একনায়কতন্ত্র নাকি গণতান্ত্রিকভাবে একনায়কতন্ত্র— কোনটি বেশি ভয়ংকর। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ইয়াহিয়া আখতার বলেন, ‘সিভিলিয়ান অটোক্র্যাট’ বা ‘বেসামরিক স্বৈরশাসক’ বলে একটি কথা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে চালু আছে। অনেক সময় গণতান্ত্রিক সরকারের চরিত্র দেখে অনেক সামরিক শাসকও লজ্জা পেতে পারে।
এখানে বলে রাখি, প্রায় ৩ বছর আগেই বাংলাদেশ বিশ্বের নতুন একনায়কতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জার্মানির গবেষণা প্রতিষ্ঠান বেরটেলসমান স্টিফটুং তাদের গবেষণা থেকে এমনটি জানায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪০টি দেশের সরকার দুই বছর ধরে আইনের শাসনকে ‘বন্দী’ করে রেখেছে। অন্যদিকে ৫০টি দেশে রাজনৈতিক স্বাধীনতার ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে। সারা বিশ্বেই গণতন্ত্র এখন চাপের মুখে রয়েছে।
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকরী ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। তবে একবিংশ শতাব্দীতে এসে সে চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর অনেকে দেশে গণতন্ত্র নামেমাত্র কার্যকর রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর মতো অনেক দেশে সরাসরি সামরিক শাসন না থাকলেও, অনেক দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলো সামরিক একনায়কদের মতোই আচরণ করছে বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণে বলা হচ্ছে। আর টক অব দ্য টেবিলে বাংলাদেশের নামটা উঠে আসছে বেশ জোরেশোরেই। গণতান্ত্রিকভাবে স্বৈরতন্ত্রকে প্রতিপালনে রোল মডেল হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি। আর চালকের আসনে আছে আওয়ামী লীগ।
নির্বাচন
অনেক দেশে পরিপূর্ণ বেসামরিক সরকার থাকলেও সেখানে গণতন্ত্র কতটা কার্যকরী আছে সেটি নিয়ে অনেক প্রশ্নের উদয় হয়েছে। আর প্রশ্নটা যখন বাংলাদেশকে নিয়ে তখন ‘নির্বাচন’ পরিস্থিতি পরিমাপের ট্রাম কার্ড হতে পারে। গণতন্ত্রের মূল বিষয়ই হচ্ছে নির্বাচন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে নির্বাচন হলো ‘গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা’ । সে নির্বাচন হতে হবে অবাধ ও স্বচ্ছ। বাংলাদেশের গত দুইবারের নির্বাচনই প্রশ্নবিদ্ধ। অস্বচ্ছ এবং প্রমাণিতভাবেই পক্ষপাতদুষ্ট।
মূলত যে সব দেশে বেসামরিক একনায়কতন্ত্র আছে সেখানেও নিয়মিত নির্বাচন হয়। কারণ তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠী তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে। এখন নির্বাচনে কারচুপি শুধু জাল ভোটের মাধ্যমে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয়না, এর নানা দিক আছে। বাংলাদেশেও এমনটিই হয়েছে।
২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বরের নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এই নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটি বাক বদল হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, বাংলাদেশের সাধারন নির্বাচনের ইতিহাসে ২০০৮ সালের নির্বাচনটি ছিল সর্বশেষ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন।
এরপর ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে আরো দুটি সাধারন নির্বাচন হয়েছে বটে, কিন্তু সেসব নির্বাচনের স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা এবং গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বড় ধরণের প্রশ্ন রয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ একটানা ১২ বছর ক্ষমতায় রয়েছে।
২০১৮ সালে বিবিসির ক্যামেরায় সরাসরি ধরা পড়ে ভোটচুরির ঘটনা। প্রকাশ্যেই কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। যা কিনা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে পরিপন্থি। ৩০শে ডিসেম্বর ২০১৮ ভোরবেলা চট্টগ্রামের এক কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শুরুর আগে আগে ব্যালটবক্সগুলো বিভিন্ন বুথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। কিন্তু অবাক করা বিষয়, বিবিসির এক সাংবাদিক দেখতে পান ব্যালটবক্স সবগুলোই ভর্তি!
