কমছে জনশক্তি রপ্তানি। একই সঙ্গে কমছে বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে রেমিট্যান্সে (প্রবাসী আয়)। জনশক্তি রপ্তানি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখনই নতুন শ্রমবাজার ধরতে না পারলে এ খাত বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) ২০১৮ সালে নতুন ৫৩টি দেশে কর্মী পাঠানোর সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করলেও উল্লেখযোগ্য কোনো শ্রমবাজার এখনো তৈরি হয়নি।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চাহিদার দ্বিগুণ কর্মী পাঠানো, ভিসার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন কারণে কয়েকটি শ্রমবাজার বন্ধ হয়েছে। বেশি কর্মী পাঠানোর দায় জনশক্তি রপ্তানিকারকদেরও আছে। সরকারকে বন্ধ হয়ে যাওয়া শ্রমবাজার দ্রুত চালু ও নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে।
জানতে চাইলে বিএমইটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক (কর্মসংস্থান) শাহ্ আবদুল তারিক আজকের পত্রিকাকে বলেন, অদক্ষ কর্মীদের বিদেশে কর্মসংস্থান কঠিন হচ্ছে।
কারিগরি ও প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে দক্ষ কর্মীর চাহিদা বাড়ছে। তাই দক্ষ কর্মীর বাজার ধরতে কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। জনশক্তি রপ্তানি কমে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চাহিদার তুলনায় বিদেশি কর্মী বেশি হওয়ার কারণ দেখিয়ে ওমান ও মালয়েশিয়া শ্রমবাজার সাময়িক বন্ধ রেখেছে। প্রচলিত শ্রমবাজারের পাশাপাশি নতুন বাজারে কর্মী পাঠাতে সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত যোগাযোগ করা হচ্ছে।
বৈদেশিক কর্মসংস্থানের তালিকায় ১৬৮টি দেশের নাম থাকলেও বাংলাদেশ থেকে কর্মীরা মূলত যান মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশে। অর্থাৎ শ্রমবাজার সীমাবদ্ধ নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশে। সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব। দ্বিতীয় মালয়েশিয়া ও তৃতীয় ওমান। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কর্মীদের ৯৫ শতাংশই গেছেন সৌদি আরব, ওমান, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, কাতার, কুয়েত ও জর্ডানে। এর মধ্যে কর্মী ভিসায় গত তিন বছরে বিদেশে পাড়ি দেওয়া বাংলাদেশি কর্মীদের অর্ধেকের বেশি গেছেন সৌদি আরবে। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে মূলত ইতালি ও রোমানিয়ায় গত দুই বছরে কিছু কর্মী পাঠানো গেছে।
সৌদি আরবে বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখ বাংলাদেশি কর্মী আছেন। বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) দেশটিতে গেছেন ১ লাখ ৬৯ হাজার ৮৬৭ জন। ২০২৩ সালে যান ৪ লাখ ৯৭ হাজার ৬৭৪ জন এবং এর আগের বছর গেছেন ৬ লাখ ১২ হাজার ৪১৮ জন। ২০২১ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৫৭ হাজার ২২৭ জন এবং ২০২০ সালে ছিল ১ লাখ ৬১ হাজার ৭২৬ জন। দেশটি থেকে প্রবাসী আয় পাঠানো কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯৬ কোটি ৬৯ লাখ মার্কিন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসেছিল ৩৭৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪৫৪ কোটি ১৯ লাখ ডলার এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৭২ কোটি ১৪ লাখ ডলার।
সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স কমার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশটিতে গত কয়েক বছরে যাওয়া কর্মীদের একটি বড় অংশই গেছেন ফ্রি ভিসায়। অর্থাৎ কাজ ঠিক না করেই। ফলে তাঁরা যেসব কাজ খুঁজে নিয়েছেন, তাতে প্রত্যাশা অনুযায়ী বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। আবার যাঁরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চুক্তিতে কাজ করছেন, তাঁরাও কম বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। ফলে দেশে বেশি অর্থ পাঠাতে পারছেন না।
একই অবস্থা প্রবাসী আয় আসার অন্যতম দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতেও। দেশটির শ্রমবাজার বন্ধ থাকায় কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশি কর্মীরা সেখানে যাচ্ছেন ভ্রমণ ভিসায়। বিএমইটির তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে গেছেন ২৬ হাজার ১৯২ জন। গত বছর যান ৯৬ হাজার ৪২২ জন এবং ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৭৭৫ জন। কর্মী ভিসায় না যাওয়ায় তাঁদের কাজের নিশ্চয়তা নেই।
