বাংলাদেশে অপুষ্টি ও ক্ষুধা বেড়েছে বলে জানাচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট। প্রতিষ্ঠানটি যে ‘বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক-২০২১’ প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ এক ধাপ পিছিয়েছে। ১১৬টি দেশের মধ্যে এবার বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬ নম্বরে।
২০২০ সালে ১০৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭৫। এর অর্থ দেশে ক্ষুধা বেড়েছে। সূচকের স্কোর অনুযায়ী বাংলাদেশে ক্ষুধার মাত্রা গুরুতর পর্যায়ে রয়েছে।
গত ১লা ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের নির্বাচিত সুচির সরকারকে উৎখাত করে দেশটির সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে। এরপর থেকেই দেশটিতে গৃহযুদ্ধসহ নানা রকম সংকটে পড়ে বিধ্বস্ত অবস্থা বিরাজ করছে। জান্তা বাহিনীর ক্ষমতা দখলের পূর্বের চিত্রও অতটা ভালো ছিল না। এতদসত্বেও, বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশের আগেই রয়েছে মিয়ানমার। অর্থাৎ, বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশ মিয়ানমারের পেছনে রয়েছে।
বিশ্ব ক্ষুধা সূচক-২০২১-এ ১১৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬তম। সূচকে মোট ১০০ স্কোরের মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ১৯ দশমিক ১। এবারের সূচকে বাংলাদেশের প্রতিবেশী মিয়ানমারের অবস্থান ৭১তম, স্কোর ১৭ দশমিক ৫।
বৃহস্পতিবার গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সের ওয়েবসাইটে ২০২১ সালের পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে। এতে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে কারও স্কোর শূন্য হলে বুঝতে হবে, সেখানে ক্ষুধা নেই। আর স্কোর ১০০ হওয়ার অর্থ, সেখানে ক্ষুধার মাত্রা সর্বোচ্চ।
বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের মাধ্যমে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ের ক্ষুধার মাত্রা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। অপুষ্টির মাত্রা, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের উচ্চতা অনুযায়ী কম ওজন, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের বয়স অনুযায়ী কম উচ্চতা এবং শিশুমৃত্যুর হার হিসাব করে ক্ষুধার মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। বৈশ্বিক, আঞ্চলিক বা জাতীয় যেকোনো পর্যায়ে ক্ষুধার মাত্রা নির্ণয় করতে এ সূচকগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
প্রতি বছর আয়ারল্যান্ডের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড’ এবং জার্মান সংস্থা ‘ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফ’ যৌথভাবে বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে ক্ষুধার পরিমাণ নির্ধারণ করে। প্রতিবেদনে ভারতে ক্ষুধার মাত্রাকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
ভারতের জিএইচআই স্কোরও হ্রাস পেয়েছে। ২০০০ সালে স্কোর ছিল ৩৮.৮। তবে ২০১২ থেকে ২১-এর সময়পর্বে এই স্কোর ২৮.৮ থেকে ২৭.৫-এর পরিসরে রয়েছে।
তবে বিশ্ব ক্ষুধা সূচক ২০২১-এ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। সূচকে নেপাল ও বাংলাদেশ একই অবস্থানে রয়েছে। সূচকে বাংলাদেশের আরেক প্রতিবেশী নেপালের অবস্থান ৭৬তম, স্কোর ১৯ দশমিক ১। তবে সূচক ও স্কোর উভয় ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের চেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘কোভিড-১৯ এবং ভারতে মহামারী সম্পর্কিত বিধিনিষেধের কারণে মানুষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভারতে বিশ্বব্যাপী শিশু অপচয়ের হার সবচেয়ে বেশি।’
হিন্দুস্থান টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নেপাল (৭৬), বাংলাদেশ (৭৬), মিয়ানমার (৭১) এবং পাকিস্তান (৯২) ইত্যাদি দেশও ‘ভয়াবহ ক্ষুধা’ শ্রেণীর মধ্যে রয়েছে। কিন্তু ভারতের তুলনায় এই দেশগুলো ক্ষুধার দিক দিয়ে বেশি উন্নত স্তরে রয়েছে।
