দিনে গুলি আর রাতে বিমান হামলা; হামাস আয়োজিত বিক্ষোভে শত শত ফিলিস্তিনির উপর ইসরায়েল এই ভয়াবহ হামলা চালায়। গতকাল শনিবার (২১ আগস্ট) দিনে ইসরায়েল-গাজার মধ্যকার সুরক্ষিত সীমান্ত বেড়ার কাছে এই গুলি চালানোর ঘটনা ঘটে। এরপর গভীর রাতে ভূখণ্ডটির বিভিন্ন অবস্থানে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। এদিকে আরব লীগ হুঁশিয়ার করে দিয়েছে ইসরায়েলকে। তবে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি সংঘর্ষে মৃত্যুর মিছিল কোন হুঁশিয়ারি কখনও থামাতে পারেনি।
হামলায় শিশুসহ ৪১ ফিলিস্তিনি আহত
এর আগে গাজা সীমান্তে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে শিশুসহ ৪১ ফিলিস্তিনি আহত হন। তাদের মধ্যে ২ জন ফিলিস্তিনির অবস্থা গুরুতর। রোববার (২২ আগস্ট) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, শনিবার গাজার শাসক দল হামাস আয়োজিত বিক্ষোভে শত শত ফিলিস্তিনি অংশগ্রহণ করেন। তারা ইসরায়েল কর্তৃক তাদের এলাকার কঠোর অবরোধের প্রতিবাদ জানাতে এই বিক্ষোভের আয়োজন করেছিলেন।
সেসময় সেখানে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েল-গাজার মধ্যকার অতিসুরক্ষিত সীমান্ত বেড়ার দিকে অগ্রসর হলে ইসরায়েলি বাহিনী গুলিবর্ষণ করে। এতে বিক্ষোভ আরও সহিংস হয়ে ওঠে।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর দাবি, শত শত ফিলিস্তিনি নাগরিক শনিবার ইসরায়েল-গাজার মধ্যকার অতিসুরক্ষিত সীমান্ত বেড়ার কাছে জড়ো হন। এসময় তাদের অনেকে সীমান্ত বেড়ার ক্ষতি করার চেষ্টা করেন, আবার অনেকে ইসরায়েলি সেনাদের দিকে ‘বিস্ফোরক নিক্ষেপ’ করেন।
এ সংক্রান্ত এক বিবৃতিতে জানানো হয়, ‘এই পরিস্থিতিতে আইডিএফ (ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী) সরাসরি গুলিবর্ষণ করাসহ দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণের মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়।’
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শনিবার ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর গুলিতে ১৩ বছর বয়সী এক ফিলিস্তিনি শিশু আহত হয়। ইসরায়েলি সেনারা তাকে মাথায় গুলি করে। তবে গুলিতে আহত অন্য এক ব্যক্তি ছাড়া আহত অন্যান্য ফিলিস্তিনিদের অবস্থা অতটা গুরুতর নয়। হালকা আহত হওয়া ফিলিস্তিনিদের অধিকাংশই পিঠ, পেটসহ শরীরের অন্যান্য অংশে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
অন্যদিকে, ইসরায়েলি সূত্রে দাবি করা হয়, দেশটির একজন আধা সামরিক বাহিনীর সীমান্ত পুলিশ সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
এদিকে শনিবার দিনের এই ঘটনার পর রাতে গাজা ভূখণ্ডের বিভিন্ন স্থাপনায় বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। ইহুদি এই দেশটির সামরিক বাহিনীর দাবি, গাজায় হামাসের চারটি অবস্থানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান। হামলা চালানো স্থাপনাগুলো হামাদের অস্ত্রাগার এবং অস্ত্র তৈরির কারখানা হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
তবে তাৎক্ষণিকভাবে ইসরায়েলের এই বিমান হামলায় এখনও কোনো হতাহত বা ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া যায়নি। এছাড়া গাজা সীমান্তে আরও বেশি সংখ্যক সেনা পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল।
আরব লীগের হুঁশিয়ারি
