গত ১৪ বছরে দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়াসহ নানানভাবে গুম হয়েছেন ছয় শতাধিক ব্যক্তি। যাদের অধিকাংশ সরকারের সমালোচনাকারী অথবা রাজনৈতিক নেতাকর্মী। এর মধ্যে ৭৮ জনের লাশ পাওয়া গেছে। প্রায় দেড় শ ব্যক্তির খোঁজ মিলেছে, যার মধ্যে অনেককে পাওয়া গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার দেখানোর পর। তবে বাকিদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা আর জানা যায়নি। এদিকে পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে হারিয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন স্বজনরা। প্রিয়জনের খোঁজ করতে গিয়ে হয়রানি, ভয়ভীতিসহ নানা অমানবিক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন।
আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে সোমবার (৩০ আগস্ট) গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এতথ্য দেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ৩০ আগস্ট আন্তর্জাতিক গুম বা বলপূর্বক অন্তর্ধান প্রতিরোধ দিবস। এর আগে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) গুমের শিকার সব নিখোঁজ ব্যক্তিকে অবিলম্বে খুঁজে বের করা, প্রতিটি গুমের অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠন, দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং গুমের শিকার ব্যক্তি ও তার পরিবারের যথাযথ পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানাচ্ছে। একইসঙ্গে গুম সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ স্বাক্ষর করে গুম প্রতিরোধে সরকারের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানানো হয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ২০০৭ থেকে ২০২০ (২৫ আগস্ট) পর্যন্ত ৬১৪ জন গুমের শিকার হয়েছে বলে ভুক্তভোগী পরিবার ও স্বজনরা অভিযোগ তুলেছেন। এদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ৮৯ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং ৫৭ জন ফেরত এসেছে। অন্যদের বিষয়ে সুর্নিদিষ্ট তথ্য গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়নি।
এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবার, স্বজন বা প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা, সাংবাদিক বা মানবাধিকার সংগঠনের তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, বিশেষ বাহিনী-র্যাব, ডিবি পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়ে সাদা পোশাকে ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের তুলে নেওয়া হচ্ছে। প্রায়ই সংশ্লিষ্ট বাহিনী তাদের গ্রেপ্তার বা আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে। পরিচিত কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ছাড়া খুব কম ক্ষেত্রেই আলোচনা বা আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং উদ্ধারের তৎপরতা লক্ষ করা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গুম হওয়ার কিছুদিন পর হঠাৎ করেই তাদের কোনও মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় বা ক্রসফায়ারে তাদের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়। যারা ফিরে আসতে পেরেছেন তাদের ক্ষেত্রেও কী ঘটেছে তা জানা যায় না।
গুমের মতো ঘটনা প্রতিরোধে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছেও তিনটি দাবি জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র। সেগুলো হলো- গুমের অভিযোগগুলো নিয়ে অনুসন্ধান করা; নিখোঁজদের খুঁজে বের করা এবং ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯-এ এ ক্ষেত্রে কোনো আইনি বাধা থাকলে তা দ্রুততার সঙ্গে দূর করতে সরকারের সঙ্গে জোর যোগাযোগ চালিয়ে যাওয়া, ভুক্তভোগী বা তাদের পরিবারকে আইনি ও নৈতিক সহায়তার উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে উত্থাপিত অভিযোগ নিয়ে একটি জাতীয় শুনানির আয়োজন করা।