এদিকে, গত কয়েক বছরে কয়েকটি দেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে গেছে। প্রবাসী আয় আসার অন্যতম দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত বাংলাদেশি কর্মী নেওয়া বন্ধ করেছে ২০১২ সালের আগস্টে। এখনো ওই বাজার চালু হয়নি। ২০১৮ সালে বাংলাদেশি মুয়াজ্জিনের হাতে বাইরাইনের নাগরিক ইমাম খুনের পর দেশটি বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দেয়। এর আগে ২০১৭ সালে ১৯ হাজার ৩১৮ জন এবং ২০১৬ সালে ৭২ হাজার ১৬৭ কর্মী যান। গত তিন বছরে গেছেন মাত্র ১১ জন।
বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার ওমান ভিসার অপব্যবহার ও চাহিদার তুলনায় দ্বিগুণ কর্মী থাকার অভিযোগে গত বছরের ৩১ অক্টোবর থেকে বাংলাদেশিদের ভিসা বন্ধ করে। বিএমইটি সূত্র বলছে, এর আগে ভিসা পাওয়া ৩০২ কর্মী গত জানুয়ারিতে ওমান যান। ২০২৩ সালে সেখানে গেছেন নতুন ১ লাখ ২৭ হাজার ৮৮৩ কর্মী। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭৯ হাজার ৬১২ জন। তবে গত বুধবার ঢাকার ওমান দূতাবাস এক বিবৃতিতে পেশাগত ১০ ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়ার কথা জানায়। শ্রমিক ভিসা বন্ধই রেখেছে।
জনশক্তি রপ্তানিতে আরেক দুঃসংবাদ এনেছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। গত ৩১ মের পর দেশটি বাংলাদেশসহ ১৫টি দেশের কর্মী প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে। বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ বাংলাদেশি কর্মী থাকা মালয়েশিয়ায় গত বছর গেছেন ৩ লাখ ৫১ হাজার ৬৮৩ জন। এ বছর এপ্রিল পর্যন্ত গেছেন ৪৪ হাজার ৭২৭ জন। চার বছর পর ২০২২ সালে দেশটির শ্রমবাজার খোলার পর ওই বছর গিয়েছিলেন ৫০ হাজার ৯০ জন। আবার অনির্দিষ্টকালের জন্য বাজারটি বন্ধ হলো।
সার্কভুক্ত দেশ মালদ্বীপেও বাংলাদেশি কর্মী রপ্তানি বন্ধ হয়েছে মে মাসে। সিঙ্গাপুরেও কর্মী যাওয়া কমেছে। দেশটিতে ২০২২ সালে ৬৩ হাজার ৩৮৩ জন ও ২০২৩ সালে ৫৩ হাজার ২৬৫ জন গেলেও চলতি বছর গেছেন ১৪ হাজার ৯৬৪ জন।
এ প্রসঙ্গে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর মাইগ্রেশন স্টাডিজের কো-অর্ডিনেটর ড. মো. জালাল উদ্দিন শিকদার আজকের পত্রিকাকে বলেন, শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেট গঠন করা হয়েছে। এতে অভিবাসীরা শোষণের শিকার হন। ভুয়া কাগজপত্র দাখিল, নিয়োগে অনিয়ম, অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়সহ নানা কারণে কয়েকটি দেশ বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ স্থগিত করেছে। আবার যেসব দেশে খোলা আছে, সেগুলোরও কোনো কোনোটিতে রপ্তানি কমছে।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী মে মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান ও কাতার সফর করেন। তিনি ওই সফর নিয়ে মঙ্গলবার মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, আমিরাত নতুন করে ১১টি ক্যাটাগরিতে দক্ষ বাংলাদেশি কর্মীর চাহিদার কথা জানিয়েছে। প্রথম দফায় ডেলিভারি কাজে তিন হাজার কর্মী নেবে। এর মধ্যে ট্যাক্সিচালক ৪০০ ও মোটরসাইকেলচালক ৫০০ জন। ৪০০ কর্মী ইতিমধ্যে চলে গেছেন। আরও ৫০০ কর্মী যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন।
ওমানও দক্ষ কর্মী নিতে চায় জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, দক্ষ কর্মী যাওয়া শুরু করলে অদক্ষ কর্মীও যাওয়া শুরু করবে। পর্যায়ক্রমে সে ব্যবস্থা হবে।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান আজকের পত্রিকাকে বলেন, সৌদি আরবে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কর্মী পাঠানো হচ্ছে। গত কয়েক বছরে প্রায় ১৭ লাখ কর্মী দেশটিতে গেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই কম বেতনে কাজ করছেন; যার প্রভাব রেমিট্যান্সে পড়েছে। বাহরাইন, মালয়েশিয়া, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বন্ধ শ্রমবাজার আবার চালুর জন্য সরকারি পর্যায়ে তৎপরতা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে নতুন দেশের বিষয়ে উদ্যোগ বাড়াতে হবে।
আপনার মতামত জানানঃ