করোনার ধাক্কা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি বিশ্ব। মহামারির জেরে দেখা দেয় খাদ্যের সংকট। এর মধ্যেই ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর সেই সংকট তীব্র হয়েছে। কারণ, ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানিতে রুশ বাহিনী বাধা দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে আগামী দুই বছরে বিশ্বজুড়ে ক্ষুধা পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বেসলি। খবর গার্ডিয়ান
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিসলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, আগামী দুই বছরের মধ্যে ক্ষুধার বিপর্যয় বিস্ফোরিত হতে চলেছে, যা নজিরবিহীন বৈশ্বিক রাজনৈতিক চাপের ঝুঁকি তৈরি করবে।
লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্লেয়ার ইনস্টিটিউটের একটি পুস্তিকার মুখবন্ধে এসব কথা বলেন ডেভিড বেসলি। সেখানে আসন্ন ক্ষুধা বিপর্যয় কাটাতে বেশ কিছু স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি। এর মধ্যে একটি রাশিয়া ইউক্রেনে যে ২ কোটি ৫০ লাখ টন শস্য আটকে রেখেছে, তা ছাড় করানো। বেসলির ভাষ্য, যদি সমস্যার কোনো সমাধান না করা হয়, তাহলে বর্তমানে খাবার কেনার সক্ষমতার যে সংকট রয়েছে, তা আগামী বছরে আরও ভয়াবহ হবে।
জাতিসংঘের দেওয়া তথ্য বলছে, করোনা মহামারির আগে ‘খাদ্যের তীব্র অনিরাপত্তার’ মধ্যে থাকা মানুষের সংখ্যা ছিল ১৩ কোটি। পরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ কোটি ৬০ লাখে।
বেসলি জানান, ইউক্রেন সংকটের কারণে এখন এই সংখ্যাটা ৩৪ কোটি ৫০ লাখ। আর ৪৫টি দেশের প্রায় ৫ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষ থেকে মাত্র এক কদম দূরে রয়েছে।
ব্লেয়ার ইনস্টিটিউটের পুস্তিকায় বেসলি লিখেছেন, দিন দিন খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি, রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং প্রধান কিছু খাদ্যপণ্যের সংকট বিশ্ব খাদ্যবাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। ফলে ইউক্রেন যুদ্ধের উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া এমনকি লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতেও।
স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী সংস্কারের আহ্বান জানিয়ে – রাশিয়ার অবরোধে আটকে পড়া ২৫ মিলিয়ন টন ইউক্রেনীয় শস্যের উপর থেকে অবরোধ তুলে নেওয়া সহ – ডেভিড বিসলে বলেছেন যে, বর্তমান খাদ্য ক্রয়ক্ষমতার সংকট সমাধান পাওয়া না পরবর্তীতে আরও বিপজ্জনক খাদ্য প্রাপ্যতা সংকটে পরিণত হতে পারে।
কোভিড সংকটের আগে জাতিসংঘ কর্তৃক ‘তীব্র খাদ্য অনিরাপদ’ হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ লোকের সংখ্যা ছিল ১৩ কোটি, কিন্তু কোভিডের পরে এই সংখ্যা ২৭ কোটি ৬০ লাখে দাঁড়িয়েছে। ক্ষুধার সংকটের উপর ব্লেয়ার ইনস্টিটিউটের একটি নতুন প্যামফলেটের ভূমিকা লিখে, বিসলে বলেছেন, ‘ইউক্রেন সংকটের কারণে এই সংখ্যা বেড়েছে ৩৪ কোটি ৫০ লাখে। এবং ৪৫টি দেশের ৫ কোটি মানুষ এখন দুর্ভিক্ষ থেকে মাত্র এক ধাপ দূরে।
করোনা মহামারির আগে ‘খাদ্যের তীব্র অনিরাপত্তার’ মধ্যে থাকা মানুষের সংখ্যা ছিল ১৩ কোটি। পরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ কোটি ৬০ লাখে।
তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই এই ক্ষুধার বিপর্যয় থামাতে পদক্ষেপ নিতে হবে – নতুবা এই সংখ্যাগুলি বিস্ফোরিত হবে। ইউক্রেনের সীমানা থেকে অনেক দূরে ছড়িয়ে পড়া মূল্যবৃদ্ধি, রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা এবং মৌলিক খাদ্যদ্রব্যের ঘাটতি সহ বিশ্বব্যাপী খাদ্য বাজারগুলি অশান্তিতে নিমজ্জিত হয়েছে। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া এমনকি লাতিন আমেরিকার দেশগুলোও এই সংঘাতের উত্তাপ অনুভব করছে।’