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক আবু আহমেদ ফয়জুল কবির গণমাধ্যমকে বলেন, পরিসংখ্যানটি পুরোপুরি গণমাধ্যম নির্ভর। গণমাধ্যমে যখন লেখা হয়, ‘পরিবার অভিযোগ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে ধরে নিয়ে গেছে’- শুধু তখনই আমরা সংখ্যাটি গণনায় নিয়ে আসি। আমরা এ বছর দেখতে পাচ্ছি পূর্বের বছরের তুলনায় এবার এ ধরনের অপহরণের সংখ্যা কমে এসেছে, তবে প্রবণতা আছে। এটি আশাব্যঞ্জক। এ ধরনের ঘটনা দেশে আর ঘটবে না সেটাই আমাদের কাম্য। কারও বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ থাকে তাহলে তাকে অবশ্যই আইনের কাছে সোপর্দ করতে হবে। কারণ প্রত্যেক ব্যক্তির আইনের অধিকার পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এটি তার সাংবিধানিক অধিকার।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইনজ্ঞ শাহদীন মালিক বলেন, ‘যে কোনো দেশের নাগরিকের জীবন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের প্রধানতম দায়িত্ব। এ ধরনের ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বলছে, আমরা কিছু জানি না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিখোঁজ হওয়ার অনেকদিন পরে তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। রাষ্ট্রের এ আচরণ সংবিধান পরিপন্থি। বাংলাদেশ যেসব আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদে স্বাক্ষর করেছে সেগুলোর পরিপন্থি। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বিশেষত হিউম্যান রাইট ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) কয়েক বছর ধরে এসব বিষয়ে আমাদের রাষ্ট্রকে ভর্ৎসনা করছে। আমরা যতই আমাদের ভাবমূর্তি নিয়ে গর্ববোধ করি, এ গুমের ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা ও ভাবমূর্তিকে বিপদগ্রস্ত করছে।’
আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস আজ
আজ আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস। সারা পৃথিবীতে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিকভাবে দিবসটি পালিত হচ্ছে। ২০০২ থেকে কাজ শুরু করে ২০০৬ সালের মাঝামাঝি নাগাদ গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদ রচনা করে জাতিসংঘ। ইংরেজিতে নাম দেওয়া হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর প্রটেকশন অব অল পারসন্স অ্যাগেইনস্ট এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’।
২০১০ সালের ডিসেম্বরে এই আন্তর্জাতিক সনদ কার্যকর হয়। তাতে ৩০ আগস্টকে আন্তর্জাতিক গুম-প্রতিরোধ দিবস ঘোষণা করা হয়। এরপর ২০১১ সাল থেকে বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালিত হচ্ছে।
সোমবার (৩০ আগস্ট) আন্তর্জাতিক গুমবিরোধী দিবস। প্রতিবছর জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালন করা হয়। বাংলাদেশও গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা এ দিবসে একত্রিত হন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় ছাড়াও নানানভাবে গুম-অপহরণের ঘটনা ঘটছে দেশে। এ প্রেক্ষিতে মানবাধিকার সংগঠনগুলো গুম ও নীপিড়ন বন্ধে প্রয়োজনীয় পক্ষদেপ নেয়ার দাবি জানিয়েছে সরকারের প্রতি। একইসঙ্গে এ পর্যন্ত গুমের শিকার ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেয়ারও দাবি জানিয়েছে তারা। বিভিন্ন ব্যক্তিকে গুমের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের শাস্তিরও দাবি জানানো হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, পত্র-পত্রিকায় গুম বা অপহরণের খবরের প্রেক্ষিতে একটি পরিসংখ্যান করা হয়। গত ১৪ বছরে ৬ শতাধিক ব্যক্তির গুম হওয়ার যে হিসেবে এসেছে, তা মূলত গণমাধ্যমে আসা খবরের প্রেক্ষিতে পাওয়া। তবে গুমের পরিমাণ আরও অনেক বেশি হতে পারে। কারণ, অনেক খবর গণমাধ্যমে আসেনি অথবা গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার কোন অভিযোগ করেনি। প্রতিবছর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে গুমের ঘটনা ঘটলেও এটি বরাবর অস্বীকার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সরকারের নীতি-নির্ধারণী মহল থেকেও গুম হওয়ার ঘটনা অস্বীকার করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে গুমের ঘটনায় প্রকৃত রহস্য আর বের হয় না। এমনকি গুম বা অপহরণের অভিযোগে মামলা হলেও তা সঠিকভাবে তদন্ত হয় না।
