বৈশ্বিক অতিমারি করোনার সংক্রমণ শুরু হয় ২০১৯ সালের শেষের দিকে। দেশে দেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর গেল দেড় বছরে পাঁচ লাখ প্রবাসী শ্রমিক বেকার হয়ে দেশে ফিরেছেন।
আজ বুধবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে আয়োজিত সংবাদ সন্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়।
ফেরত আসা প্রবাসীদের পুনর্বাসনে সরকার নতুন একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মাধ্যমে দুই লাখ শ্রমিক ১৩ হাজার ৫০০ টাকা করে নগদ অর্থ সহায়তা পাবেন। এ ছাড়া পুনরায় বিদেশে যাওয়ার সুযোগ, দেশে কাজের সংস্থান, ব্যবসার পুঁজি জোগান- এমন নানা সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা হচ্ছে।
প্রত্যাগত অভিবাসী কর্মীদের পুনঃএকত্রীকরণের লক্ষ্যে অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান সৃজনে সহায়ক প্রকল্প’ নামে এটি বাস্তবায়ন করবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
প্রকল্পে অন্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে— ফেরত আসা প্রবাসীদের দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে বেশি মজুরি পাওয়ার উপযোগী কর্মী তৈরি করা, ক্ষুদ্র ব্যবসার উদ্যোগে আর্থিক সহায়তা দেয়া, কারিগরি এবং অন্যান্য সেবা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করে দেয়া।
এসব সেবা নিশ্চিত করতে একটি তথ্যভাণ্ডার করা হবে। প্রবাসীদের সব ধরনের তথ্য থাকবে সেখানে।প্রকল্পটি যাচাই-বাছাই করে অনুমোদনের সুপারিশ করেছে পরিকল্পনা কমিশন।
কমিশনের সংশ্নিষ্ট শিল্প ও শক্তি বিভাগের সদস্য সরকারের সচিব শরিফা খান বলেন, আপাতত দেশের ৩২টি জেলার ফেরত প্রবাসীরা প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন। প্রবাসী শ্রমিক অধ্যুষিত জেলাগুলোকেই প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পে আর্থিক এবং কারিগরি সহযোগিতা দিচ্ছে। প্রকল্পটির উদ্যোগ নিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। বাস্তবায়ন করবে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। ২০২৩ সালে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২৭ কোটি টাকা। মোট ব্যয়ের ৪২৫ কোটি টাকাই দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক।
প্রকল্পের আওতায় থাকা জেলাগুলো হচ্ছে—ঢাকা, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, ময়মনসিংহ, জামালপুর, রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পাবনা, বগুড়া, নওগাঁ, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, বরিশাল, পটুয়াখালী, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কক্সবাজার, রাঙামাটি, কুমিল্লা, সিলেট ও সুনামগঞ্জ।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ডিসেম্বরে করোনা শুরু হলেও বিভিন্ন দেশ থেকে কর্মী ফেরত আসা শুরু হয় মূলত গত বছরের এপ্রিল থেকে। ওই বছর মোট চার লাখ ৭৯ হাজার শ্রমিক ফেরত আসে বিভিন্ন দেশ থেকে। সবচেয়ে বেশি আসে সৌদি আরব, আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্য থেকে। এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত আরও ৪১ হাজার প্রবাসী শ্রমিক দেশে ফিরেছেন। এসব প্রবাসীর মধ্যে ২০২০ সালে ফেরত আসা দুই লাখ প্রবাসী শ্রমিক প্রকল্পের আওতায় সুযোগ-সুবিধা পাবেন। দেশের ৩২টি নির্দিষ্ট জেলার প্রবাসী শ্রমিকরাই এতে বিবেচিত হচ্ছেন।
কয়েক দশক ধরে তো বটেই, কোভিডের সময়ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে করোনায় প্রবাসী শ্রমিকেরা চাকরি হারিয়ে কেউ দেশে ফেরত এসেছেন, কেউ সেখানে কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। এ সংকট ক্রমেই বাড়ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কয়েক দশক ধরে তো বটেই, কোভিডের সময়ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে করোনায় প্রবাসী শ্রমিকেরা চাকরি হারিয়ে কেউ দেশে ফেরত এসেছেন, কেউ সেখানে কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। এ সংকট ক্রমেই বাড়ছে।
