বিশ্বায়ন বলতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাণিজ্য সম্পর্ক পরিবর্ধনের মাধ্যমে স্থানীয় ও জাতীয় অর্থনীতিকে একটি একক বৈশ্বিক অর্থনীতিতে একীভূতকরণের প্রক্রিয়া বোঝায়। গত শতকে পরিবহন ও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতির ফলাফল হচ্ছে বিশ্বায়ন। যদিও প্রাথমিকভাবে এটি একটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া, তবে এর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব কোনোভাবেই উপেক্ষা করার মতো নয়।
গত শতকে মানবজাতি যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থায় এক সরলরৈখিক উন্নয়ন ঘটিয়েছে। পরিবহন ক্ষেত্রে এ উন্নয়ন দ্রুত পণ্য পরিবহন সহজ করেছে। ফলে জাতিগুলো নিজেদের মধ্যে ব্যাপকভাবে পণ্যের বিনিময় শুরু করেছে। ফলাফল হচ্ছে- প্রতিটি জাতিই বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় একে অপরের ওপর নির্ভরশীল, কোনো দেশ বা জাতির এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার সুযোগ নেই।
তবে মানুষ এই বিশ্বায়নের বিষয়ে খুব সচেতন হয়ে উঠেছে। মানুষ বিশ্বায়নের ভালো দিক নিতে চায় এবং খারাপ দিক বর্জন করতে চায়। মানুষের মনোভাব হলো, বাণিজ্য ভালো, কিন্তু বিদেশি পণ্য আমদানিতে আরও বেশি বেশি বাধা বা প্রতিবন্ধকতা আরোপ করা উচিত। অধিকাংশ মানুষই মনে করেন, বিদেশি পণ্য আমদানিতে বিধিনিষেধ বাড়ানো হোক। সেবার বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। ৩৭ শতাংশ মানুষ বলেছেন, বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা বৃদ্ধি করা হোক। আর ২৭ শতাংশ বলেছেন, বাণিজ্য বাধা হ্রাস বা অপসারণ করা হোক। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বিশ্বের ২৫টি দেশের মানুষের ওপর এ জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারী দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ মনে করেন, বাণিজ্য সম্প্রসারণ ভালো ব্যাপার। তবে ৫ শতাংশ মানুষ তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন।
তবে জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৪৮ শতাংশ বলেছেন, বিশ্বায়ন তাদের দেশের জন্য ভালো। মাত্র ১৩ শতাংশ এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। বাকিরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত মত দেননি বা নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছেন। তবে এ ক্ষেত্রে সব দেশে এক রকম ফলাফল দেখা যায়নি। উন্নত বিশ্বের দেশ ফ্রান্সে বিশ্বায়নের পক্ষে ইতিবাচক মত দিয়েছে মাত্র ২৭ শতাংশ মানুষ। আর উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশ মালয়েশিয়ার সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ বিশ্বায়নের পক্ষে— ৭২ শতাংশ। বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোতে যে প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে, তার আঁচ এ জরিপেও মিলছে।
খুব কম মানুষই এখন মনে করছেন, বিশ্বায়ন ভালো জিনিস। সবচেয়ে বেশি সমর্থন কমেছে মেক্সিকো, কলাম্বিয়া, চিলি ও পেরুতে।
২৫টি দেশের ১৯ হাজার ১৭ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওপর এ জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে। চলতি বছরের ২৬ মার্চ থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত এ জরিপ পরিচালনা করা হয়।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিভাগের প্রধান শন দোহার্তি বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কল্যাণে অর্থনৈতিক বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। এ ছাড়া দারিদ্র্য বিমোচন, স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি ও মানুষের ক্ষমতায়ন হয়। তবে বাণিজ্যের কারণে যে পরিবর্তন আসে, তাতে মানুষের জীবন বিঘ্নিত হতে পারে। এ পরিবর্তন অনেক ক্ষেত্রেই বেদনাদায়ক হয়। আবার স্থানীয় সংস্কার বাধাগ্রস্ত হতে পারে।’ এ জরিপে মানুষের যে মনোভাব দেখা গেছে, তা অনেকটা এভাবে ব্যক্ত করা যায়: মানুষ বিশ্বায়নের ভালো দিক নিতে চায় এবং খারাপ দিক বর্জন করতে চায়।
বিশ্লেষকরা বলেন, বিশ্বায়নের বদৌলতে পণ্য, পুঁজি ও সেবার অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু মানুষের অবাধ যাতায়াত নিশ্চিত হয়নি।
তারা বলছেন, অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের গতি রাজনৈতিক বিশ্বায়নের গতি ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থাটা বিশৃঙ্খল ও সমন্বয়হীন হয়ে পড়েছে। একগাদা কিছু প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠেছে, কিছু মতৈক্য ও বন্দোবস্ত আছে, কিন্তু বৈশ্বিক সরকার-জাতীয় কিছু গড়ে ওঠেনি। বিভিন্ন দেশের অর্থমন্ত্রীরা আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থায় গিয়ে অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। তাদের সিদ্ধান্ত কীভাবে পরিবেশ বা বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলছে, সে ব্যাপারে তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই।
আরও বলেন, উন্নত দেশগুলো নিজেদের মতো করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনীতি সাজিয়ে তার কারখানা ও কৃষকদের বাঁচিয়ে দেয়, যাতে তাদের উন্নয়নশীল বিশ্বের অধিকতর দক্ষ উত্পাদকদের মুখোমুখি হতে না হয়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো আমাদের যে ক্ষতি করে, তার দায়ও এরা এড়িয়ে যায়। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের নেতৃত্বে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা অপব্যয়ী, অর্থাত্ ধনী ঋণগ্রহীতাদের পুরস্কৃত করলেও গরিব ঋণগ্রহীতাদের শাস্তি দেয়। বহুজাতিক ব্যাংকগুলো উন্নয়নশীল দেশে গিয়ে অন্য বহুজাতিক ও বড় বড় করপোরেশনের ব্যাংকার হিসেবে কাজ করে। স্থানীয় শিল্পের বিকাশে তাদের তেমন নজর থাকে না। বিশ্বায়নের কারণে যত মানুষের উপকৃত হওয়ার কথা ছিল, তত মানুষ উপকৃত হয়নি।
তারা বলেন, এই সমস্যার জাদুকরি সমাধান নেই তা সত্য। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই পরিবর্তনের সুযোগ আছে। সে যেমন আমাদের নীতি প্রণয়নের জায়গায় পরিবর্তনের সুযোগ আছে, তেমনি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, বিধিবিধান ও মনোভাবেও পরিবর্তন আনার সুযোগ আছে। এতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বিশ্বায়ন অধিকতর কার্যকর হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭২১
আপনার মতামত জানানঃ