পুলিশ-প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা সংঘর্ষ এবং পাল্টাপাল্টি অবস্থান মূলত দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। বরিশালে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বাসভবনে ছাত্রলীগ-যুবলীগ-আওয়ামী লীগের কর্মীদের হামলার পর আজ টানা চার দিন থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে নগরীতে। পাল্টাপাল্টি মামলা, গ্রেফতারের ঘটনায় বিভাগের রাজনৈতিক মহলে উত্তেজনা বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের জামিন আবেদন না মঞ্জুর করেছে আদালত। পাশাপাশি ইউএনও মুনিবুর রহমান, কোতয়ালী মডেল থানার ওসি নুরুল ইসলাম, এসআই শাহজালাল মল্লিক ও ইউএনও’র বাসভবনে দায়িত্বরত আনসার সদস্যসহ অজ্ঞাত ৪০/৫০ জনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করা হয়েছে।
রথী-মহারথীর টক্কর
ঘটনার পরদিনই প্রশাসন ক্যাডারের পক্ষ থেকে ‘রাজনৈতিক দুর্বৃত্তকে আইনিভাবে মোকাবিলা করা হবে’ জানিয়ে বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়রের গ্রেপ্তার ও শাস্তি দাবি করা হয়। এর বিপরীতে গতকাল শনিবার মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ সংবাদ সম্মেলন করে বললেন, ‘আমি এখান থেকে চলে যাব, কোনো অসুবিধা নেই।’ অর্থাৎ মেয়রের গলায় নরম সুর।
বুধবারের ঘটনার পরদিন বৃহস্পতিবার জরুরি সভা করে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। ওই দিন রাতে সংগঠনটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অবিলম্বে মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর গ্রেপ্তারের দাবি জানায়।
বলা হয়, বরিশালের ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায় সরকারি কর্তব্য পালন করতে গিয়ে ইউএনও কীভাবে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের দ্বারা হেনস্তা হয়েছেন।
মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ ও তার দুর্বৃত্ত বাহিনী সিটি করপোরেশনের কর্মচারীদের দিয়ে নানা প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি এবং পুরো জেলায় ত্রাসের রাজস্ব কায়েম করেছেন উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আইনের মাধ্যমেই দুর্বৃত্তদের মোকাবিলা করা হবে এবং আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।’
নগরীর কালীবাড়ি রোডের সেরনিয়াবাত ভবনে গতকাল সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ বলেন, ‘গ্রেপ্তার করলে আমার বাসা ঘেরাও করা লাগবে না। আমি তো পালিয়ে যাব না। আমাকে বললে থানায় চলে যাব।’
মেয়র আরও বলেন, ‘আগস্ট মাসে আমরা বিশৃঙ্খলা চাই না। আমরা কার বিরুদ্ধে বিশৃঙ্খলা করব। যেটাই হবে তা আমার দল, নেত্রীর বিরুদ্ধে হবে। আমি এখান থেকে চলে যাব, কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু আমি বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই।’
এদিকে, সহিংসতা ও ইউএনওর সরকারি বাসভবনে হামলার ঘটনায় বরিশাল সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর শেখ সাঈদ আহমেদ মান্নাকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে গত শুক্রবার দিবাগত রাতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এর আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তাকে বোনের বাসা থেকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ করেছিল সাঈদ আহমেদের পরিবার। তিনি বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।
পাল্টাপাল্টি মামলা
বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও পুলিশের দায়ের করা দুটি মামলায় ২২ জন আসামির জামিন না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি তাদেরকে হেফাজতে রেখে সুচিকিৎসা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
