সম্প্রতি চীন হাইড্রোপাওয়ার প্লান্টের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছে। তবে এ প্লান্টগুলো তৈরির সময় প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য বা নদী অববাহিকার ইকোসিস্টেম নিয়ে কোন পর্যালোচনা করা হচ্ছে না, যার কারণে হুমকির মুখে রয়েছে এর অববাহিকায় বসতি গড়া মানুষ ও প্রাণী।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, চীনের এমন প্রকল্পগুলোর কারণে তিব্বতে বড় ধরনের খরা হতে পারে। সেই সঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশের যেই অঞ্চলের মধ্য দিয়ে এই নদীর পানি বয়ে যাচ্ছে, সেই অঞ্চলগুলো পরিবেশগত ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। রাজনৈতিক অস্থিরতাও সৃষ্টি হতে পারে।
নদীর ইকোসিস্টেম ধ্বংস করছে চীন
বাংলাদেশে যে যমুনা, আসামে সে ব্রহ্মপুত্র। অরুণাচলে সিয়াং আর চীনে ইয়ারলং সাংস্পো। দীর্ঘ পথে এই নদীটি তিন দেশের জন্যই বিশুদ্ধ পানির উৎস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশেরই সেচ কার্যক্রম, মৎস্য আহরণ এবং শক্তি (বিদ্যুৎ) উৎপাদনের জন্য এ নদীর ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।
কিন্তু এই নদীটাকে ঘিরে ছোট বড় চীন বেশ কিছু হাইড্রোপাওয়ার প্রকল্প শুরু করায় নদীটি দারুণ হুমকির মুখে রয়েছে। সেইসঙ্গে হুমকির মুখে রয়েছেন এ নদীকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করা মানুষেরা। চীন গত কয়েক বছর ধরেই ইয়ারলং সাংস্পোতে বাঁধ তৈরি করছে।
এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বড় একটি বাঁধ জাংমু হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট; যা ২০১৫ সাল থেকে কাজ শুরু করে। কিন্তু এই বাঁধের কার্যক্রম শুরুর কয়েক বছর পর থেকেই ভারতের অরুণাচলে হঠাৎ করেই নদীর পানি অতিরিক্ত ঘোলা এবং কালো রং ধারণ করে ব্যবহারের উপযোগিতা হারায়।
ভারতের সিয়াং নদীকে ঘিরে তৈরি হওয়া চাষাবাদ ব্যবস্থা এবং মৎস্য আহরণসহ এ অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হয় নদীর পানিতে পরিবর্তন আসার কারণে।
চীনের ব্যক্তিগত লাভ
পাশাপাশি ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের জন্য চীন ১৪তম পঞ্চবর্ষ পরিকল্পনায় দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত হাইড্রোপাওয়ার প্রতিষ্ঠান ‘পাওয়ার চায়না‘ তিব্বতের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সঙ্গে একটি বড় হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট তৈরির চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা ইয়ারলং সাংস্পো নদী তীরে গড়ে তোলা হবে। ৬০ গিগা ওয়াটের এই প্রজেক্টের মাধ্যমে চীন বিদ্যুৎ উৎপাদনে ‘শূন্য কার্বন নিঃসরণ’ অর্জন করবে বলে ঘোষণা দিচ্ছে।
এর মাধ্যমে ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে চায় চীন। সেই সঙ্গে এ প্রকল্পের মাধ্যমে তিব্বতে চাকরির বড় একটি বাজার তৈরি হবে বলেও প্রচার করছে চীন। ইয়ারলং সাংস্পো নদী থেকে চীনের উত্তর প্রদেশে বড় অংশের পানি সরিয়ে নেয়ার মাধ্যমে এ প্রকল্পের কাজটি করা হবে।
সেই সঙ্গে এ প্রকল্পকে চীন তার জাতীয় নিরাপত্তার অংশ হিসেবেও দেখছে যার মাধ্যমে নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে আরও উন্নত হবে দেশটি। যখন জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে ‘গ্রিন এনার্জি‘-তে রূপান্তর করবে পৃথিবী, তখন কম খরচে জ্বালানি উৎপাদনের সহজ একটি পথ তৈরি করছে চীন।
ডেকে আনছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়
কিন্তু চীনের এ অঞ্চলে কৃত্রিম এই পরিবর্তনের ফলে ভূমিকম্প ও ভূমিধসের পরিমাণ অনেকাংশ বাড়বে। ২০২০ সালে তিব্বতের চেন এলাকায় হওয়া ভূমিধস বা নিনচি অঞ্চলে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের মতো ঘটনা নিয়মিত ঘটতে পারে।