নেপাল (৭৬), বাংলাদেশ (৭৬), মিয়ানমার (৭১) এবং পাকিস্তান (৯২) ইত্যাদি দেশও ‘ভয়াবহ ক্ষুধা’ শ্রেণীর মধ্যে রয়েছে। কিন্তু ভারতের তুলনায় এই দেশগুলো ক্ষুধার দিক দিয়ে বেশি উন্নত স্তরে রয়েছে।
খাদ্য সুরক্ষা একাধিক কারণে অনিশ্চিত। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ক্রমবর্ধমান সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন এবং কোভিড-১৯ মহামারীর সাথে যুক্ত অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জগুলো আরো বেশি ক্ষুধা সৃষ্টি করছে।’
অবশ্য বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের এই তালিকায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে চীন, ব্রাজিল, কুয়েতের মতো ১৮টি দেশ। এসব দেশের জিএইচআই স্কোর ৫-এরও নিচে রয়েছে।
বর্তমান জিএইচআইয়ের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধার হার কমিয়ে আনার লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না বিশ্বের ৪৭টি দেশ। রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিভিন্ন দিক থেকে খাদ্য নিরাপত্তা ব্যাহত হয়েছে। এই কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, সংঘর্ষ, জলবায়ু পরিবর্তন, করোনাভাইরাস মহামারি সংক্রান্ত স্বাস্থ্য ও আর্থিক চ্যালেঞ্জ।
বৈশ্বিক থিঙ্কট্যাংক সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড পিস(আইইপি) এর এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে, বিশ্বব্যাপী কার্বন নির্গমন যতই বাড়ছে, ততই বাড়ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা৷ এ কারণে এই শতকেই বিশ্বের অনেক মানুষ খাদ্যাভাবে পড়বে, বাড়বে স্বাস্থ্য ঝুঁকি৷ আর তার সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মানুষে মানুষে হানাহানি৷
আইইপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন ও তার প্রভাবে উষ্ণতা বৃদ্ধি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ খাদ্য ও পানীয়জলের সঙ্কটে পড়েছেন এবং দিন দিন এই সংকটের আওতা বাড়ছে।
তাছাড়া, বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যার বৃদ্ধির কারণে অতিরিক্তমাত্রায় ব্যাবহার করা হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানী, ধ্বংস করা হচ্ছে বনাঞ্চল— যা জলবায়ু পরিবর্তনের গতি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী দশকগুলোতে প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পানীয়জলের অভাবে থাকা মানুষের সংখ্যা আরও বাড়বে, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে বাস্তুহারা মানুষের সংখ্যা। এসব কারণে অদূর ভবিষ্যতে দেশে-দেশে, জাতিতে-জাতিতে এবং মানুষে-মানুষে সংঘাত ছড়িয়ে পড়বে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে আইইপি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মহামারি ছাড়াও দেশে একদিকে দ্রব্যমূল্যের চড়া দাম অপরদিকে ক্ষুধায় ভুগছে মানুষ। জটিল এক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে দেশের মানুষ। দেশের এই পরিস্থিতির জন্য মহামারী যতটা না দায় রাখে তারতচেয়ে বেশি সরকারের ওপর পড়ে বলে মনে করেন তারা। তারা বলেন, সরকারের গাফিলতি ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলাই দেশ আজ গুরুত্বর অনাহারে ও অপুষ্টিতে।
তারা বলছেন, কৃষি খাদ্য পদ্ধতিতে সহায়তা, দীর্ঘমেয়াদী সহায়তার মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে এবং নষ্ট করার মতো কোন সময়ই এখন নেই। জলবায়ু সহনশীল কৃষির ব্যবস্থা করা, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে পানির স্বল্পতা দূর করা, বীজ ও অন্য দরকারি কাঁচামালের দাম কমানো এবং নিজের জন্য শস্য রাখতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
আপনার মতামত জানানঃ