সরকারের সমালোচনাকারী ব্যক্তিরাই বেশি গুমের শিকার হচ্ছেন। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের গুম করার ঘটনা ঘটেছে। এমনকি গণমাধ্যম কর্মীরাও গুমের শিকার হয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে গুমের শিকার ব্যক্তিদের খোঁজ মিলে না। কোন ক্ষেত্রে গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার হয়। আবার অনেক সময় গুম হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তার দেখানোর নজিরও রয়েছে।
মানবাধিকার কর্মীদের ভাষ্য, সরকারের সমালোচনাকারী ব্যক্তিরাই বেশি গুমের শিকার হচ্ছেন। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের গুম করার ঘটনা ঘটেছে। এমনকি গণমাধ্যম কর্মীরাও গুমের শিকার হয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে গুমের শিকার ব্যক্তিদের খোঁজ মিলে না। কোন ক্ষেত্রে গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার হয়। আবার অনেক সময় গুম হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তার দেখানোর নজিরও রয়েছে।
মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন গুম হওয়া ব্যক্তির স্বজন
পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে হারিয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন স্বজনরা। প্রিয়জনের খোঁজ করতে গিয়ে হয়রানি, ভয়ভীতিসহ নানা অমানবিক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন। মানবাধিকারকর্মী ও অপরাধ বিশ্নেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে গুম-নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা অনেকটা কমে এসেছে। তবে আগের ঘটনাগুলোর তদন্ত করে রহস্য উন্মোচন না হওয়ায় আইনের শাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাজধানীর মহাখালী এলাকা থেকে বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীর সঙ্গে নিখোঁজ হন তারই গাড়িচালক আনসার। ৯ বছরে তাদের হদিস মেলেনি। আর্থিকভাবে সচ্ছল ইলিয়াসের পরিবার সংকট কাটিয়ে উঠলেও পারেনি আনসারের স্বজনরা। ১১ বছরের স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে কোনোমতে সংসার চালান আনসারের স্ত্রী মুক্তা বেগম। এখন সিলেট সিটি করপোরেশনের তৃতীয় শ্রেণির পদে কর্মরত তিনি।
মুক্তা জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, ‘স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর বাচ্চাটারে নিয়ে অনেক সমস্যায় পড়ি। আত্মীয়-স্বজন কিছু সহায়তা করে। তিনি (আনসার) আমাদের জন্য তেমন কিছু রেখে যাননি। জানি না তিনি আর ফিরবেন কি না।’
এমন অনিশ্চয়তার চাপা কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছে দুই শতাধিক পরিবার। বেশির ভাগ পরিবারেরই উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি হারিয়ে গেছেন দীর্ঘদিন আগে। স্বজনদের খুঁজে তারা হয়রানি, ভয়ভীতিসহ বিভিন্ন অমানবিক অভিজ্ঞতারও মুখোমুখি হচ্ছে।
২০১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে কুষ্টিয়ায় যাওয়ার পথে সাভারের নবীনগর থেকে নিখোঁজ হন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র আল মোকাদ্দাস ও ওয়ালীউল্লাহ ওয়ালীদ। ওয়ালীদের বড় ভাই সাইফুল্লাহ ওই দৈনিককে বলেন, ‘আমরা কয়েক বছর ঘুরে অনেকের সঙ্গে দেখা করেছি। ভাইয়ের সন্ধান চাইতে গিয়ে বিপদ দেখে এক পর্যায়ে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি।’
