বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের শাসনামলে গুম, খুন ও ফাঁসির শিকার বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সামরিক কর্মকর্তাদের নামের তালিকা প্রকাশের দাবিতে সোমবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ঘেরাও করে একটি সংগঠনের সদস্যরা। ঘেরাও কর্মসূচির মধ্যে কার্যালয়ে ঢোকার সময় মন্ত্রীর গাড়ি দেখতে পেয়ে বিক্ষোভ করেন সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা। ওই সময় গাড়ি থেকে নেমে বক্তব্য দেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যার বিচার হয়েছে উল্লেখ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের শাসনামলে গুম-খুনেরও তদন্ত করে বিচার হওয়া উচিত।
জাতীয় প্রেসক্লাব সংলগ্ন সড়কে সকালে জড়ো হন ‘১৯৭৭ সালে খুনি জিয়ার গুম ষড়যন্ত্রে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গ’ নামের সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। পরে তারা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ঘেরাও করে তালিকা প্রকাশ করার দাবিতে।
১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবরে সেনা ও বিমান বাহিনীর কারাদণ্ড পাওয়া ও চাকরিচ্যুত সদস্য এবং নিহত সদস্যের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গড়ে তোলা হয় সংগঠনটি।
বিক্ষোভকারীদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন মন্ত্রী। পরে তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন তিনি। মন্ত্রীর কথায় আশ্বস্ত হয়ে ঘেরাও কর্মসূচি শেষ করেন বিক্ষোভকারীরা।
আ ক ম মোজাম্মেল বলেন, ‘সেই সময় যারা বিনা বিচারে, প্রহসনের বিচারে জিয়ার রোষানলে প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের পরিবারের প্রতি আমার সমবেদনা আছে। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের ব্যবস্থা করা হবে।’
জিয়ার শাসনামলে সব হত্যা বা খুনের অভিযোগ তদন্তে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন মন্ত্রী।
সে না হয় গেল, কিন্তু আওয়ামী লীগের আমলে যেসব গুম খুন হয়েছে তার তদন্ত করবে কারা? গত ১৪ বছরে দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়াসহ নানানভাবে গুম হয়েছেন ছয় শতাধিক ব্যক্তি। যাদের অধিকাংশ সরকারের সমালোচনাকারী অথবা রাজনৈতিক নেতাকর্মী। এর মধ্যে ৭৮ জনের লাশ পাওয়া গেছে। প্রায় দেড় শ ব্যক্তির খোঁজ মিলেছে, যার মধ্যে অনেককে পাওয়া গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার দেখানোর পর। তবে বাকিদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা আর জানা যায়নি। এ হিসাব মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক)।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র আরও বলে, ২০০৭ থেকে ২০২০ (২৫ আগস্ট) পর্যন্ত ৬১৪ জন গুমের শিকার হয়েছে বলে ভুক্তভোগী পরিবার ও স্বজনরা অভিযোগ তুলেছেন। এদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ৮৯ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং ৫৭ জন ফেরত এসেছে। অন্যদের বিষয়ে সুর্নিদিষ্ট তথ্য গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়নি।
এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবার, স্বজন বা প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা, সাংবাদিক বা মানবাধিকার সংগঠনের তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, বিশেষ বাহিনী-র্যাব, ডিবি পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়ে সাদা পোশাকে ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের তুলে নেওয়া হচ্ছে। প্রায়ই সংশ্লিষ্ট বাহিনী তাদের গ্রেপ্তার বা আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে। পরিচিত কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ছাড়া খুব কম ক্ষেত্রেই আলোচনা বা আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং উদ্ধারের তৎপরতা লক্ষ করা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গুম হওয়ার কিছুদিন পর হঠাৎ করেই তাদের কোনও মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় বা ক্রসফায়ারে তাদের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়। যারা ফিরে আসতে পেরেছেন তাদের ক্ষেত্রেও কী ঘটেছে তা জানা যায় না।
এদিকে পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে হারিয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন স্বজনরা। প্রিয়জনের খোঁজ করতে গিয়ে হয়রানি, ভয়ভীতিসহ নানা অমানবিক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন।
একদিকে ‘১৯৭৭ সালে খুনি জিয়ার গুম ষড়যন্ত্রে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গ’ নামের সংগঠনের নেতাকর্মীদের মন্ত্রী আশ্বাস দিলেন, অন্যদিকে গত ৩১ অক্টোবর তেজগাঁও পুলিশের একটি দল রাজধানীর শাহীনবাগে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে।পুলিশ তাদের বাসা থেকে ২০ জনকে আটক করেছে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সরকার তাহলে বিএনপি আমলের গুম খুনের তদন্ত করবে কিন্তু আওয়ামী লীগের আমলে হওয়া গুম খুনের বিষয়ে নীরব থাকবে?
সরকার তাহলে বিএনপি আমলের গুম খুনের তদন্ত করবে কিন্তু আওয়ামী লীগের আমলে হওয়া গুম খুনের বিষয়ে নীরব থাকবে?
