বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের নামকরণ যে গাছের কারণে, সেই সুন্দরীই এখন হারাতে বসেছে। ক্রমাগত কমছে উপকূলের রক্ষাকবচ গাছগুলো। সাগরের পানির লবণাক্ততা সহিষ্ণু গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ এই বনের সামনে এখন অতিরিক্ত লবণাক্ততাই বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমুদ্রের উপকূলে তীব্রভাবে লবণাক্ততা বাড়ছে যার ফলে শুধু সুন্দরী গাছ নয় পুরো সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়তে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়া এ বনে অব্যাহতভাবে বাড়ছে লবণাক্ততা। বনের ভেতরে জমছে পলিও। এ অবস্থা চললে ২০৫০ সালের মধ্যে সুন্দরবনের পরিবেশে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে; বিলীন হতে পারে সুন্দরীগাছ।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. স্বপন কুমার সরকারের নেতৃত্বে চলেছে গবেষণাটি। তার সহযোগী ছিলেন যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জেসন ম্যাথিউপউলস ও ড. রিচার্ড রিভ।
২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পরিচালিত গবেষণার ফল গত ১০ এপ্রিল ইকোলজিক্যাল সোসাইটি অফ আমেরিকা প্রকাশিত ইকোলজিক্যাল মনোগ্রাফস জার্নালে প্রকাশ হয়।
‘সলভিং দ্য ফোর্থ-কর্নার প্রবলেম: ফোরকাস্টিং ইকোসিস্টেম প্রাইমারি প্রোডাকশন ফ্রম স্পেশিয়াল মাল্টিস্পেসিস ট্রেইট-বেজড মডেলস’ শিরোনামে প্রকাশিত নিবন্ধে বলা হয়, সুন্দরবনের লবণাক্ততা ও পলি জমার পরিমাণ বর্তমানের তুলনায় ৫০ শতাংশ বাড়লে বনের কার্যক্ষমতা ২৯ শতাংশ কমে যাবে।
এতে গাছের গড় উচ্চতা প্রায় ৩৬ শতাংশ কমে যেতে পারে। সবচেয়ে ঝুঁকিতে পড়বে সুন্দরবনের প্রধান সুন্দরীগাছ। অতিরিক্ত লবণ ও পলির কারণে সুন্দরীগাছের উচ্চতা ও পাতায় খাদ্য উৎপাদন ক্ষমতা ব্যাপকভাবে কমবে।
এর পাশাপাশি অন্যান্য লবণসহিষ্ণু ছোট গাছ (যেমন: গেওয়া, গরান) সুন্দরীগাছের জায়গা দখল করে নেবে। ফলে সুন্দরবনের ভারত অংশের মতো বাংলাদেশ অংশেও বিলীন হয়ে যেতে পারে সবচেয়ে বেশি কার্বন ধারণক্ষমতার সুন্দরীগাছ।
বাংলাদেশ ও ভারতের অংশে থাকা সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশে বনের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের এই বনকে ১৯৯৭ সালে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেসকো।
অধ্যাপক ড. স্বপন কুমার সরকার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গত চার দশকে সুন্দরবনের লবণাক্ততা ৬০ শতাংশ বেড়েছে। আর প্রতি বছর সুন্দরবনে ৯৬ হাজার টন পলি জমছে।’
ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়া এ বনে অব্যাহতভাবে বাড়ছে লবণাক্ততা। বনের ভেতরে জমছে পলিও। এ অবস্থা চললে ২০৫০ সালের মধ্যে সুন্দরবনের পরিবেশে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে; বিলীন হতে পারে সুন্দরীগাছ।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে লবণাক্ততা বাড়ছে এবং পলি জমছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভারতের ফারাক্কা বাঁধের কারণে মিঠা পানির অসম বণ্টনের ফলেও সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।’
নিজেদের গবেষণা সম্পর্কে অধ্যাপক স্বপন কুমার বলেন, ‘বন বিভাগের উদ্যোগে সুন্দরবনের ভেতরে ১৯৮৬ সালে ১২০টি স্থায়ী স্যাম্পল প্লট স্থাপন করা হয়। আমরা ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এসব প্লট থেকে ২০ প্রজাতির ৪৯ হাজার ৪০৯টি উদ্ভিদের তথ্য সংগ্রহ করি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, পশুর, বাইন, সিংড়া ও কেওড়া। এই গাছগুলোর সঙ্গে পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের সম্পর্ক কেমন বা গাছগুলো কীভাবে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ায়, তা নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে।’
তিনি জানান, গবেষণার সময় গাছের চারটি বৈশিষ্ট্যের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে গাছের উচ্চতা বৃদ্ধি ও সালোকসংশ্লেষণ ক্ষমতা থেকে জানা গেছে, গাছের বেড়ে ওঠা বা পরিবেশ থেকে পুষ্টি সংগ্রহের ক্ষমতার বিষয়টি। এর বাইরে কাঠের ঘনত্ব ও পাতার পানি ধারণক্ষমতা থেকে জানা যায়, গাছগুলো প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকার জন্য কতটা সহন ক্ষমতাসম্পন্ন।
অধ্যাপক স্বপন কুমার জানান, গবেষণায় দেখা গেছে, সুন্দরবনের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের বনের অবস্থা তুলনামূলকভাবে অন্য অংশের চেয়ে ভালো ও অপেক্ষাকৃত বেশি কার্যক্ষম।
