জাতিসংঘের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের ৮২ কোটি লোক খাবারের তীব্র অভাবে ভুগছে৷ এর মধ্যে রয়েছে পাঁচ বছরের কম বয়সী ১৪ কোটি ৯০ লাখ শিশু৷ বিশ্বের ৫০টি দেশে বর্তমানে দেখা দিচ্ছে ব্যাপক খাদ্য সংকট৷ নতুন করে খাদ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন ৩২ কোটি মানুষ, জানাচ্ছে সাম্প্রতিক সূচক৷
জাতিসংঘের প্রতিবেদনটি আরও বলছে, এশিয়ার ৫০ কোটি লোক প্রয়োজনীয় খাদ্য সংকটে ভুগছে৷ আফ্রিকাতে এ সংখ্যা ২৬ কোটি৷ এদিকে ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকার শতকরা আট ভাগ লোক রয়েছে এ ঝুঁকিতে৷ প্রায় ২০০ কোটি মানুষ পুষ্টিকর খাবারের অভাবে ভুগছে, দাবি প্রতিবেদনের৷
উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে জাতিসংঘ বেঁধে দেয়া সময়সীমা বলে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে ঘোচাতে হবে বিশ্বজুড়ে খাদ্যের অভাব৷ কিন্তু প্রথম কয়েক বছরে উন্নতি করার পর, এখন বাস্তবতা ভিন্ন৷ সাম্প্রতিক ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স’ বা বিশ্ব ক্ষুধা সূচক জানাচ্ছে যে ‘‘ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই বিপজ্জনকভাবে পথভ্রষ্ট” হয়ে পড়েছে৷
বেসরকারি সংগঠন ভেল্ট হুঙ্গারহিলফে অ্যান্ড কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড জানাচ্ছে, গত দুই বছর ধরে অতিমারির ফলে অর্থনৈতিক টানাটানি, জলবায়ু পরিবর্তন ও দেশে দেশে সশস্ত্র সংঘর্ষের বাড়বাড়ন্তের ফলে আরো বেশি মানুষ ক্ষুধার কবলে পড়ছেন।
গত বৃহস্পতিবারে এই সংস্থার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ পায়, যেখানে দেখা যাচ্ছে গত বছর থেকে পর্যাপ্ত পুষ্টি না পাওয়া মানুষের সংখ্যা বিশ্বজুড়ে বেড়েছে ৩২ কোটি৷ এই সংখ্যা বর্তমানে প্রায় আড়াই বিলিয়ন মানুষের সমান, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের সমান৷ অভুক্ত ও অপুষ্টিতে থাকা মানুষের সংখ্যা আজ গত পাঁচ বছরের সংখ্যার মিলিত যোগফলেরও বেশি৷
জলবায়ু বিপর্যয়
পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষকদের সংগঠন ইএসএএফএফ-এর মুখপাত্র জো এমজিঙ্গা বলেন, ‘‘সাব-সাহারান আফ্রিকায় অপুষ্টি ও ক্ষুধার পরিমাণ বাড়ছে কারণ সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে মোকাবিলা করার যথেষ্ট অবকাঠামো নেই৷
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জীববৈচিত্র্যের হারিয়ে যাওয়ার ফলে নির্দিষ্ট কিছু শস্য উৎপাদনে জোর দেওয়ার দিকটি৷ বিশেষ করে দক্ষিণ ও পূর্ব আফ্রিকায় যেভাবে ভুট্টা ফলানো হচ্ছে, তা এই ধারার প্রতীক৷”
বিশেষ শস্য উৎপাদনে জোর দিলে অনেক সময় অন্যান্য পণ্যের অভাব দেখা যায়, যা নতুন করে খাদ্যের সংকট সৃষ্টি করে৷ উইমার্সের মতে, ‘‘যে সব দেশের কার্বন নিঃসরণ অন্যান্য বড় দেশের তুলনায় কম, দেখা যায় শেষ পর্যন্ত তাদের ওপরেই এসে পড়ে জলবায়ু পরিবর্তানের সবচেয়ে বেশি প্রভাব৷”
জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি প্যানেল (আইপিসিসি) বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ফসলের উৎপাদন যেমন কমবে৷ ঠিক তেমনি বাড়বে খাদ্যের দাম৷ ২০৫০ সাল নাগাদ খাদ্যশস্যের দাম ২৩ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে৷ কার্বন নিঃসরণ এভাবে চলতে থাকলে, পরবর্তী ৬০ বছরে অ্যামেরিকার ভূট্টা ও সয়াবিনের উৎপাদন ৮০ শতাংশ কমে যেতে পারে৷
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের তাদের এক প্রতিবেদনেও ‘প্রধান খাদ্য’ উৎপাদন হ্রাস পাবে বলে ইঙ্গিত করেছে৷ ভারতের দক্ষিণে ২০৩০ সালের মধ্যে চাল উৎপাদন ৫ শতাংশ কমে যাবে৷ পরবর্তী তিন দশকে সেটা ১৪ শতাংশে গিয়ে উন্নীত হবে বলে আশঙ্কা রয়েছে৷
