শেখ হাসিনা নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডের্ন নন— যিনি ২০১৯ সালে একটি মসজিদে হামলায় ৫১ জন মুসল্লি নিহত হবার পর ভীত সন্ত্রস্ত মুসলিমদের বুকে জড়িয়ে বিশ্বব্যাপী নন্দিত হয়েছিলেন, যিনি ইসলামফোবিয়ার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। পারতপক্ষে, ইসলামিক মৌলবাদীরা দূর্গা পূজায় বাংলাদেশের বেশ কিছু মন্দিরে হামলা চালালে এবং দুইজন হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে হত্যা করলে, শেখ হাসিনা যে পদক্ষেপ নিয়েছিল তা ছিল রাজনৈতিকভাবে সুবিধা বাগিয়ে নেয়ার পথ সুগম করা।
যেখানে জেসিন্ডা আরডার্ন সততার সাথে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছিলেন, সেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করেছেন চতুরতা এবং কপটতার দ্বারা। যদিও এটা নতুন নয়।
যেভাবে পরিস্থিতি সামলেছে আওয়ামী লীগ
এক পর্যায়ে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ঠিক সেটাই করেছিল, যা একটা আইন পালনকারী প্রশাসন করে থাকে— সংখ্যাগুরু সম্প্রাদায়ের হামলাকারীদের গুলি করেছিল সংখ্যালঘুদের হত্যা ও ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য।
এ সময় পুলিশের গুলিতে পাঁচ মুসলিম দাঙ্গাকারী নিহত হন; তবে ভারতীয় মিডিয়ায় বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ প্রকাশিত হয় যে বাংলাদেশে দূর্গা পূজায় নিহত সাতজনই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। কিন্তু পুলিশের গুলিত নিহত পাঁচজনই ছিল মুসলিম।
র্যাবের দেশব্যাপী অভিযানে শত শত মৌলবাদীকে আটক করা হয়। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দুর্গা পূজাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রধান দুই অপরাধী ইকবাল হুসেইন এবং সৈকত মণ্ডলকে আটক করা হয় যারা পর্যায়ক্রমে দূর্গা প্রতিমার পায়ের নিচে কুরআন রেখেছিল এবং তা সম্প্রচার করে দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করেছিল। সিসিটিভি ফুটেজ ব্যবহার করে তাদের আটক করা হয়। যদিও এই দু’জনের পেছনের অপশক্তি এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এছাড়া শেখ হাসিনা হিন্দুদের উপর হামলার নিন্দা জানায় এবং ঢাকা সহ অন্যান্য শহরে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠন এই ঘটনার প্রতিবাদে মিছিল বের করে মৌলবাদীদের দমনের দাবিতে। নাগরিক সমাজ— লেখক, কবি, গায়ক, ক্রিকেটার, অধ্যাপক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, চিকিৎসক এবং মানবাধিকার কর্মীরা সংখ্যালঘুদের পক্ষে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশের ঘাড়ে ভারতের থাবা
শুরুতে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বাংলাদেশের এই ঘটনা থেকে সুবিধা আদায় করতে চেয়েছিল। হিন্দুদের ভোট বাগিয়ে নেয়ার একটা পথ হিসেবে নিয়েছিল বাংলাদেশের এই পরিস্থিতিকে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদর সরকার দ্রুতই ঢাকার যথোপযুক্ত পদক্ষেপের প্রশংসা করতে ভুল করেনি। ২২ অক্টোবর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রীংলা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে প্রতিবেশি দেশের থেকে অনেক বেশিকিছু বলে উল্লেখ করেন।