তিনি বলেন, ‘গত কয়েক দশকের ধারাবাহিকতায় যদি সুন্দরবনের মাটির লবণাক্ততা ও পলিস্তর বাড়তে থাকে, তাহলে ২০৫০ সাল নাগাদ এই বনের প্রতিবেশ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হবে। লবণাক্ততা ও পলি জমার পরিমাণ এই সময়ের চেয়ে ৫০ শতাংশ বাড়লে সুন্দরবনের মোট কার্যক্ষমতা ২৯ শতাংশ কমে যাবে।’
গবেষণায় সুন্দরবনের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে সবচেয়ে লম্বা গাছ পাওয়া গেছে। লবণাক্ততা ও পলি বাড়লে এ গাছগুলো টিকে থাকার জন্য উচ্চতা কমিয়ে আনবে। এতে করে গাছের গড় উচ্চতা প্রায় ৩৬ শতাংশ কমে যেতে পারে। এ সময়ে গাছগুলোর কাঠের ঘনত্ব এবং পাতার পানি ধারণক্ষমতার মাত্রা বেড়ে যাবে।
সুন্দরবনের গাছের প্রজাতিগুলোর মধ্যে সুন্দরীগাছ সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে বলে মনে করছেন গবেষকরা।
এর আগে বাংলাদেশের পরিবেশবিদরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হুমকির মুখে রয়েছে সুন্দরবনের সুন্দরী গাছ। আগামী ২০ বছরে এটি বিলীন হয়ে যাবার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সঠিকভাবে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করতে না পারা ও সমন্বিত উদ্যোগের অভাবই এর জন্য দায়ী।
সমুদ্রের উপকূলে তীব্রভাবে লবণাক্ততা বাড়ছে যার ফলে শুধু সুন্দরী গাছ নয় পুরো সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়তে পারে।
পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, ‘সুন্দরবনে লবণাক্ততার ফলে যদি সুন্দরী নামক বড় গাছগুলো না থাকে, ফলে সেখানে পানি এত লবণাক্ত হবে যে বাঘের অস্তিত্ব, হরিণের অস্তিত্ব এবং পুরো গাছপালার যে সিস্টেম আছে সেটাই হারিয়ে যাবে’।
অধ্যাপক নিশাত বলেন, এর সমাধান হচ্ছে লবণাক্ততা কমানোর জন্য সুন্দরবনে মিঠাপানি সরবরাহ করা। তার মতে, একটি ব্যারাজ তৈরি করে গঙ্গা থেকে পাওয়া পানির কিছুটা সুন্দরবনে ধাবিত করলে লবণাক্ততা অনেকটাই কমে যাবে।
দীর্ঘ সময় ধরে জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণা করছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান।
আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে সুন্দরবনে। দূষিত হচ্ছে মাটি ও বাতাস। ক্রমাগত কমছে উপকূলের রক্ষাকবচ হিসেবে পরিচিত সুন্দরীগাছ। এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য ও প্রাণিকুলেও।’
এই গবেষক আরো বলেন, ‘সুন্দরী গাছ অনেক উঁচু হওয়ায় সমুদ্রের ঝড় তাতে বাধা পায় এবং সেটি দুর্বল হয়ে স্থলভাবে আছড়ে পড়ে। বিশাল ক্ষতি থেকে রক্ষা পাই আমরা; কিন্তু আশঙ্কাজনকহারে বনের মাটি ও পানিতে লবণাক্ততা বাড়ায় মারা যাচ্ছে অনেক সুন্দরী গাছ। নোনা পানিতে পড়ে নষ্ট হচ্ছে এ গাছের বীজ। প্রকৃতির বৈরিতায় কমছে উচ্চতাও। এতে গাছগুলোকে ঘিরে প্রাণিকুলের যে বাস্তুতন্ত্র, তাতেও পরিবর্তনের হাওয়া। এটা চলতে থাকলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতি বেড়ে যাবে। এর প্রমাণ মেলে সামান্য ঝড়েই বনের ক্ষত দেখে। সুন্দরবনে আগেও গাছ ভাঙত, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর মাত্রা বেড়েছে বহুগুণ। মূলত সুন্দরী গাছের উচ্চতা কমে যাওয়ায় ঝড়ো হাওয়া সরাসরি গিয়ে লাগছে বনে। প্রাণ হারাচ্ছে প্রাণীও।’
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক এএসএম সাইফুল্লাহ বলেন, ‘সুন্দরবন নিজের ক্ষতি করে মানুষের ক্ষয়ক্ষতি আগলে রাখে। অথচ এটিকে রক্ষায় গুরুত্ব না দিয়ে উল্টো ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছি আমরা। এখনো সচেতন হলে হয়তো খানিকটা প্রাকৃতিক সম্পদ বাঁচানো সম্ভব; কিন্তু এ সময়টাও চলে গেলে তখন আর বিপদের শেষ থাকবে না। তাই আমাদের অতিআপন সুন্দরবনকে বাঁচাতে আটকাতে হবে ম্যানগ্রোভ নিধন। বন্ধ করতে হবে বনের আশপাশে সব ধরনের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম।’
তবে বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনকে নিয়ে তেমন গবেষণা করার সুযোগ মেলে না জানিয়ে এ গবেষক বলেন, ‘এ অঞ্চলের জলে-জঙ্গলে কোন কোন প্রাণী ও উদ্ভিদ হারিয়ে গেছে, তা নিয়ে অবিলম্বে সমীক্ষা হওয়া প্রয়োজন। সেই সাথে স্থানীয়দের হাতে বন ধ্বংসেও নিয়ন্ত্রণ জরুরি। তবে এটি করতে হলে, তাদের বিকল্প কাজ দিতে হবে আগে। যারা জীবিকার জন্য গাছ কাটেন, কিংবা মাছ ধরেন, তারা নিজেরাই স্বীকার করছেন— সুন্দরবন হচ্ছে মায়ের মতো। অন্য কোনো কাজ পেলে এ বনের ক্ষতি হয়, এমন কিছুই তারা করবেন না।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২৩
আপনার মতামত জানানঃ