মানব সভ্যতা রাতারাতি বর্তমান অবস্থায় আসেনি। বিবর্তনের ধারায় প্রকৃতির সাথে ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে অনেক উত্থান-পতন, ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে আজ মানব সভ্যতা এই যায়গায় এসে পৌঁচেছে। এর মধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে অনেক উন্নত সভ্যতা। তবে হাজার বছরের সেসব সভ্যতার নিদর্শন আজও খুঁজে পাওয়া যায়। তেমনি এবার সুন্দরবনে এক থেকে দেড় হাজার বছরের পুরোনো মানববসতির নিদর্শন পাওয়া গেছে।
তবে এই নিদর্শন প্রায় ১ হাজার ২০০ বছরের পুরোনো হতে পারে বলে ধারণা প্রত্নতাত্ত্বিকদের। খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি ইউনিয়নের রেজাকপুর গ্রামে মন্দিরের মতো দেখতে একটি স্থাপনাসহ বসতির নিদর্শন পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে পোড়া চাল, কড়ি, মূর্তি, টেরাকোটা, মাটির তৈরি বড় কড়াইয়ের আংটাসহ বেশ কিছু নিদর্শন।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনার নেতৃত্বে একটি দল এসব নিদর্শনের সন্ধান পেয়েছে। এলাকাটিতে গত ১২ মার্চ থেকে খননকাজ শুরু হয়। চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত এই খননকাজ চালিয়ে যাবে প্রত্নতাত্ত্বিক দলটি।
দলটির ধারণা, কপিলমুনি থেকে সাতক্ষীরার তালা পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার এলাকায় প্রাচীন বসতিসহ ধর্মীয় ও বাণিজ্যিক স্থাপনার নিদর্শন থাকতে পারে। খননসহ অনুসন্ধান চালালে এই নিদর্শনের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে বলে তারা আশাবাদী।
প্রত্নতাত্ত্বিক দলটির প্রধান আফরোজা খান। তিনি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক। আফরোজা খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘রেজাকপুর গ্রামে পাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো পর্যবেক্ষণ করে আমাদের মনে হয়েছে, তা ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ বছরের পুরোনো। আগে খুলনা, সাতক্ষীরা ও যশোর এলাকায় যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে, তার সঙ্গে রেজাকপুরের নিদর্শনের মিল আছে। ফলে পুরো এলাকায় প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন থাকতে পারে বলে আমাদের মনে হচ্ছে।’
সুনির্দিষ্টভাবে বয়সকাল জানতে চালসহ অন্যান্য নিদর্শনের বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।
সুন্দরবনের কাছের এই লবণাক্ত এলাকাটির মানুষের প্রধান পেশা মাছ ধরা ও লবণ চাষ বলে এত দিন মনে করা হতো। কারণ, এই এলাকায় ধান চাষের কোনো প্রমাণ আগে পাওয়া যায়নি। কিন্তু এখন খননে চাল পাওয়া গেল।
প্রত্নতাত্ত্বিক দলটি বলছে, কপিলমুনি ইউনিয়নের কপিলমুনি, রেজাকপুর, রামনগর, সিংহজানি, কাশিমনগরসহ বড় একটা এলাকাজুড়ে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে বলে প্রাথমিক জরিপে দেখা গেছে, যা এখনো টিকে আছে। আগে রেজাকপুরের এলাকাটি ‘কপিলমুনি-আগ্রা’ নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু প্রশাসনিক নাম পরিবর্তনের কারণে কপিলমুনির সঙ্গে থাকা আগ্রা অংশ বাদ পড়ে যায়।
সুন্দরবনের কাছের এই লবণাক্ত এলাকাটির মানুষের প্রধান পেশা মাছ ধরা ও লবণ চাষ বলে এত দিন মনে করা হতো। কারণ, এই এলাকায় ধান চাষের কোনো প্রমাণ আগে পাওয়া যায়নি। কিন্তু এখন খননে চাল পাওয়া গেল।
রেজাকপুরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এলাকাটির নাম ‘কপিলমুনি ঢিবি’ দিয়েছেন এই কাজে যুক্ত প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। তারা জানান, ঢিবিটির আনুমানিক দৈর্ঘ্য ২৫০ মিটার। প্রস্থ ১৮০ মিটার। ঢিবিটি সমুদ্রসমতল থেকে ৩ দশমিক ৪৪ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত।
ঢিবিটির দক্ষিণ অংশে এখনকার প্রত্নতাত্ত্বিক খনন পরিচালিত হচ্ছে। ঢিবি এলাকায় বসতবাড়ি, গোয়ালঘর, রাস্তা, পুকুর, ডোবা, ফলবাগান, বাঁশঝাড় রয়েছে। গর্ত করে ইট তুলে ঢিবিটির ওপর ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। জরিপকালে স্থানীয় অধিবাসীরা জানান, ঘরবাড়ি করার সময় তারা প্রচুর ইটের গাঁথুনি সরিয়েছেন।
