বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে (জিএসআই) গত বছরের তুলনায় ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থানের অবনতি ঘটেছে। ২০২১ সালের বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ৭৬তম অবস্থানে থাকলেও চলতি বছর ১২১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৮৪তম স্থানে রয়েছে।
বৃহস্পতিবার(১৩ অক্টোবর) একটি অনলাইন ইভেন্টের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী এই হাঙ্গার ইনডেক্স প্রকাশ করা হয়েছে।
এ ছাড়া পাকিস্তান, ভারত ও আফগানিস্তানসহ ৩৫টি দেশে ক্ষুধার মাত্রা মারাত্মকভাবে দেখা গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের মাধ্যমে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ের ক্ষুধার মাত্রা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। অপুষ্টির মাত্রা, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের উচ্চতা অনুযায়ী কম ওজন, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের বয়স অনুযায়ী কম উচ্চতা এবং শিশুমৃত্যুর হার হিসাব করে ক্ষুধার মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। বৈশ্বিক, আঞ্চলিক বা জাতীয় যেকোনো পর্যায়ে ক্ষুধার মাত্রা নির্ণয় করতে এ সূচকগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
প্রতি বছর আয়ারল্যান্ডের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড’ এবং জার্মান সংস্থা ‘ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফ’ যৌথভাবে বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে ক্ষুধার পরিমাণ নির্ধারণ করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স (জিএইচআই) অনুসারে, বিশ্বের ৪৪টি দেশ গুরুতর বা উদ্বেগজনক মাত্রায় ক্ষুধায় ভুগছে। বিশ্বে ক্ষুধার মাত্রা এখন বিপর্যয়কর অবস্থায় পৌঁছেছে।
আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থা কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড এবং এর অংশীদার ওয়েল্টহাঙ্গারহিলফ যৌথভাবে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড ও ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে গুরুতর ক্ষুধা পরিস্থিতি বিরাজ করছে দক্ষিণ এশিয়ায়। এরপরই সাহারার দক্ষিণের আফ্রিকা অঞ্চলে দ্বিতীয় সবচেয়ে বেশি ক্ষুধার্ত পরিবেশ রয়েছে। এছাড়া গত ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র খরার মুখোমুখি হয়েছে পূর্ব আফ্রিকার কিছু দেশ; যা সেখানকার লাখ লাখ মানুষের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
সূচকে দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শীর্ণকায় (উচ্চতা অনুযায়ী কম ওজন) ও অপুষ্টির শিকার শিশু রয়েছে। এ ছাড়া সাহারার দক্ষিণে আফ্রিকা অঞ্চলে অপুষ্টি ও শিশু মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি।
পশ্চিম এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকায় ক্ষুধা মাঝারি পর্যায়ে রয়েছে; যেখানে ক্ষুধা প্রশমনের উদ্যোগ নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তবে বিশ্বে ক্ষুধা কম মাত্রায় রয়েছে লাতিন আমেরিকা, ক্যারিবীয়, পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায়।
চলতি বছরের এই সূচকে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে শ্রীলঙ্কা। ১৩ দশমিক ৬ স্কোর নিয়ে দেশটি ৬৪তম অবস্থানে রয়েছে। এরপর ১৫ দশমিক ৬ স্কোর নিয়ে ৭১তম স্থানে রয়েছে মিয়ানমার। অন্যদিকে, বাংলাদেশের আরেক প্রতিবেশি ভারতের অবস্থান ১০৭তম। আর এই সূচকে ২৬ দশমিক ১ স্কোর নিয়ে ৯৯তম স্থানে রয়েছে পাকিস্তান।
বিশ্বে ক্ষুধা মোকাবিলায় অগ্রগতি অনেকাংশে থেমে গেছে। বিভিন্ন ধরনের সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন এবং কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ইতোমধ্যেই লাখ লাখ মানুষকে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে সংকটে পড়তে হয়েছে এবং এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।’
বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে ৫ এর নিচে স্কোর পেয়ে শীর্ষ ১৭ দেশের তালিকায় রয়েছে বেলারুশ, হার্জেগোভিনা, চিলি, চীন, ক্রোয়েশিয়া, এস্তোনিয়া, হাঙ্গেরি, কুয়েত, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, মন্টিনিগ্রো, নর্থ মেসিডোনিয়া, রোমানিয়া, সার্বিয়া, স্লোভাকিয়া, তুরস্ক ও উরুগুয়ে। অর্থাৎ বিশ্বে এসব দেশে ক্ষুধা কম।
সূচকে একেবারে তলানিতে রয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেন। ৪৫ দশমিক ১ স্কোর নিয়ে দেশটি ১২১তম অবস্থানে রয়েছে।
কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড-এর চিফ এক্সিকিউটিভ ডমিনিক ম্যাকসোর্লি বলেন, ‘বিশ্বে ক্ষুধা মোকাবিলায় অগ্রগতি অনেকাংশে থেমে গেছে। বিভিন্ন ধরনের সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন এবং কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ইতোমধ্যেই লাখ লাখ মানুষকে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে সংকটে পড়তে হয়েছে এবং এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।’
‘এটা দুঃখজনক যে আজ ৮২৮ মিলিয়ন মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছেন এবং তাদের মধ্যে অনেকেই শিশু। যাদের এই খাদ্য এবং সম্পদের অভাবে পৃথিবীতে কষ্ট পাওয়া উচিত নয়’ বলেন ডমিনিক।
দ্য স্টেট অব ফুড সিকিউরিট অ্যান্ড নিউট্রিশন-২০২২ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে অপুষ্টিতে ভুগতে থাকা মানুষের সংখ্যা ৮২৮ মিলিয়নে পৌঁছেছে। ২০২২ সালের বৈশ্বিক খাদ্য সংকট প্রতিবেদনে তীব্র ক্ষুধার সম্মুখীন মানুষের সংখ্যাও ২০২০ সালের তুলনায় গত বছর ১৯৩ মিলিয়ন বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মহামারি ছাড়াও দেশে একদিকে দ্রব্যমূল্যের চড়া দাম অপরদিকে ক্ষুধায় ভুগছে মানুষ। জটিল এক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে দেশের মানুষ। দেশের এই পরিস্থিতির জন্য মহামারি যতটা না দায় রাখে তারতচেয়ে বেশি সরকারের ওপর পড়ে বলে মনে করেন তারা। তারা বলেন, সরকারের গাফিলতি ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলাই দেশ আজ গুরুত্বর অনাহারে ও অপুষ্টিতে।
তারা বলছেন, কৃষি খাদ্য পদ্ধতিতে সহায়তা, দীর্ঘমেয়াদী সহায়তার মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে এবং নষ্ট করার মতো কোন সময়ই এখন নেই। জলবায়ু সহনশীল কৃষির ব্যবস্থা করা, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে পানির স্বল্পতা দূর করা, বীজ ও অন্য দরকারি কাঁচামালের দাম কমানো এবং নিজের জন্য শস্য রাখতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬১৮
আপনার মতামত জানানঃ