এদিকে, ইসরায়েলের উপর চাপ বাড়াচ্ছে আরব লীগ। জেরুজালেম নগরীতে ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা এবং পবিত্র আল-আকসা মসজিদে মুসল্লিদের নির্যাতন বন্ধে ইহুদিবাদী দেশ ইসরায়েলকে হুশিয়ার করেছে আরব লীগ। আল-আকসায় অগ্নিসংযোগের ৫২তম বার্ষিকীতে শনিবার এক বিবৃতিতে আরব লীগ এ হুশিয়ারি দেয়।
এ মাসের প্রথম দিকে আরব লিগ লেবাননে হামলার ব্যাপারেও ইসরায়েলকে সতর্ক করেছিল। তখন আরব লিগ বলেছে— ইসরায়েলের নতুন প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটর নেতৃত্বাধীন প্রশাসন যে হামলা চালাচ্ছে, তার অর্থ হচ্ছে— তারা শক্তি প্রদর্শন করছে।
এ অবস্থায় বড় ধরনের সংঘাতে না জড়ানোর জন্য লেবাননের বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিও আরব লিগ আহ্বান জানিয়েছে। পাশাপাশি লেবাননের চলমান রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় সহযোগিতা করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান হয়।
ফিলিস্তিনি-ইসরায়েলে যত প্রাণহানি
জাতিসংঘের সংস্থা ‘অফিস ফর দ্য কোঅর্ডিনেশন অফ হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্স’ ওসিএইচএ ২০০৮ সাল থেকে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতে হতাহতের সংখ্যার হিসাব রাখছে৷ তাদের হিসেবে ১ জানুয়ারি ২০০৮ থেকে ২৬ জুলাই ২০২১ পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৯৫৩ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন৷ এর মধ্যে সাধারণ নাগরিক তিন হাজার ৩৮৮ জন। এই সময়ে এক লাখ ২৮ হাজার ২৭৭ জন ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন৷
ফিলিস্তিনে ২০০৮ সালে ৮৯৯, ২০০৯ সালে ১০৬৬, ২০১০ সালে ৯৫, ২০১১ সালে ১২৪, ২০১২ সালে ২৬০, ২০১৩ সালে ৩৯, ২০১৫ সালে ১৭৪, ২০১৬ সালে ১০৯, ২০১৭ সালে ৭৭, ২০১৮ সালে ৩০০, ২০১৯ সালে ১৩৭, ২০২০ সালে ৩২ ও ২০২১ সালের ২৬ জুলাই পর্যন্ত ৩১২ জন মারা যান৷
২০০৮ সালের ২৪ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১৮ মে পর্যন্ত মারা যাওয়া ইসরায়েলির সংখ্যা ২৬২ জন এর মধ্যে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনাকারী ৯৯ জন ও সাধারণ নাগরিকের সংখ্যা ৪১৷ এই সময়ে ইসরায়েলি আহত হয়েছেন পাঁচ হাজার ৭০৯ জন৷
ইসরায়েলে ২০০৮ সালে ৩৪, ২০০৯ সালে ১১, ২০১০ সালে ৮, ২০১১ সালে ১৬, ২০১২ সালে ৭, ২০১৩ সালে ৬, ২০১৫ সালে ২৬, ২০১৬ সালে ১২, ২০১৭ সালে ১৭, ২০১৮ সালে ১৩, ২০১৯ সালে ১০, ২০২০ সালে ৩ ও ২০২১ সালের ১৮ মে পর্যন্ত ১১ জন মারা যান।
ফিলিস্তিনে মারা যাওয়া পাঁচ হাজার ৯৫৩ জন ফিলিস্তিনির মধ্যে তিন হাজার ৯৮৪ জন পুরুষ, ৬১১ জন নারী, এক হাজার ৭৪ জন বালক ও ২৬৭ জন বালিকা৷ ইসরায়েলে প্রাণ হারানো ২৬২ জনের মধ্যে ২০৮ জন পুরুষ, ৩১ জন নারী, ১৫ জন বালক ও ছয়জন বালিকা রয়েছে৷
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হতাহত হয় ২০১৪ সালে। ওই বছর দুই হাজার ৩২৯ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারান৷ ঐ বছর ইসরায়েলি মারা গেছেন ৮৮ জন৷ হামাসের দুই সদস্য কর্তৃক ইসরায়েলের তিন টিনএজার অপহরণ ও হত্যার পর ঐ বছরের ৮ জুলাই হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজায় হামলা শুরু করেছিল ইসরায়েল৷ শেষ হয়েছিল ২৬ আগস্ট৷
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১২৫২
আপনার মতামত জানানঃ