প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে এই ঢিবিতে একটি বর্গাকার স্থাপত্যকাঠামো আবিষ্কৃত হয়। বর্গাকার কক্ষটি ঘিরে একটি প্রদক্ষিণপথ রয়েছে। প্রদক্ষিণপথটি দেয়াল দিয়ে পরিবেষ্টিত।
চলমান খননে স্থাপত্যকাঠামোটির কোণগুলোতে কৌণিকভাবে প্রসারিত দেয়াল পাওয়া গেছে। এই দেয়ালগুলোর স্বরূপ ও প্রকৃতি আরও বেশি স্থানজুড়ে খনন হলে বোঝা যাবে।
প্রত্নতাত্ত্বিক খননে বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র ও মৃৎপাত্রের টুকরা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে হাঁড়ি, কলস, বাটি, থালা, বদনা, কড়াই, প্রদীপ প্রভৃতির শরীর (বডি), কান্দা, নলসহ বিভিন্ন ভাঙা অংশ। এ ছাড়া পোড়ামাটির ফলকের ভাঙা অংশ, পোড়ামাটির প্রতিমার ভগ্নাংশ, অলংকৃত ইট, কড়িসহ বিভিন্ন ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক উপকরণ পাওয়া গেছে।
বর্গাকার স্থাপত্যকাঠামোর উত্তর-পশ্চিম কোণ ও উত্তর-পূর্ব কোণের প্রদক্ষিণপথের বাইরের দেয়ালের মাটির সঙ্গে মিশ্রিত অবস্থায় কালো রঙের চাল পাওয়া গেছে। একে পোড়া চাল বলছেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। এই চাল নিয়ে গবেষণা করলে এখানকার প্রাচীন আমলের ধানের প্রজাতিসহ প্রকৃতি-প্রতিবেশ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে মধ্যযুগের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শহিদুল হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবশেষ এই আবিষ্কার সম্পর্কে আমি যতটুকু জেনেছি, তাতে মনে হয়েছে, আমাদের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলজুড়ে সংগঠিত, পরিকল্পিত বসতিসহ অবকাঠামো গড়ে উঠেছিল। সেখানে নতুন আবিষ্কৃত তিনটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের দুটিতে চাল পাওয়া গেছে। তার মানে সেখানে আগে কৃষিকাজ হতো। আমাদের ইতিহাস বইয়ে ওই অঞ্চলের এত প্রাচীন সভ্যতা বা কৃষিকাজ–সম্পর্কিত কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, এই আবিষ্কার আমাদের ইতিহাসের একটি নতুন সংযোজন।’
এত দিন পর্যন্ত সুন্দরবনের গভীর অরণ্যকে মানুষের বাসযোগ্য করে তোলার কৃতিত্ব দেওয়া হতো ব্রিটিশদেরই। ১৭৫৭ সালে মোগল বাদশাহ দ্বিতীয় আলমগীরের কাছ থেকে সুন্দরবনের মালিকানা পায় ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি। এরপর ১৭৬৪ সালে সুন্দরবনের প্রথম মানচিত্র তৈরি করে তারা। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় বোঝা যায়, এর বহু আগে থেকেই সুন্দরবনে মানুষের বসবাস ছিল। আধুনিক যুগের গোড়ার দিকে এই সভ্যতা কী করে পুরোপুরি হারিয়ে গেল তা নিশ্চিত নয় প্রত্নতত্ত্ববিদদের কাছে। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার বিশেষজ্ঞ ফণীকান্ত মিশ্র জানিয়েছেন, এই হারানো সময়টিকে খুঁজে বের করাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। জানা গেছে, সুনির্দিষ্ট স্থান ধরে তার প্রতিষ্ঠান বেশ কিছুদিন থেকে খনন চালাচ্ছে। তারা জানিয়েছে, ওখান থেকে যেসব টেরাকোটার মানুষ ও জীবজন্তুর মূর্তি উদ্ধার হয়েছে, তা খ্রিস্টাব্দ শুরু হওয়ার সমসাময়িক, এমনকি তার আগেরও রয়েছে। সিলমোহরের চিহ্ন আঁকা যেসব টেরাকোটার টুকরা পাওয়া গেছে তা প্রাগৈতিহাসিক যুগের সাক্ষ্য দেয়।
এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার হওয়ার ঘটনাটিকে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ের উন্মোচন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলেন, ‘ওই স্থাপনাগুলো নিয়ে আরও গভীরতর গবেষণা হলে সুন্দরবন এবং এই এলাকার ইতিহাস সম্পর্কে অনেক চমক লাগানো তথ্য হয়তো আমরা পাব।’
আরও বলেন, ‘পশ্চিমা ইতিহাসে খ্রিষ্টপূর্বাব্দ কাল থেকে বাংলা একটি সমৃদ্ধ সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। হাজার বছর আগের লবণ চাষ, সমুদ্রতীরে প্রাচীন বসতি হয়তো সেই পরিচয়কে আরও স্পষ্ট করে তুলবে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৫৪
আপনার মতামত জানানঃ