প্রিজাইডিং অফিসারের কক্ষে গিয়ে সেখানেও ব্যালটবক্স ভর্তি দেখতে পান ওই সাংবাদিক। তার হাতে থাকা মোবাইল ফোনেই ছবি ও ভিডিও ধারণ করেন। পরে এ ব্যাপারে ওই ভোটকেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে জানতে চাইলে তিনি এ ব্যাপারে কোন কথা বলতে পারবেন না বলে জানান। এমনকি কিভাবে এসব ব্যালট বক্স ভর্তি হলো, তাও তিনি জানেন না বলে জানান।
অনেকটা যেন গণতন্ত্র দেশটিতে আর প্রতাশিতই নয়। নির্বাচনগুলো কীভাবে হচ্ছে, তাতে জনগণ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ কেমন, যারা নির্বাচন আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত, তারা কী ভূমিকা পালন করছে, জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্ভয়ে ভোট দিতে পারছে কি না, সেগুলো যেন আর বিবেচনারই বিষয় নয়।
গণমাধ্যম ও মত প্রকাশ
এছাড়া গণতন্ত্রে জনগণের মতামতের প্রাধান্য একটি বড় বিষয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে গণতন্ত্র না থাকলে এবং একনায়কতন্ত্রের আবির্ভাব হলে জনগণের মতামতকে সহিংসভাবে দমনের চেষ্টা করা হয়। এর ফলে জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে।
গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকলে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমও স্বাধীনভাবে কাজ করতে ভয় পায়। এমনকি শাসকগোষ্ঠী ইন্টারনেটও নিয়ন্ত্রণ করতে চায় যাতে করে মানুষ সেখানে নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে না পারে।
সংবিধানে নিশ্চয়তা থাকলেও বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অনেকটাই সংকুচিত বলে যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষণ। বিশ্বের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ নিয়ে এ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের সাংবাদিকেরাও হয়রানি ও নির্যাতনের ভয়ে সরকারের সমালোচনা থেকে নিজেদের অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছেন।
অথচ কোনও রাষ্ট্র যদি নিজেকে গণতান্ত্রিক দাবি করে, তবে সেখানে গণমাধ্যমের একশভাগ স্বাধীনতা থাকতেই হবে। যে গণমাধ্যম সরকারের সমালোচনা করবে, সেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আবার সেই সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। জনসাধারণের কথাই উঠে আসে গণমাধ্যমে। তাই এই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।
যে কোনও অনিয়ম-অসদাচরণ তুলে ধরতে সাংবাদিকরা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে বিভিন্নভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে থাকেন। ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’তে সংযোজিত ৩২ ধারা সাংবদিকদের সেই জায়গা সংকুচিত করেছে।
শুধু সাংবাদিক নয়, সাধারণ মানুষও হারিয়েছে তাদের মত প্রকাশের অধিকার। সরকারের সমালোচনা অঘোষিতভাবেই নিষিদ্ধ দেশটিতে। দেশটির স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে দ্রব্যমূল্যের সর্বোচ্চ উর্ধ্বগতিতেও মানুষ নির্বিকার। কোথাও প্রতিবাদ নেই। উল্টো মত প্রকাশের অধিকারহীন জনগণের এই নীরব থাকাকে নিজেদের সাফল্য হিসেবে প্রচার করছে ক্ষমতাসীন দলটি।
মত প্রকাশের গর্দানে তরবারি হয়ে নেমে এসেছে ২০১৮ সালে প্রণীত ডিজিটাল আইন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রতিদিন প্রায় তিনটি করে মামলা হয়েছে। সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক নেতা, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এমনকি কিশোর বয়সীরাও রেহাই পাচ্ছে না এই আইনে; যেখানে অধিকাংশ অভিযোগই করেছে ক্ষমতাসীন দল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে গত ২১ মাসে হওয়া ৬৬৮টি মামলা পর্যবেক্ষণ করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) জানিয়েছে, এই মামলাগুলোর বেশিরভাগই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দ্বারা না হয়ে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা তাদের নেতাদের পক্ষ হয়ে করেন।
‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এর তিন বছর: একটি পর্যবেক্ষণমূলক ফলাফল’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক মামলা ছাড়া আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ৭৬টি মামলা করেছে, যা মোট দায়েরকৃত মামলার ২০ দশমিক ৩২ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে এই পর্যবেক্ষণের মূখ্য গবেষকের মন্তব্য, ‘আইনটি ভিন্নমতকে অপরাধে পরিণত করছে।’
একদলীয় সংসদ
বাংলাদেশের সংসদে এখন প্রধান বিরোধী দল কোনটি? মানে সরকারের কোনও কর্মকাণ্ড বা নীতি-আদর্শের বিরোধিতায় কারা সবচেয়ে সক্রিয়? হুট করে এমন প্রশ্ন করা হলে অনেকেই বিভ্রান্তিতে পড়ে যাবেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে একটি দেশে যখন গণতন্ত্র থেকে বিচ্যুত হবার দিকে ধাবিত হয় তখন সংসদে ক্ষমতাসীনদের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকে। সংসদে কার্যত কোন বিরোধী দল থাকেনা।
বিএনপি সংসদে নেই৷ সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় জাতীয় পার্টি, যাদের আবার মন্ত্রিপরিষদেও প্রতিনিধিত্ব আছে৷ সব মিলিয়ে বাংলাদেশে কি আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র আধিপত্য, অর্থাৎ এক দলীয় শাসনই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে- এই প্রশ্নটা বেশ পুরনো হয়ে গেছে। বরং বলা যায়, এটা প্রশ্ন থেকে বক্তব্যে রূপ নিয়েছে।
সূত্র মতে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পায় আওয়ামী লীগ৷ কিন্তু বিরোধী দল সেই নির্বাচন বয়কট করে৷ একশ জনেরও বেশি রাজনৈতিক কর্মী নির্বাচনের আগে-পরে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে নিহত হন৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, কোনেও হত্যারই তদন্ত হয়নি৷
এরপর থেকে সংসদ একপ্রকার বিরোধী দলশূন্য। কারণ জাতীয় পার্টি দশম সংসদে নামে বিরোধী দল হিসেবে থাকলেও সেই দায়িত্ব তারা পালন করতে পারছে না বলে জানায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি। মূলত একটি প্রতিনিধিত্বমূলক কার্যকর সংসদ গঠিত হওয়ার পূর্বশর্ত, সে সংসদকে অবশ্যই গঠিত হতে হবে অবাধ নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে। প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন ছাড়া গঠিত, সংসদ কখনোই কার্যকর বা ফলপ্রসূ হতে পারে না। অতীত এ কথাই বলে। আর সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এক প্রকার রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা, যাতে সর্বময় ক্ষমতা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সংসদের ওপর ন্যস্ত থাকে।
আগের ও বর্তমান (দশম ও একাদশ) সংসদের আসনের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে সরকারি দল আওয়ামী লীগের পর সংসদে যে দলের আসন সবচেয়ে বেশি, সেটি জাতীয় পার্টি। অথচ দশম সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমরা যখন বাইরে যাই, তখন সবাই বলে তুমি কোথায় আছ, সরকারে না বিরোধী দলে? আমরা তো বলতে পারি না।’
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আমরা সংবাদপত্রে শিরোনাম দেখেছি, ‘সরকারে না বিরোধী দলে, প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত চায় জাতীয় পার্টি’। অর্থাৎ জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত আসবে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে!
অথচ একটি দেশে বিরোধী রাজনৈতিক দল বা শক্তির অস্তিত্বের সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক রয়েছে। সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি-ডেম ইনস্টিটিউটের বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা–সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে। ‘অটোক্র্যাটাইজেশন গোজ ভাইরাল’ এই শিরোনামের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে গণতন্ত্রের পরীক্ষায় বাংলাদেশের নম্বর ধারাবাহিকভাবে কমছে। ২০২১ সালের স্কোর শূন্য দশমিক এক। গতবারের চেয়ে স্কোর কমেছে শূন্য দশমিক ০১৯। বাংলাদেশের জায়গা হয়েছে ‘নির্বাচনভিত্তিক স্বৈরতন্ত্র’ বিভাগে।
আপনার মতামত জানানঃ