পুলিশের কাজ মিছিলে, বিক্ষোভ সমাবেশে বাধা দেয়া না, বরং তা যেন শান্তিপূর্ণভাবে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে শেষ হয় কোনপ্রকার রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই; সেদিকে নজর রাখা তাদের দায়িত্ব।
শান্তিপূর্ণভাবে সংবিধানে অবাধে সভা-সমাবেশ করার অধিকার যেকোনো নাগরিক ও সংগঠনের আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে সংবিধান স্বীকৃত জনগণের এই অধিকার বিভিন্ন সময় কেড়ে নিয়েছে অথবা সংকুচিত বা নিয়ন্ত্রিত করেছে। যা সংবিধানের লঙ্ঘন।
সভা সমাবেশে বাধা জনবিরোধী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি। এতে জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা লঙ্ঘিত হয়। কিন্তু বর্তমান সরকার প্রশাসনকে ব্যবহার করে জনগণের গণতান্ত্রিক কর্মসূচি সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিংয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তাদের স্বৈরতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের দুর্নীতি, লুটপাটসহ সামপ্রতিক সময়ের নানা অপকর্মের কারণে সরকারের প্রতি যে জনরোষ তৈরি হয়েছে সেটা রুখতেই সরকার ও প্রশাসন এমন মানবতাবিরোধী ও মৌলিক অধিকার পরিপন্থি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর নির্বাচন যখন দেশের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে, তখন প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সভা সমাবেশে পুলিশের বাধা রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
এদিকে, আজ বরিশালে পুলিশের বাধায় ছাত্রদল ও যুবদলের বিক্ষোভ মিছিল পণ্ড হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বেগম খালেদা জিয়াকে ‘হত্যার হুমকি’ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ করে যুবদল ও ছাত্রদল। সমাবেশ শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করতে গেলে পুলিশ তাতে বাধা দেয়।
কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে শনিবার বেলা ১১টায় বরিশাল জেলা ও মহানগর বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের সামনে এই বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। বরিশাল মহানগর যুবদলের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতারুজ্জামান শামিমের সভাপতিত্বে বিক্ষোভ সমাবেশ বক্তব্য রাখেন মহানগর বিএনপির আহবায়ক মনিরুজ্জামান খান ফারুকসহ নেতারা।
পরে একই স্থানে মহানগর ছাত্রদলের সভাপতি রেজাউল করিম রনির সভাপতিত্বে আরেকটি বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। সেখানে বক্তব্য রাখেন মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবির জাহিদসহ অন্যান্য নেতারা।
বক্তব্যে মীর জাহিদুল কবির জাহিদ বলেন, ‘অবৈধ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়াকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে যিনি প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দিতে পারেন, তিনি জনগণের প্রধানমন্ত্রী না।
তিনি আরও বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে হুমকির প্রতিবাদে ছাত্রদল বিক্ষোভ মিছিল করলে নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা করছে সরকারদলীয় সন্ত্রাসীরা। উল্টো ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হচ্ছে, গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে। আমরা এর প্রতিবাদ জানাই।’
এদিন বিক্ষোভ সমাবেশকে সফল করতে সকাল থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল এসে দলীয় কার্যালয়ে জড়ো হয়। সমাবেশ শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল দলীয় কার্যালয় থেকে সদর রোডের দিকে বের হওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশের বাধায় তা পণ্ড হয়ে যায়।
বরিশাল মহানগর ছাত্রদলের সভাপতি রেজাউল করিম রনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সব প্রোগ্রামেই পুলিশ আমাদের বাধা দিচ্ছে। চেষ্টা করেছি মিছিল করার, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারিনি।’
বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানার পরিদর্শক লোকমান হোসেন বলেন, ‘জনভোগান্তি এড়াতে সড়কে মিছিল করতে দেয়া হয়নি।’