বিচারহীনতার সংস্কৃতি বাংলাদেশে একটি পরিচিত কথা৷ বলা হয়ে থাকে, এই সংস্কৃতির কারণেই এখানে অপরাধীরা বেপরোয়া৷ তারা আইনকে গুরুত্ব দেয় না, অপরাধ করতে ভয় পায় না৷ তারা মনে করে অপরাধ করে পার পাওয়া যায়৷ তবে অপরাধীরা নির্ভয়ে থাকলেও স্বস্থি নেই সাধারণ মানুষের। বিরোধী দলের নেতা-কর্মী, ভিন্নমতাবলম্বী ও গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের উদ্দেশ্যে গুমের মাধ্যমে একধরনের ভয়ের যে সংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছে, তা নিরাপত্তা বাহিনীর হাত ধরেই। অবাধ বিচারহীনতার সংস্কৃতি গুমকে উৎসাহিত করছে। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতেই ‘গুম’ আতঙ্কে রয়েছেন মানুষ।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ দাবি করেছে যে, সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে এবং তাদের মত দাবিয়ে রাখতে গুম এবং গুমের হুমকিকে ব্যবহার করেছে সরকার।
বাংলাদেশের সরকার অবশ্য গুমের ঘটনায় কোন কর্তৃপক্ষ অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জড়িত থাকার অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করেছে।
অপহরণ, গুম, গুপ্তহত্যা, বিচারবহির্ভূত খুন ও হেফাজতে নির্যাতন ও ন্যায়বিচারের সুযোগহীনতার মতো বিষয়গুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের নৃশংসতা ও চরম অপরাধগুলোর অন্যতম। বিশ্লেষকরা বলছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন বিচ্ছিন্নভাবে সংঘটিত হয় না, বরং পরস্পর সম্পৃক্ত; একটি অপরটিকে প্রভাবিত করে এবং চূড়ান্তভাবে আইনের শাসনকে বিপন্ন করে তোলে।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করার জন্য গুমকে একটা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মানুষ আগে যেমন হোটেল, রেস্টুরেন্টে, বাসে, ট্রেনে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতো, তাদের প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিলো রাজনৈতিক পরিমণ্ডল নিয়ে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা এমন কোনো আলোচনা হতে দেখি না। তার একটা বড় কারণ হচ্ছে গুমের মত ঘটনা এমন একটা অবস্থায় মানুষকে নিয়ে গিয়েছে মানুষ আর এখন নিজেকে নিরাপদ ভাবছে না।
আইনজ্ঞরা বলছেন, যদি কোনো ব্যক্তি সরকার বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকেন, যদি কারো ফেসবুক স্ট্যাটাস বা কর্মকাণ্ডে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সরকার বিব্রত হয়, তাহলে তাকে সতর্ক করা কিংবা তাকে শাস্তি দেয়ার আইনি প্রক্রিয়া রয়েছে। রাষ্ট্রের যে কোন নাগরিকের বিরুদ্ধেই মামলা হতে পারে এবং তার দল ও মত যাই হোক, তার বিচারের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এমনকি, তাকে জিজ্ঞাসাবাদেরও আইন রয়েছে। কিন্তু এরপরও কেন মানুষ নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে সেটা অবশ্যই ভেবে দেখা দরকার।
মানবাধিকারকর্মীরা বলেন, ‘নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা পাওয়া প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। নিখোঁজের কোনো অভিযোগ আসামাত্র তা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে। নিরপেক্ষভাবে তার তদন্ত করতে হবে। ভিকটিম পরিবারকে তার স্বজনের অবস্থানের বিষয়ে জানাতে হবে।’
তারা বলেন, বিগত এক দশকে দেশ এমন অবস্থার সাক্ষী যেখান থেকে গণতন্ত্র ক্রমেই সরে গেছে। এমন এক শাসনব্যবস্থার সাক্ষী হয়েছে, যা গণতন্ত্রের যেকোনো রূপ থেকেই অনেক দূরে। ক্ষমতাসীনরা বলপ্রয়োগের ওপরেই আরও নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। দেশ শাসনে এখন বলপ্রয়োগের বাহিনীগুলোই প্রাধান্য পাচ্ছে। বিগত দুই নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহির বিষয়টি অনেক দূরে চলে গেছে। যদিও এগুলোকে ‘নির্বাচন’ বলা যায় কি না, তাও একটি প্রশ্ন।
আরও বলেন, সুষ্ঠূ ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে জবাবদিহির যে প্রক্রিয়া, তা যখন কার্যত অবসিত হয়েছে, তখন আরও বেশি দরকার হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রের বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে জবাবদিহির চেষ্টা করা। কিন্তু, গুমের বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (এনএইচআরসি) কথা বলতে পারার ব্যর্থতার মাধ্যমেই জবাবদিহি না থাকায় তৈরি হওয়া সংকটের গভীরতা বোঝা যায়।
তারা বলেন, গুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলার সময়ে এটা গুরুত্ব দেওয়া দরকার যে, গুমের বিষয়টি শাসনব্যবস্থা ও জবাবদিহির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত; আর এটা খুব স্পষ্টভাবে বলা যে, রাষ্ট্রকে অবশ্যই এর দায় নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৪৩
আপনার মতামত জানানঃ