচক অনুযায়ী, নারীর কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ১০০-এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ৩৫ দশমিক ২; স্কুলে পড়ার ক্ষেত্রে স্কোর ১৫-এর মধ্যে ৬ এবং আর্থিক ক্ষেত্রে নারীর অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে ১০০-এর মধ্যে ৩৫ দশমিক ৮ স্কোর করেছে বাংলাদেশ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। অগ্রগতি হয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকেও। এ সময়ে পরিবর্তন এসেছে নারীর অবস্থা ও অবস্থানেও। বর্তমানে সমাজের প্রায় সব খাতেই নারীর অংশগ্রহণ দৃশ্যমান হচ্ছে। শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে মেয়েদের উপস্থিতি এখন শতভাগ। পোশাক শিল্পের কৃতিত্বের সিংহভাগই নারীর। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে— বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশই যেখানে নারী, সেখানে অগ্রগতি দৃশ্যমান হচ্ছে খুব অল্পসংখ্যক নারীর মধ্যেই।
নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন ছাড়া দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। সরকার দেশের নারী সমাজের সার্বিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। সরকার নারী শিক্ষার বিস্তার ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, কর্মক্ষেত্রে অবাধ প্রবেশ ও নীতি নির্ধারণে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বহুমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। এরপরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে ঘরে-বাইরে নারীর নিরাপত্তা।
সম্প্রতি অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ এবং ব্র্যাকের দুটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের শতকরা ৮৮ জন নারী রাস্তায় চলার পথে যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্যের শিকার হন, যেখানে সিংহভাগ পারপেট্রেটরই গণপরিবহনের চালক ও হেলপাররা। দেশব্যাপী যে হারে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতেও উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, এ কোন বর্বরতার মধ্যে আমরা বসবাস করছি? ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের খবর যত বেশি পাওয়া যায়, এসব অপরাধের দায়ে অপরাধীদের শাস্তির দৃষ্টান্ত তার চেয়ে অনেক কম। ধর্ষককামীরা এত দিনে জেনে গেছেন, ধর্ষণ করলে তাদের খুব একটা সমস্যা হয় না। এর প্রতিকার নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল একটি বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ। বাংলাদেশের সংবিধানেও এর প্রতিফলন আছে। কিন্তু ৫০ বছরে কি আমরা বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণ করতে পেরেছি? সিডও সনদের শর্ত বাস্তবায়ন করতে হলেও নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করার কোনো বিকল্প নেই। সর্বোপরি আমরা বলতে পারি যে, নারীর নিরাপত্তা-মর্যাদা ও ক্ষমতায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি আধুনিক কল্যাণমুখী ও কার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯১০
আপনার মতামত জানানঃ