তবে আজকের ‘এক দল-এক নেত্রী’র বাংলাদেশে শেখ হাসিনা প্রশাসনিক দুর্বলতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বা সেক্যুলারিজমের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এসব কিছুই করেনি। পাশাপাশি বেইজিংয়ের উপর তার নির্ভরশীলতা বাড়ছে। চীন-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব প্রকাশ্য এখন। পাশাপাশি শেখ হাসিনা ভারতকে নিয়ে ভয়ে আছেন— যে ভারত বাংলাদেশকে মানচিত্রে ঘিরে আছে সবদিক দিয়ে। এই ভৌগোলিক বৃত্ত ছোট দেশ বাংলাদেশের ঘাড়ে ভারতের দৃঢ় থাবার মতোই।
এই এক কারণে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্যের থেকে বাংলাদেশে বেশি প্রভাব খাটাতে পারে একা ভারত। এক্ষেত্রে ভারতে রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (র) আর এক মূর্তিমান বিভীষিকা। হাসিনা র’য়ের একপ্রকার ভয়েই থাকেন। তিনি জানেন— ভারতকে অখুশি করলে, ক্ষমতা হারাতে পারেন তিনি। তাই ক্ষমতায় থাকার জন্য, ভারতকে খুশি রাখার নীতিই অনুসরণ করছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
ভারতকে খুশি করতে শেখ হাসিনার দুই নীতি
নয়াদিল্লিকে খুশি রাখতে শেখ হাসিনা দুটি নীতি গ্রহণ করেছেন। প্রথমত, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯-১০ শতাংশ হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, তাদের রক্ষা করা। কারণ ভারতের সিএএ আইন থেকে স্পষ্ট বোঝা গেছে, বাংলাদেশের হিন্দুরা মোদি সরকারের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
দ্বিতীয়ত, মোদির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ। হাসিনা জানেন, মোদি কতটা আনুগত্য পছন্দ করেন। আর বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় শেখ হাসিনাই একমাত্র আনুগত্য দেখান মোদি সরকারকে। মূলত আনুগত্য প্রদর্শনের কোন সুযোগই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছাড়েন না।
তার অজনপ্রিয়তা সত্ত্বেও হাসিনা তাকে দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানান, এমনকি মোদি-বিরোধী আন্দোলন দমাতে পুলিশ ডজনের বেশি আন্দোলনকারীকে হত্যা করে।
কট্টরপন্থী ইসলামিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা
ক্ষমতার প্রতি লোভ থেকেই শেখ হাসিনা কট্টরপন্থী ইসলামিক দল হেফাজতে ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন; যারা এই দূর্গা পূজায় হামলার সাথে জড়িত। এমনকি মোদির বাংলাদেশ সফরেও এরাই দেশজুড়ে আন্দোলন করেছিল, দাঙ্গা করেছিল। হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা শাহ আহমেদ শফির সাথে শেখ হাসিনার সম্পর্ক ছিল সুদৃঢ়— যে কিনা মন্তব্য করেছিলেন যে নারী তেঁতুলের মতো, তারা পুরুষের মুখে পানি নিয়ে আসে। মূলত বিএনপির সাথে জোট বাঁধা জামাতে ইসলামকে নির্বাচনের হিসেব থেকে সরাতে শেখ হাসিনা এই পশ্চাৎপদ, বিষাক্ত মৌলবাদীদের সাথেও বেশ স্বস্তিতেই ছিলেন।
২০১৮’র নির্বাচন জিততে শেখ হাসিনা ২০১৭ সাথে শফির উপর আস্থা রাখেন— যে কিনা দেশের সবথেকে বড় মাদ্রাসা কেন্দ্রিক সংগঠনকে নেতৃত্ব দিতেন। শফি শেখ হাসিনাকে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা’ বলে প্রশংসা করতেন এবং শেখ হাসিনা শফিকে ‘জাতির আধ্যাত্মিক গুরু’ বলে ডাকতেন। হেফাজতে ইসলামের তিনটি শর্ত মেনে নেয়ার মাধ্যমে শেখ হাসিনা তাদের বৈধতা দান করেন।
অমুসলিম এবং সেক্যুলার লেখকদের ১৭টি কবিতা নাস্তিকতাকে তুলে ধরে আখ্যা দিয়ে পাঠ্যবই থেকে বাদ দে’য়া হয়। সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে লেডি জাস্টিসের ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলা হয় নির্লজ্জ ও অপবিত্র আখ্যা দিয়ে। এছাড়া মাদ্রাসার স্নাতকদের সরকারি চাকরির যোগ্য ঘোষণা করা হয়। সেক্যুলারিজমের প্রতি এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করা হলেও, নির্বাচনে শেখ হাসিনা তার মুসলিম কার্ড খেলতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি।
