শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও গৃহকর্মীর কাজে নিযুক্তদের ৩৮ দশমিক ৬ শতাংশই শিশু (১৮ বছরের নিচে)। আবার এর মধ্যে অর্ধেকই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় এই চিত্র এসেছে।
গতকাল রোববার (১২ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাদের সমীক্ষার বিষয় ছিল, ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি বাস্তবায়ন নিরীক্ষা এবং উত্তরণের উপায়।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ আবাসিক এবং শূন্য দশমিক ৫৮ শতাংশ অনাবাসিক গৃহশ্রমিক যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তবে গবেষণায় অংশ নেওয়া বাকি গৃহশ্রমিকেরা যৌন নির্যাতনের বিষয়ে কথা বলতে আগ্রহী হননি। আবার যারা কথা বলেছেন, তারাও খুব অনাগ্রহ নিয়েই যৌন নির্যাতনের বিষয়ে বলেন।
ঢাকা শহরের ২৮৭ জন নারী গৃহশ্রমিকের ওপর এই সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, আবাসিক গৃহশ্রমিকদের ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ কোনো মজুরি পান না, তারা শুধু থাকা ও খাওয়ার বিনিময়ে শ্রম দিয়ে থাকেন। ৬৪ শতাংশ গৃহকর্মী কোনো সাপ্তাহিক বা মাসিক ছুটি পান না বলে সমীক্ষায় দেখা গেছে।
এদিকে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিল্স) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারাদেশে গত ২০ বছরে (২০০১ থেকে ২০২০) কর্মক্ষেত্রে ৫৭৮ গৃহকর্মী লাশ হয়েছে। তাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। এই সময়ে ১ হাজার ৫৬০ গৃহকর্মী কর্মক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, আহত, রহস্যজনক মৃত্যু, আত্মহত্যা ও হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে।
গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৪৪। আর চলতি বছরের গত ছয় মাসে (জানু-জুন) দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতনে আহত হয়েছে ১২ জন, মৃত্যুবরণ করেছে তিনজন, নির্যাতন সইতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় দুই গৃহকর্মী। যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তিনজন।
সংস্থাটি জানায়, ২০ বছরে ১৫ শতাধিক গৃহকর্মী হত্যা-নির্যাতনের ঘটনায় বিচার সম্পন্ন হয়েছে মাত্র তিনটির।
ডমেস্টিক ওয়ার্কার্স রাইটস নেটওয়ার্ক (ডিডাব্লুআরএন) সদস্য সচিব নাজমা ইয়াসমিন এক জাতীয় দৈনিককে বলেন, নির্যাতনের কারণে কোনো গৃহকর্মীর মৃত্যু হলেও বেশিরভাগ ঘটনায় গৃহকর্তা বা কর্ত্রী হত্যাকা-টিকে দুর্ঘটনা কিংবা আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভিক্টিমের পরিবার থেকে হত্যার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করা হলেও ময়নাতদন্ত রিপোর্টে কী আসে তার দোহাই দিয়ে গৃহকর্মীর নির্যাতন পরবর্তী মৃত্যুর মামলা নেওয়া হয় ‘অপমৃত্যু’ হিসেবে। ওইসব মামলার তদন্ত পরবর্তীতে ময়নাতদন্তের রিপোর্টের দোহাই দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয় বছরের পর বছর।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ’র (বিল্স) পরিচালক ও প্রকল্প সমন্বয়কারী নাজমা ইয়াসমিন জানান, নির্যাতনে মৃত গৃহকর্মীর লাশের ময়নাতদন্ত রিপোর্টেও করা হয় নানা কারসাজি। কারসাজির এই রিপোর্ট নিয়ে আদালতে দাখিল করা হয় চূড়ান্ত প্রতিবেদন। ভিক্টিমের পরিবার দরিদ্র হওয়ায় গৃহকর্তার পেশি ও টাকার শক্তির কাছে কুলিয়ে উঠতে পারেন না তারা। একপর্যায়ে নিহতের পরিবারকে টাকা দিয়ে সমঝোতা করে ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে দেন গৃহকর্তা, যা আইনের পরিপন্থি। বিষয়টি জেনেও রহস্যজনক কারণে নিশ্চুপ থাকেন তদন্ত কর্মকর্তারা। এক সময়ে গৃহকর্মী হত্যার সেই ঘটনা হয়ে যায় আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনা। অনেক ক্ষেত্রে ঘটনার শিকার গৃহকর্মীর পরিবারকে খালি হাতেই শহর ছাড়া করা হয়।
আবার অনেক ভিকটিমের পরিবার ঝামেলা এড়াতে আদালতের দ্বারস্থ হতেই আগ্রহী থাকেন না। দারিদ্রতার কাছে হার মেনে নিজেরাই গৃহকর্তার কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে মিটমাট করে ফেলেন ঘটনা। বিচারিক দীর্ঘসূত্রতা ও সমঝোতার কারণে এ ধরনের নির্যাতন রোধ করা যাচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অসংখ্য গৃহকর্মী (শিশু, নারী ও পুরুষ) প্রতিদিনই শারীরিক ও যৌন নির্যাতন, হত্যা, অপমৃত্যুর শিকার হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে। তবে বেশিরভাগ নির্যাতনের ঘটনা আইনি পদক্ষেপ পর্যন্ত যাচ্ছে না। আবার আদালত পর্যন্ত গড়ালেও বিচারে দীর্ঘসূত্রতায় অনেক ঘটনা পড়ে আছে ফাইলবন্দি হয়েই।
আর এ সুযোগে আইনের ফাঁকফোকর গলে পার পেয়ে যাচ্ছেন অভিযুক্তরা। এ ছাড়া প্রভাবশালীদের ক্ষমতার দাপটে ভিকটিমের অভিভাবকদের সঙ্গে সমঝোতার কারণেও বেশিরভাগ ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায় বলে গৃহকর্মীদের নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৪১৮
আপনার মতামত জানানঃ