চীনের হাইড্রোপাওয়ার প্রকল্পের কারণে নদীর জলজ জীববৈচিত্র্য প্রভাবিত হবে। নির্মাণের স্থানে পানির মধ্যকার ইউট্রোফিকেশন (রাসায়নিক পুষ্টি যেমন নাইট্রোজেন এবং ফসফরাসসহ জল সমৃদ্ধকরণ উপাদান) হতে পারে, যা খাবার পানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ইউট্রোফিকেশনের ফলে শৈবালের উৎপাদন বাড়ে। এটি পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস করে। এর ফলে মাছের মৃত্যু ঘটার পাশাপাশি পুরো জলজ পরিবেশ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়।
নদী তীরে বসবাসরত মানুষের জীবনের জন্য হুমকি হতে পারে বলে এমন এক প্রকল্প তৈরির আগে আরও পর্যালোচনার মাধ্যমে যাচাই–বাছাই করা উচিত ছিল চীনের। সেই সঙ্গে নদীর গতিতে যে কোন পরিবর্তনের ফলে হুমকির মুখে পড়বে একে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা প্রাকৃতিক জীবন ব্যবস্থা।
ভারত–বাংলাদেশে বড় ধরনের পরিবেশগত পরিবর্তন আসবে। বাঁধ নির্মাণের কারণে নদীর পানির গুণগত মানের পরিবর্তন হবে, যার ফল ভোগ করতে হবে নদী তীরবর্তীদের।
চীন এ বাঁধ তৈরি করলে সেখানে নদীর পানি থিতিয়ে পলির পরিমাণ হ্রাস পেতে পারে। ফলে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় থাকা অঞ্চলগুলো উর্বর পলি থেকে বঞ্চিত হবে। কিন্তু পানিতে পলি কম থাকায় তা অতিরিক্ত নদী ভাঙ্গনের কারণ হবে।
এ ছাড়াও বাঁধের কারণে নিয়মিত পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় নদীর পানি কমে যাবে। ফলে মৎস্য আহরণ শিল্প দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মৎস্যজীবীরা জীবিকা হারাবে। সেই সঙ্গে নদী বেষ্টিত এ অঞ্চলের অন্যতম বিকল্প যোগাযোগ ব্যবস্থা নদী পথে যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হবে পানি কমে যাওয়ায়।
চীনের পানি নৈরাজ্য
নদীর উৎপত্তি স্থলের দেশটি সবসময় নদী থেকে বেশি সুবিধা পায়। অন্যদিকে সমুদ্রের কাছে থাকা অঞ্চলগুলো সঠিক সময়ে পানি থেকে বঞ্চিত হয়। চীন যেহেতু এই নদীর উৎস অঞ্চল এবং নদীর পরবর্তী অংশে ভারত ও বাংলাদেশ, তাই পানি বণ্টনের মূল কর্তৃত্ব সবসময় চীনের কাছেই থাকছে।
সুতরাং শুষ্ক মওসুমে খরা এবং বর্ষা মওসুমে এ বাঁধ থেকে অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের কারণে বাংলাদেশ ও ভারতে বন্যা হতে পারে।
২০০০ সালের এপ্রিলে ঝামু ক্রিকের কাছে একটি বড় ভূমিধস হয়, যার প্রভাবে সেখানে কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায় ইয়েগং নদীর গতিপথ। এরপর আবারও নদীর গতিপথে পানি চলাচল শুরু হলে তা হঠাৎ করে বন্যার সৃষ্টি করে ভারতের অরুণাচলে।
৫০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বন্যা হওয়ায় প্রায় ৫০ হাজার লোককে বাস্তুচ্যুত হতে হয়। এ অঞ্চলে প্রাকৃতিক বাঁধ ফেটে সৃষ্ট বন্যার ঘটনা এটিই প্রথম ছিল। এবার যদি কৃত্রিম কোন বাঁধ থেকে হঠাৎ করে পানি ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে কী হতে পারে, বিষয়টি সকলের কাছেই বেশ স্পষ্ট।
এদিকে ২০০০ সালের সেই বন্যার পর থেকে এই অঞ্চলকে নিয়মিত বন্যার সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে এ নদীতে বাঁধ নির্মাণ করায় নদীর গতি কমে পলির স্তর বাড়ছে। ফলে বন্যা নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের বৃহত্তম একটি গোষ্ঠী কৃষিকাজ ও মাছ ধরার উপর নির্ভরশীল। এ দুইটি ব্যাপারই পানির গুণমান এবং প্রাপ্যতার ওপর নির্ভরশীল। ইয়ারলং সাংস্পো উপরের প্রান্তে জলাবদ্ধতা বা জলের বিবর্তন বাংলাদেশকেও বঞ্চিত করবে এবং এর জনগণের জীবিকা নির্বাহে প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, দেশের নদীগুলোর প্রায় নব্বই শতাংশই বাইরে থেকে দেশের মধ্যে ঢুকেছে। চীনের কারণে যে ক্ষতির দিকে বাংলাদেশ ও ভারত এগিয়ে যাচ্ছে, তা মীমাংসায় অবশ্যই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২০২০
আপনার মতামত জানানঃ