ব্র্যাক, ইউএন ওমেন ও নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অন ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশনের এক যৌথ গবেষণা বলছে, গত বছরের এপ্রিল-নভেম্বর সময়কালে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ অভিবাসীদের প্রায় ৭৭ শতাংশই দেশে চাকরি খুঁজেছেন। ফেরত আসা প্রবাসীদের জন্য সরকার প্রণোদনা প্যাকেজসহ নানা উদ্যোগ নিলেও তার সুফল যে মিলছে না, গবেষণা প্রতিবেদন তাও বলছে।
প্রবাসী শ্রমিকদের বেশির ভাগ অবকাঠামো নির্মাণসহ নানা রকম কাজে যুক্ত ছিলেন। করোনায় অনেক দেশেই এসব কাজের চাহিদা কমে গেছে। এ কারণে অনেক প্রবাসী শ্রমিককে দেশে ফিরে আসতে হয়েছে। তাদের অনেকেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ফলে শুধু ফেরত আসা শ্রমিকই নন, পুরো পরিবারই সমস্যায় পড়েছে। এরকম ৫ লক্ষ পরিবারের মধ্যে ২ লক্ষ পরিবারকে স্বল্প পরিমাণ নগদ সহায়তা খুবই হতাশাজনক। তাও সঠিকভাবে হবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে বলে জানান বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ফেরত আসা প্রবাসীরা আর্থিক সংকটে থাকায় হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছেন। এমনিতেই দেশে বেকারের সংখ্যা বেশি, তার ওপর করোনার কারণে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্ম হারিয়েছেন অনেকে। অন্যদিকে গত কয়েক বছর অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কাজের সুযোগও বাড়েনি। সব মিলিয়ে দেশে চাকরির বাজারে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। বেসরকারি বিনিয়োগও বাড়ছে না। ফলে সহসাই কর্মসংস্থানের অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই বিদেশই ভরসা। তবে সেটি ধরতে হলে প্রশিক্ষিত দক্ষ জনবলের বিকল্প নেই। দক্ষতা সৃষ্টি ও নতুন নতুন বাজার সন্ধান—যুগপৎ দুইই চালিয়ে যেতে হবে।
তারা বলছেন, সার্বিকভাবে আমাদের অভিবাসীরা স্বল্প দক্ষ ও নিম্ন উৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত বলে যেকোনো ধরনের অর্থনৈতিক অভিঘাত তাদের ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। অর্থনীতিকে চাঙা করতে তাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত অভিবাসীদের বহির্বিশ্বের শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষিত ও দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা। করোনা-পরবর্তী নতুন বিশ্বের জন্য যেসব খাতে দক্ষ লোকের প্রয়োজন, সেই প্রস্তুতিও নিতে হবে এখনই।
আরও বলেন, অন্যদিকে যারা দেশের বাইরে আছেন, তাদের কর্মসংস্থান ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে হবে। নতুন করে যারা বিদেশে যেতে আগ্রহী ও পুরোনো যারা ফেরত যেতে চান, তাদের জন্য কূটনৈতিক উদ্যোগের পাশাপাশি প্রশাসনিক জটিলতা দূর করা প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক কিছু উদ্যোগে প্রীত হয়েছি। বিদেশে ফেরত যেতে আগ্রহী ব্যক্তিদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে অতিরিক্ত বিমান ফ্লাইটের ব্যবস্থাসহ কিছু ক্ষেত্রে ভিসা ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সরাসরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তাদের জন্য নির্ভরযোগ্য এবং সুলভ মূল্যে কোভিড টেস্টের ব্যবস্থা থাকাও দরকার। একই সঙ্গে তাদের টিকা প্রদানের উদ্যোগ নেওয়াও প্রয়োজন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য নিজ অর্থায়নে বিদেশে গিয়ে টিকা প্রদান করছে। বাংলাদেশও এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৩৩
আপনার মতামত জানানঃ