যুক্তরাজ্যের ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর অ্যান্ড্রু বেইলি সম্প্রতি বলেছেন, ব্রিটেনে খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি ‘বিপর্যয়কর’ স্তরের দিকে যাচ্ছে। মূলত ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে বিশ্বজুড়ে যে খাদ্যসংকট দেখা দিচ্ছে, সে বিষয়ে বলতে গিয়ে বেইলি এ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য এ আশঙ্কা আরও বড়। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই কয়েক মাস ধরে বড় বড় অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞ বলে আসছেন, টাইডাল ওয়েভ বা মহাজলোচ্ছ্বাসের মতো ক্ষুধার একটি মহাপ্রবাহ বিশ্বজুড়ে বয়ে যেতে পারে।
জাতিসংঘের সংস্থাগুলো এবং বিশ্বের নানা প্রান্তের মানবিক ত্রাণকর্মীরা ক্ষুধার কারণে অগণিত মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা করছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস আবার হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘জাতিসংঘের সংস্থা এবং মানবিক ত্রাণকর্মীদের জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো সম্ভাব্য মৃত্যুর খরচ।’
তিনি বলেছেন, ‘অপুষ্টি, ব্যাপক মাত্রার ক্ষুধা এবং দুর্ভিক্ষ এমন একটি সংকট তৈরি করতে যাচ্ছে, যা বছরের পর বছর স্থায়ী হতে পারে এবং বিশ্বব্যাপী তা দীর্ঘমেয়াদি মন্দার আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দিতে পারে।’
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি আন্দাজ করছে, প্রায় ৪ কোটি ৯০ লাখ মানুষ জরুরি পর্যায়ের ক্ষুধার সম্মুখীন হয়েছে এবং ৮১ কোটি ১০ লাখ মানুষ প্রতি রাতে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায়।
সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলজুড়ে অনাহারের দ্বারপ্রান্তে থাকা মানুষের সংখ্যা কোভিড-১৯–এর আগের তুলনায় এখন ১০ গুণ বেশি। বিশ্বের ৩০ শতাংশ গম সরবরাহকারী দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যে যুদ্ধ চলছে, সেই যুদ্ধ গম, ভুট্টা, বার্লি ও সূর্যমুখী তেলের মতো প্রধান পণ্যগুলোর প্রাপ্যতা এবং দামের ওপর চরম বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ পূর্ব খাদ্যঘাটতি এবং মুদ্রাস্ফীতির প্রবণতাকে এ যুদ্ধ আরও জটিল বা ত্বরান্বিত করেছে। এর বাইরে আছে মহামারির নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব; মহামারির কারণে সরবরাহ-শৃঙ্খল ভেঙে যাওয়া, কর্মসংস্থান সংকট ও পরিবহন সমস্যা; জলবায়ু-সংকট-সম্পর্কিত উৎপাদন হ্রাস; জ্বালানি খরচের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি এবং বিশ্বব্যাপী চলমান অন্যান্য অসংখ্য সংঘাত-সংঘর্ষ।
আন্তর্জাতিক ঝুঁকি পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান ভেরিস্ক ম্যাপলেক্রফ্ট সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে বলেছে, মিসর ও ব্রাজিলের মতো মধ্যম আয়ের দেশগুলো খাদ্য নিরাপত্তাহীনতাকে মোকাবিলা করার বিষয়ে ব্যতিক্রমীভাবে দুর্বল। এই শ্রেণির অনেক দেশের সরকার কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে তাদের আর্থিক এবং বস্তুগত রিজার্ভ নিঃশেষ করে ফেলেছে এবং বড় ধরনের ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছে।
প্রতিষ্ঠানটি তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, আর্জেন্টিনা, তিউনিসিয়া, পাকিস্তান ও ফিলিপাইন খাদ্য ও জ্বালানি আমদানির ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। চলতি ২০২২ সালের শেষ নাগাদ এ দেশগুলোসহ অনেক মধ্য বা নিম্নমধ্য আয়ের দেশগুলোতে নাগরিক অস্থিরতার উচ্চ ঝুঁকি আছে।
খাদ্য ‘দুর্যোগ’ নিকটবর্তী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে দরিদ্র জনগণ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ধনী ব্যক্তিরা অপমানিত হতে পারেন। একটি ক্ষুধার্ত বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, মানবিক সংকট, অস্থিতিশীলতা এবং ভূকৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এএসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩০০
আপনার মতামত জানানঃ