এই সম্পর্কের সমাপ্তি
এরপর ২০১৮ নির্বাচনে ৩০০ আসনের ২৮৮ টিতে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল, ছিল প্রমাণ। তবে তাৎক্ষণিকভাবে নয়াদিল্লি শেখ হাসিনাকে তার টানা তৃতীয় জয়ে অভিনন্দন জানায়।
হাসিনা শফির পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করেনি তখনও। তার জন্য সুবিধার ছিল কারণ শফি ভারতবিরোধী নয়। শফি উত্তরপ্রদেশের দেওবন্দ মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন এবং ভারত-বাংলাদেশ উভয় সরকার তার পক্ষে ছিল।
২০২০ সালে শফি মারা যাওয়ার পর অবস্থা বদলে যায়। মামুনুল হক এবং জুনায়েদ বাবুনগরী হেফাজতে ইসলামের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে যা পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের সাথে তাদের সুসম্পর্কের ইতি টানে।
ওই সময়ে শেখ হাসিনার পিতা এবং বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে তার মূর্তি অপসারণ নিয়ে হেফাজতের সাথে সরকারের সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হয়। পাশাপাশি নবী মোহাম্মদের কার্টুনের প্রকাশনা বাতিল না করায় এরা ফ্রান্সের দূতাবাস ঘেরাও করে এবং ম্যাক্রোনের কুশপুত্তলিকা পোড়ায়।
হেফাজতে ইসলাম শেখ হাসিনার জন্য বোঝা হয়ে উঠলে, কঠোর হন তিনি। এর বিপরীতে হেফাজতে ইসলাম ভারতের কোভিড ভ্যাকসিন বয়কটের ডাক দেয় এবং মোদিকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানাতে নিষেধ করে।
ধারণা করা হয়, মোদি বিরোধী আন্দোলন দমাতে পুলিশকে হত্যার পথ অবলম্বনের পরিকল্পনা শেখ হাসিনারই। একইভাবে এই দূর্গা পূজার দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে পাঁচজনকে হত্যাও এড়ানো সম্ভব ছিল, কিন্তু তা করা হয়নি। বাংলাদেশের যেকোন প্রধানমন্ত্রীর থেকে বেশি রক্ত লেগে আছে শেখ হাসিনার হাতে।
ভারতের বন্ধু নাকি স্রেফ রাজনীতি?
বর্তমানে শেখ হাসিনার উপর খুশি হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে নয়াদিল্লির। ২০০১ সালে, তার শাসন আমলে ১৬ বিএসএফ সেনা বাংলাদেশি রাইফেলসের হাতে নিহত হয়। বাঁশে ঝোলানো পশুর মতো তাদের ছিন্নভিন্ন দেহের ছবি প্রকাশ করে ঢাকা। স্বাভাবিকভাবেই এই নিয়ে ভারতে পরিস্থিতি জটিল হয় এবং তখনকার প্রধানমন্ত্রী অতল বিহারি বাজপায়ী ওই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতে বাংলাদেশ আক্রমণের চাপে ছিলেন।
অবস্থা শান্ত করতে বাজপায়ী অকপটভাবে শেখ হাসিনাকে নয়াদিল্লিতে আমন্ত্রণ জানান কথা বলার জন্য। কিন্তু শেখ হাসিনা তা গর্বভরে প্রত্যাখ্যান করেন এবং অমন বিস্ফোরক পরিস্থিতি বাজপায়ীকে একাহাতে সামলাতে বাধ্য করেন। এক্ষেত্রে বাজপায়ীকে ধন্যবাদ তার অসাধারণ নেতৃত্বগুণের জন্য। তিনি শেখ হাসিনার কোনপ্রকার সাহায্য ছাড়াই পরিস্থিতি সামলে নিয়েছিলেন।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা শেখ হাসিনা নিজের সুবিধার জন্য যেকোন মুহূর্তে বাংলাদেশের ভারত বিরোধী অনুভূতিকে উস্কে দিতে দ্বিধা করবেন না এবং ২০২৩ এর নির্বাচনের আগে আরও একবার তার মুসলিম কার্ড সামনে আনতে পারেন। যদি তিনি নির্বাচনে জেতার মতো অবস্থানে না থাকেন, তাহলে শেখ হাসিনা রাজনৈতিক কারণে ভারতকে ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না।
মূল: এসএনএম আবদি। আউটলুকের সাবেক ডেপুটি এডিটর।
সোর্স: দ্য কুইন্ট।
এসডব্লিউ/এসএস/১২১৫
আপনার মতামত জানানঃ