এছাড়াও আবহাওয়াতে আসছে পরবর্তন৷ বৈরি আবহাওয়ার খাদ্য শৃঙ্খল ভেঙে পড়ার আশঙ্কাও করছে৷ হিসেব বলছে এখনই উৎপাদিত খাদ্যপণ্যের এক তৃতীয়াংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে৷
মহামারি
পণ্যের মুক্ত চলাফেরায় ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটিয়েছে করোনা মহামারি৷ এর ফলে, জিনিসের দাম বাড়তে থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে আসে৷ নগর ও গ্রাম দুই অঞ্চলেই দারিদ্র্য চরম হয়, দেখা যায় খাদ্যের সংকট, জানাচ্ছে এফএও৷
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি সরকারি গবেষণামতে, মাংস, মাছ, ডিমের মতো পণ্যের দাম ২০১৯ সালের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ৷
পাশাপাশি, আফ্রিকা ও এশিয়ার বহু দেশে খাদ্য পণ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সংকট আরো গভীর হয়েছে৷ অতিমারির আগের তুলনায়, ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলিতে প্রায় ২৬ লাখ শিশু স্বাভাবিক বৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত হয়েছে৷
দক্ষিণ সুদানে জমিতে কাজ করছেন এক কৃষক৷ চলমান সহিংসতার কারণে দেশটিতে অনেকেই অর্থ ও খাদ্য সংকটে ভুগছে৷
যুদ্ধ
সহিংসতায় জর্জরিত অঞ্চলগুলিতে শুধু ফসল নষ্ট হয়, কৃষিকাজে ব্যবহৃত প্রাণীদের চুরি বা মেরে ফেলা হয় ও স্থানীয় জনগণ ঘরছাড়া হয়ে পড়ে৷ এমজিঙ্গা বলেন, ‘‘যুদ্ধের সময়ে আমরা স্বাভাবিক উৎপাদন চালিয়ে যেতে পারিনা৷ বাজারে অংশগ্রহণও স্বাভাবিক থাকে না৷”
বিশ্বের যে ১০টি দেশে ক্ষুধা ও অপুষ্টির সমস্যা সবচেয়ে প্রকট, সেই দশটির মধ্যে আটটি দেশেই এই সংকটের মূল কারণ সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতা, জানাচ্ছে বিশ্ব ক্ষুধা সূচক৷ এর সাথে, যত বেশি উগ্র ও ভয়াবহ হচ্ছে সহিংসতার ধরণ, তত বেশি কঠোর হচ্ছে খাদ্যের অভাব৷
শুধু তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে খাদ্যের অভাব থেকেও জন্ম নিতে পারে সহিংসতার পরিবেশ৷ খাদ্য পণ্যের দখল নিয়ে যত বেশি প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হবে, যত বেশি করে এই দ্বন্দ্বে এসে জুড়বে ধর্ম, ভাষাভিত্তিক সংঘর্ষ, তত বেশি প্রকট হবে খাদ্য সংকট, এমনটাই মত ২০১৭ সালের বিশ্ব খাদ্য প্রোগ্রামের একটি গবেষণার৷
ক্ষুধা সূচকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘খাদ্যের নিরাপত্তার অভাবকে না মিটিয়ে দীর্ঘমেয়াদী শান্তি অসম্ভব৷ শান্তি ছাড়া বিশ্বজুড়ে ক্ষুধাকে হার মানানোর সম্ভাবনাও ক্ষীণ৷’’
এ বিষয়ে উইমার্স বলেন, ‘‘খাদ্য মানুষের মৌলিক অধিকার৷ আজ আমরা এমন একটা সময়ে বাস করি যেখানে প্রতি দিন লাখ লাখ মানুষ এই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হন৷’’
বিশেষজ্ঞদের মতে, সামরিকতন্ত্রী রাষ্ট্র ও যুদ্ধবাজ মানুষের অমানবিক ও সহিংস তাণ্ডবে বিশ্বের বহু দেশের বিপুল সংখ্যক নাগরিক মৃত্যু ও রক্তপাতে নিপতিত, যারা খাদ্যের সংস্থান করা তো দূরস্থিত, জীবন বাঁচাতেই মরিয়া। রণাঙ্গনে, শরণার্থী শিবিরে, পথে পথে সংঘাতদগ্ধ এইসব বিপুল ভাসমান মানুষের জীবন কাটে অনাহারে, অর্ধাহারে, খাদ্যহীনতায়।
সুষম বণ্টন আর শান্তি বিরাজমান থাকলে বিপুলা এই পৃথিবীর উর্বর ভূমিতটে উৎপাদিত খাদ্যের দ্বারা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জন্য অন্ততপক্ষে এক মুঠো ভাত জুটতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু শোষণ, লুণ্ঠন, যুদ্ধ, দখল, রক্তপাতের ফলে তা হচ্ছে না। হিংসা, হানাহানি ও লুটপাটের তাণ্ডবতায় শান্তি, স্থিতি, নিরাপত্তার সঙ্গে সঙ্গে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে মানুষের মুখের গ্রাস।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮০০
আপনার মতামত জানানঃ