ভিন্নমত ও পথকে রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা বল প্রয়োগ করে রুদ্ধ করার মানসিকতা জাতির জন্য অভিশাপ বয়ে আনছে। রাজনীতিবিহীন সমাজ জনমনে বিচ্ছিন্নতার জন্ম দেয়, জনগণকে আত্মোপলব্ধি থেকে বঞ্চিত করে এবং ব্যক্তির আত্মবিকাশের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। জননিরাপত্তার অজুহাতে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশকে নিষিদ্ধ করা রাষ্ট্রকে আরো দুর্বৃত্তপরায়ণ করার অপচেষ্টা। গণতন্ত্রহীনতা সমগ্র সমাজকে ভয়ঙ্কর অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে অর্থাৎ সমাজকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে স্থবির করে মধ্যযুগের দিকে ধাবিত করছে।
ভয়াবহ দুর্নীতি, হত্যা, ধর্ষণ ও চরম অব্যবস্থাপনা এই গণতন্ত্রহীনতারই ফসল যা সরকার উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। সংবিধান বহাল রেখে প্রতি ক্ষেত্রেই সংবিধান লঙ্ঘন করে সরকার বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের যে বয়ান দিচ্ছে তা জাতির সঙ্গে নিম্নমানের একটি তামাশামাত্র।
যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার রিপোর্টে বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ সমাবেশের চিত্র
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট ২০২১ কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিস প্রকাশ করেছে। ২০২১ সালের বৈশ্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির মূল্যায়নে তৈরি হয়েছে ‘২০২১: কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিসেস’। বিশ্বের ১৯০টি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টে এ রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি বিশ্বের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যেখানে মানবাধিকার সুরক্ষিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের এই মানবাধিকার রিপোর্টে বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের বিষয়টি বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, যদিও বাংলাদেশের আইনে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকারের বিধান রয়েছে, বর্তমান সরকার এই অধিকার সীমিত করেছে। বর্তমানে বিক্ষোভ এবং বিক্ষোভের মতো সমাবেশের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অগ্রিম অনুমতি নিতে হয়।
রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলির মতে, বিরোধী দলগুলির জমায়েত নিষিদ্ধ করার জন্য আইনী বিধি-নিষেধের কথা বলা হয়। আবার মাঝে মাঝে পুলিশ বা ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরাও বিরোধী দল বা সংগঠনের কর্মীদের বিক্ষোভকে ছত্রভঙ্গ করতে বলপ্রয়োগ করে।
উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা হয় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের পর গত বছরের ২৬-২৮ মার্চে হেফাজত-ই-ইসলামের সদস্যরা বিক্ষোভ করেছিল। তাতে বলা হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা না আসা পর্যন্ত এই বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণভাবে চলছিল। কিন্তু পুলিশ আসার পরেই বিক্ষোভে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভকারী এবং পুলিশ দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এসব ঘটনায় পুলিশ ৩,২৭০ জন নামধারী এবং আরও অনেককে অজ্ঞাতনামা আসামী করে ১৫৪টি মামলা দায়ের করেছে। এই ঘটনায় হেফাজতে ইসলামের সদস্যসহ বিরোধীদলীয় ১ হাজার ২৩০ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার ও আটক করা হয়। এছাড়াও একইসময়ে আন্দোলন করা বাংলাদেশ ছাত্র, যুব ও শ্রমিক অধিকার পরিষদের ৫৩ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়।
এছাড়া বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা প্রায় সারা বছর ধরেই অসংখ্য বিধিনিষেধের কথা জানিয়েছেন। বিশেষকরে, সংসদের বাইরের বিরোধী দল বিএনপিকে অনুষ্ঠান করতে অনুমতি দেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়। গত বছরের ২৯ মার্চ খুলনায় বিএনপি কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত কর্মসূচিতে পুলিশের হামলায় ২০ জন আহত হয়। এছাড়া একই বছরের ৩১ মে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে আয়োজিত দরিদ্রদের জন্য খাদ্য বিতরণ অনুষ্ঠানের কর্মসূচিতে পুলিশ বাধা দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়াও বাংলাদেশের অন্যান্য ছোট ছোট রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ অনুষ্ঠানেও বাধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৩৮
আপনার মতামত জানানঃ