২০১৯ সালের ১৯ জুন শাহ আলী মাজার এলাকা থেকে নিখোঁজ হন কাঠ ব্যবসায়ী ইসমাঈল হোসেন। তাকে হারিয়ে ১৫ বছরের মেয়ে আর পাঁচ বছরের ছেলেকে নিয়ে সংকটে পড়েছেন স্ত্রী নাসরীন জাহান। তিনি বলেন, একটি কিন্ডারগার্টেনে চাকরি নিয়েছিলেন তিনি। করোনায় সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে। তার স্বামীর ব্যাংক হিসাবে কিছু টাকা আছে; কিন্তু তিনি জীবিত, না মৃত নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত টাকা তোলা যাচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
অপহরণ, গুম, গুপ্তহত্যা, বিচারবহির্ভূত খুন ও হেফাজতে নির্যাতন ও ন্যায়বিচারের সুযোগহীনতার মতো বিষয়গুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের নৃশংসতা ও চরম অপরাধগুলোর অন্যতম। বিশ্লেষকরা বলছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন বিচ্ছিন্নভাবে সংঘটিত হয় না, বরং পরস্পর সম্পৃক্ত; একটি অপরটিকে প্রভাবিত করে এবং চূড়ান্তভাবে আইনের শাসনকে বিপন্ন করে তোলে।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করার জন্য গুমকে একটা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মানুষ আগে যেমন হোটেল, রেস্টুরেন্টে, বাসে, ট্রেনে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতো, তাদের প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিলো রাজনৈতিক পরিমণ্ডল নিয়ে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা এমন কোনো আলোচনা হতে দেখি না। তার একটা বড় কারণ হচ্ছে গুমের মত ঘটনা এমন একটা অবস্থায় মানুষকে নিয়ে গিয়েছে মানুষ আর এখন নিজেকে নিরাপদ ভাবছে না।
আইনজ্ঞরা বলছেন, যদি কোনো ব্যক্তি সরকার বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকেন, যদি কারো ফেসবুক স্ট্যাটাস বা কর্মকাণ্ডে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সরকার বিব্রত হয়, তাহলে তাকে সতর্ক করা কিংবা তাকে শাস্তি দেয়ার আইনি প্রক্রিয়া রয়েছে। রাষ্ট্রের যে কোন নাগরিকের বিরুদ্ধেই মামলা হতে পারে এবং তার দল ও মত যাই হোক, তার বিচারের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এমনকি, তাকে জিজ্ঞাসাবাদেরও আইন রয়েছে। কিন্তু এরপরও কেন মানুষ নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে সেটা অবশ্যই ভেবে দেখা দরকার।
মানবাধিকারকর্মীরা বলেন, ‘নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা পাওয়া প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। নিখোঁজের কোনো অভিযোগ আসামাত্র তা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে। নিরপেক্ষভাবে তার তদন্ত করতে হবে। ভিকটিম পরিবারকে তার স্বজনের অবস্থানের বিষয়ে জানাতে হবে।’
তারা বলেন, বিগত এক দশকে দেশ এমন অবস্থার সাক্ষী যেখান থেকে গণতন্ত্র ক্রমেই সরে গেছে। এমন এক শাসনব্যবস্থার সাক্ষী হয়েছে, যা গণতন্ত্রের যেকোনো রূপ থেকেই অনেক দূরে। ক্ষমতাসীনরা বলপ্রয়োগের ওপরেই আরও নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। দেশ শাসনে এখন বলপ্রয়োগের বাহিনীগুলোই প্রাধান্য পাচ্ছে। বিগত দুই নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহির বিষয়টি অনেক দূরে চলে গেছে। যদিও এগুলোকে ‘নির্বাচন’ বলা যায় কি না, তাও একটি প্রশ্ন।
আরও বলেন, সুষ্ঠূ ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে জবাবদিহির যে প্রক্রিয়া, তা যখন কার্যত অবসিত হয়েছে, তখন আরও বেশি দরকার হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রের বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে জবাবদিহির চেষ্টা করা। কিন্তু, গুমের বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (এনএইচআরসি) কথা বলতে পারার ব্যর্থতার মাধ্যমেই জবাবদিহি না থাকায় তৈরি হওয়া সংকটের গভীরতা বোঝা যায়।
তারা বলেন, গুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলার সময়ে এটা গুরুত্ব দেওয়া দরকার যে, গুমের বিষয়টি শাসনব্যবস্থা ও জবাবদিহির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত; আর এটা খুব স্পষ্টভাবে বলা যে, রাষ্ট্রকে অবশ্যই এর দায় নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৪২
আপনার মতামত জানানঃ