রোববার (২২ আগস্ট) দুপুরে এই আদেশ দেন বরিশাল মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক মাসুম বিল্লাহ। এর আগের আসামির নিযুক্ত আইনজীবীগণ তাদের জামিন আবেদন করলে এই আদেশ দেয়া হয়।
এদিকে, সংঘর্ষ ও গুলিবর্ষণের ঘটনায় বরিশাল সদর উপজেলার ইউএনও মুনিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দুই মামলার আবেদন আমলে নিয়ে তা গ্রহণ করেছেন আদালত। একই সঙ্গে আগামী ২৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেটশনের (পিবিআই) পুলিশ সুপারকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মাসুম বিল্লাহ।
এর আগে ইউএনও মুনিবুর রহমান, কোতয়ালী মডেল থানার ওসি নুরুল ইসলাম, এসআই শাহজালাল মল্লিক ও ইউএনও’র বাসভবনে দায়িত্বরত আনসার সদস্যসহ অজ্ঞাত ৪০/৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করেন বরিশাল সিটির প্যানেল মেয়র রফিকুল ইসলাম খোকন এবং ইউএনও মুনিবুর রহমান ও আনসার সদস্য সহ ৪০/৫০ জনের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলার আবেদন করেন সিটি করপোরেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা বাবুল হালদার। দুটি মামলাই আমলে নিয়ে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
রফিকুল ইসলাম খোকন এবং মো. বাবুলের করা মামলার আবেদনে ইউএনও মুনিবুর রহমানের বিরুদ্ধে বিসিসির কাজে বাধা দান, বিনা উসকানিতে বিসিসির কর্মচারীদের ওপর গুলিবর্ষণের নির্দেশ প্রদান, হামলা, গুলির মাধ্যমে একাধিক ব্যক্তির অঙ্গহানি এবং ৩০-৪০ জনকে আহত করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
ক্ষমতার প্রদর্শন
ইউএনওর বাসায় হামলা ও সংঘর্ষের পর পুলিশ-প্রশাসনের পক্ষ থেকে মেয়রসহ দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করা হয়। এর প্রতিবাদে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বৃহস্পতিবার থেকে কর্মবিরতি পালন করছেন। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরাও নগরীর পাড়া-মহল্লা থেকে ময়লা-আবর্জনা অপসারণ করছেন না। গত তিন দিন ধরে চলছে এই অবস্থা।
ফলে ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে বরিশাল নগরী। সড়কগুলোতে ময়লা-আবর্জনার স্তূপে ক্রমশ ভারী হচ্ছে পরিবেশ। ময়লা-আবর্জনায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে নগরজুড়ে। কুকুর-বিড়াল এই বর্জ্য তুলে নিয়ে যেখানে-সেখানে ফেলায় পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি রোগবালাই ছড়ানোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে মেয়র বলেন, ‘পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের অনুভূতি আমি বুঝি। সাধারণ জনগণের কোনো দোষ নাই। তারা যেন দুর্ভোগের শিকার না হয়। ধন্যবাদ জানাই তাঁদের (পরিচ্ছন্নতাকর্মী) মন জয় করতে পেরেছি।’
এদিকে, সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা যে ব্যানার ছিঁড়তে ইউএনওর বাসভবনে গিয়ে হামলা ও সংঘর্ষে জড়িয়েছিলেন সেসব ব্যানার-ফেস্টুন এখনো ঝুলছে বরিশাল নগর ভবনের সামনেই। এমনকি এই ভবনের পাশে থাকা জেলা পরিষদের ফটকে তোরণ ও জাদুঘরের দেয়ালে দেয়ালে ঝুলছে ব্যানার।
গতকাল দুপুর থেকে নগরীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা যায়, সদ্য পালিত হওয়া জাতীয় শোক দিবস এবং আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সাঁটানো ব্যানার-ফেস্টুন ঝুলছে। এসব ব্যানার-ফেস্টুন ও তোরণে বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহসহ স্থানীয় রাজনীতিক নেতাদের ছবি রয়েছে।
এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি গাজী নঈমুল হোসেন বলেন, ‘অলিগলিতে কয়েকটা ব্যানার থাকতে পারে। এ ছাড়া আর নেই।’
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৯১৬
আপনার মতামত জানানঃ